ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবন্ধ ॥ বিজয়ী বেশে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রবন্ধ ॥ বিজয়ী বেশে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে  -স্বদেশ রায়

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস যতদিন এ পৃথিবীতে কথা বলবে ততদিন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নাম তার সঙ্গে উচ্চারিত হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষে যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা পৃথিবীতে এক বিজয়ী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীর নামটিও ছিল এক বিজয়ীর নাম। তিনি শুধু বিজয়ী নন, তখন তিনি ছিলেন এক মানবতার নাম, যিনি নিজের দেশের চরম দারিদ্র্যকে মেনে নিয়েও মানবিকতার নামে এক কোটি বাঙালী শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সর্বোপরি তাঁর দেশের সৈনিকদেরকে নামিয়েছিলেন, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঙালী মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে যুদ্ধে। যার ফলে দুই দেশের রক্তধারা এক হয় এই ঐতিহাসিক ভূমিতে। এই ভূমিতে ইন্দিরা গান্ধী মাত্র একবারই এসেছিলেন। পৃথিবীর শত শত রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান আমাদের দেশে এসেছেন, আসবেন। এমনকি বার বার আসবেন ভারতের নানা রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান। কিন্তু মিসেস গান্ধীর ওই সফরের উচ্চতাকে কেউ কোনদিন স্পর্শ করতে পারবেন না। তিনি শুধু বিদেশী কোন সরকারপ্রধান নন, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এমন একজন নেতা ও যোদ্ধা যাকে ছাড়া বাংলাদেশ নয় মাসে বাস্তবে রূপ পেতো না। বাংলাদেশের এই বন্ধু, এই মুক্তিযোদ্ধা প্রথম কোন বিদেশী সরকারপ্রধান হিসেবে এসেছিলেন বাংলাদেশে। তাঁর বাংলাদেশ সফরের স্মারক হিসেবে বঙ্গবন্ধু যেখান থেকে স্বাধীনতার ডাক দেন, যার পাশে পাকিস্তানী হানাদাররা আত্মসমর্পণ করে, ঠিক তার পাশেই তৈরি করা হয়েছিল ইন্দিরা মঞ্চ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে শিশু পার্ক তৈরি করার নামে জিয়াউর রহমান পাকিস্তানীদের নির্দেশে এই স্থানটি ঢেকে দেয়, ভেঙ্গে ফেলে ইন্দিরা মঞ্চ। তবে ওই মঞ্চে দাঁড়িয়ে শ্রীমতী গান্ধী যে ভাষণ দিয়েছিলেন, ওই ভাষণটিকে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ক্ষমতা কারও নেই। কারণ, ইতিহাসের স্মৃতি হিসেবে তৈরি কিছু স্মারক স্তম্ভ ভেঙ্গে ফেলা যায়, ইতিহাসের ঘটনাকে মুছে ফেলা যায় না। আর কাগজে মুদ্রণ যুগ শেষে যখন ইলেকট্রনিক মুদ্রণ যুগে প্রবেশ করেছে পৃথিবী, সে সময়ে ইতিহাসের ঘটনাকে মুছে ফেলার ক্ষমতা তো কারও নেই। তাই আজ বাংলাদেশের ৪৭তম বিজয় দিবসে, ইন্দিরা গান্ধীর শততম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করার জন্যে অন্তত তাঁর ওই একটি ভাষণের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীকে খুঁজে দেখা যেতে পারে। কেমন ছিলেন সেই মহামানবী, যিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় একাধারে মাতৃহৃদয়া-আশ্রয়দাত্রী, অন্যদিকে যুদ্ধের ময়দানে লৌহমানবী। ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইন্দিরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি যখন ভাষণ দেন, তখন তাঁর বয়স ৫৩ বছর। বঙ্গবন্ধুর বয়স তখন ৫২ বছর। সমবয়সী দুই বিজয়ী নেতা সেদিন এক হয়েছিলেন ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণে। আশ্চর্যের বিষয়, মাত্র ৫৩ বছরের এই নেত্রী, সেদিন পৃথিবী কাঁপানো বিজয় সঙ্গে নিয়ে ওই ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণে, বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে যে ভাষণ দেন, তা ছিল সম্পূর্ণ নির্মোহ এক ভাষণ। তাঁর ওই ভাষণটিকে যদি আমরা কিছুটা বিশ্লেষণ করে মোটা দাগে ভাগ করি তাহলে কমপক্ষে তেরোটি ভাগে ভাগ করা যায়। এক, শুরু বা প্রারম্ভ। দুই, বঙ্গবন্ধু আমাদের কী বা কে? তিন, মুজিবনগর সরকার ও তাঁর নেতৃবৃন্দ। চার, ভারতীয় জনগণ ও ভারত কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাশে এলো। পাঁচ, স্বাধীনতা পাওয়াই শেষ কথা নয়। ছয়, ভারতের স্বাধীনতা পাবার পরবর্তী অভিজ্ঞতা। সাত, স্বাধীনতা পাবার সঙ্গে সঙ্গে আকাক্সক্ষা কোথায় গিয়ে পৌঁছায়। আট, ভারত নিজস্ব বোধ থেকে কাজ করেছে, কোন সাহায্য নয়। নয়, ভারতীয় ইতিহাসের নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা ও বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু। দশ, ভারতীয় সৈনিকের রক্ত। এগারো, ধর্ম এবং বাস্তবতা। বারো, ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া। তেরো, পথ অনেক দীর্ঘ। ভাষণের শুরুতে মাত্র একটি বাক্যে তিনি তাঁর সমস্ত আবেগটুকু প্রকাশ করেছেন, আর কোথাও কোন আবেগ নেই। ইংরেজী ভাষায় দেয়া তাঁর এ ভাষণের এই বাক্যটি, “ গু যবধৎঃ ড়াবৎভষড়ংি ধং ও পড়সব ঃড় ুড়ঁৎ নবধঁঃরভঁষ পড়ঁহঃৎু ধহফ ঃযরং যরংঃড়ৎরপ মৎড়ঁহফ.” (আমার হৃদয়পাত্র উছলি উঠেছে আপনাদের এই সুন্দর ও ঐতিহাসিক ভূমিতে এসে)। রবীন্দ্রনাথের ছাত্রী প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা একটি মাত্র রাবীন্দ্রিক শব্দ ব্যবহার করে একটি বাক্যে তাঁর সমস্ত আবেগ শেষ করেই সূচনাতে চলে গেছেন, তাঁদের প্রতি তাঁর বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, যে এক কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে তাঁর দেশে শরণার্থী হয়েছিলেন, সর্বোপরি ওই দিনটি অর্থাৎ ১৭ মার্চ এমন এক নেতার জন্মদিন যিনি শুধু আমাদের বঙ্গবন্ধু নন, সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষের ভাই। এখানে ইন্দিরা গান্ধীর এই ভাষণ থেকে আমাদের নতুন প্রজন্মের দুটি বিষয় শেখার আছে- এক, আমরা মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের স্মরণ করি, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগকে স্মরণ করি- কিন্তু এক কোটি শরণার্থীর এই ত্যাগকে মুক্তিযুদ্ধের কোন স্মরণ অনুষ্ঠানে আমরা খুব কমই স্মরণ করি, যা আমাদের সব সময়ই করা উচিত। দুই, বঙ্গবন্ধু যে শুধু গোটা বাঙালীর নয় গোটা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের নেতার প্রতীক, এই সত্য আমরা এখনও আমাদের সকলের উপলব্ধিতে আনতে পারিনি, যা নতুন প্রজন্মকে আনতে হবে। এরপরেই তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের কে এবং তিনি আমাদের কী দিয়েছেন। ভাষণের এই চতুর্থ প্যারায় এসে তিনি বলেছেন, আপনাদের এখন অনেক সমস্যা আছে। নতুন দেশ হিসেবে সব দিকেই সমস্যা থাকাটাই স্বাভাবিক। আপনাদের অনেক সম্পদের ঘাটতি আছে। কিন্তু আপনারা ভাগ্যবান, আপনারা সেই বিশাল মাপের নেতা পেয়েছেন, যিনি শুধু তাঁর সারাটা জীবন আপনাদের ভালোর জন্য দেননি, তিনি আপনাদেরকে ঐক্য ও সাহস দিয়েছেন। এটাই আপনাদের মূল সম্পদ। বাস্তবে বঙ্গবন্ধু আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসের সেই নেতা যিনি আমাদের একতা দিয়েছিলেন। সত্যি অর্থে হাজার বছরের বাঙালীর ইতিহাসে বাঙালী ওই একবারই মাত্র বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক হয়েছিল। ওই একবারই মাত্র বাঙালী পৃথিবীর সেরা সাহসী জাতি হয়েছিল। যে কোন জাতির জীবনে ঐক্য ও সাহসের থেকে বড় সম্পদ আর কোন কিছুই নয়। প্রাকৃতিক সম্পদ এই সম্পদের কাছে অতি নগণ্য। জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হারাইনি, আমরা স্বাধীনতার পর পরই আমাদের ঐক্য হারিয়েছিলাম, সাহসও হারিয়েছিলাম। স্বাধীনতার পর পরই যে এই একতা হারানোর, সাহস হারানোর সম্ভাবনা থাকে এবং কেন সেগুলো ঘটে, তাও মিসেস গান্ধী তাঁর ভাষণের নয় ও এগারো প্যারায় বলে গিয়েছিলেন। তাঁর গোটা ভাষণটিকে তেরো ভাগে ভাগ করে প্রথমেই যে উল্লেখ করেছি, তার পাঁচ ও সাত ভাগ থেকে কিছু কথা উল্লেখ করলে এর কারণগুলো চলে আসে। মিসেস গান্ধী তাঁর ভাষণের নয় প্যারায় এসে বলেছেন, স্বাধীনতাই শেষ নয়। একথা বলতে গিয়ে মিসেস গান্ধী তাঁর ভাষণে বলেছেন, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি স্বাধীনতা পাওয়া মানে শেষ নয়, বরং এখান থেকেই শুরু হয়। স্বাধীনতা নতুন জীবন, নতুন নতুন সুযোগের দরজাগুলো খুলে দেয়। এই নতুন জীবন কখনও কয়েকজন নেতা গড়ে দিতে পারেন না। এটা গোটা জাতির ত্যাগ, ঐক্য. কঠোর পরিশ্রম ও নিয়মানুবর্তিতার ভিতর দিয়েই গড়ে তুলতে হয়। আপনাদের দেশ সুন্দর, সোনার দেশ। তবে আসলে তখনই দেশটি সোনার দেশ হবে যখনই মানুষের জীবনের বোঝাগুলো হালকা হয়ে যাবে, সেখানেই জীবনের সৌন্দর্য। ঠিক এমনিভাবে ভাষণের এগারো প্যারায় মিসেস গান্ধী তাঁদের নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সতর্ক করেছেন আমাদের। তিনি বলেছেন, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল দীর্ঘ সময়ের। এই দীর্ঘ পথ চলাতে প্রতিটি পদক্ষেপে লাখো লাখো মানুষকে করতে হয়েছে মহত ত্যাগ। যার ফলে শেষ পর্যন্ত আমরা স্বাধীন হই। স্বাধীন হবার পরে আমরা দেখতে পাই, স্বাধীনতা পরবর্তী দুর্গম পথের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্গম পথ কিছুই নয়। এ সময়ে যখন ঐক্যের দরকার হয়, তখন নানান মতের উপস্থিতি ঘটে। কিছু লোক অলৌকিক কিছু আশা করে। মনে করে, স্বাধীনতার ভেতর কোন জাদুর কাঠি আছে যা দিয়ে দারিদ্র্য, বেকারত্বসহ সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বাস্তবে সব থেকে কঠিন সময় হচ্ছে একটি নতুন জাতি বা রাষ্ট্র জন্মগ্রহণ করার পরে। এই সময়ে যদি প্রত্যেকেই তাঁর দায়িত্ব সঠিক পালন করেন, আর দৃঢ়ভাবে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখা যায় তাহলেই একটি নতুন সমাজের শক্তিশালী ভিত্তি গঠন সম্ভব। একটি নতুন জাতিকে শুধু তার দেশের ভিতর থেকেই সমস্যাকে মোকাবিলা করতে হয় না, আন্তর্জাতিক সমস্যাও মোকাবিলা করতে হয়। আজ ৪৭ তম বিজয় দিবসে এসে আমরা যদি আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়টা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই- আমাদের আজ যে ব্যর্থতা, আমরা যে এখনও সত্যিকার অর্থে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারিনি, আমরা যে স্বাধীনতার অনেক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছি- তার মূল কারণ এখানেই নিহিত। স্বাধীনতার পরে দেশ গড়ার জন্য আমরা ত্যাগ করতে পারেনি, ঐক্য ধরে রাখতে পারিনি। সত্যি অর্থে উপলব্ধি করতে পারিনি, যা ইন্দিরা গান্ধী আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণে এই কথাগুলোই মাত্র দুটি শব্দে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই স্বাধীনতা ঘোষণা দেবার পরেই তিনি বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এই মুক্তির জন্যে কী করতে হবে সেটাই ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ১৭ মার্চের ভাষণে তাঁর দেশের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারির ওই ভাষণের পঞ্চম প্যারায় এসে ইন্দিরা গান্ধী আমাদের মুজিবনগর সরকারের নয় মাসের কাজ এবং মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধকে এক মহাকাব্যিক অধ্যায় বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ ও ত্যাগী সহকর্মী, যারা সত্যি অর্থে অনেক বড় নেতা তাঁরা সেদিন লালসবুজ পতাকাকে উর্ধে তুলে ধরেছিলেন। বিশ্ববিবেককে জাগিয়েছিলেন, এমনকি যারা সেদিন বাংলাদেশের কণ্ঠকে বন্ধ করতে চাচ্ছিল তাদেরকেও প্রতিহত করেন বঙ্গবন্ধুর এই সহকর্মীরা। সর্বোপরি, উজ্জ্বল তরুণ ও ছাত্রলীগের গড়ে তোলা মুক্তিবাহিনীর আত্মোৎসর্গ গড়ে তোলে এক মহাকাব্য। বাস্তবে মুজিবনগর সরকারে ভূমিকাও বঙ্গবন্ধুর সেই সহকর্মীরা শেষ অবধি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, তাদের আনুগত্য ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, যা ইন্দিরাজী স্মরণ করেন তাঁর ভাষণে। তবে সত্যি হলো মুজিবনগরে যে মহাকাব্য লেখা হয়েছিল, আমাদের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা যার অন্যতম অগ্রসেনানী, তারা কিন্তু স্বাধীনতার পরে সেই মহাকাব্যের পরবর্তী অধ্যায় আর সঠিকভাবে লিখতে পারেননি। অন্যদিকে ১৯৭২ সালে, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য। বিদেশী অনেক পত্র পত্রিকা প্রচার করছে, অনেক সাংবাদিক লিখছেন, একটি খাকি ড্রেস থেকে আরেকটি খাকি ড্রেসে প্রবেশ করেছে নতুন রাষ্ট্রটি। কারণ, তখনও পর্যন্ত অনেকেই বুঝতে পারছেন না মিসেস গান্ধী দ্রুতই ভারতীয় সৈন্যকে প্রত্যাহার করে নিয়ে বাংলাদেশকে যাতে পৃথিবীর সব দেশ স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত না হয় সে পথ তৈরি করবেন। তবে সাধারণ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের এটা বোঝা উচিত ছিল, জয়ের শতভাগ সম্ভাবনা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দেন মিসেস গান্ধী। যার ভিতর দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন, তাঁর সরকারের কোন উদ্দেশ্য নেই পাকিস্তানের এক ইঞ্চি জমি দখল করার। পূর্বখ-ে তাঁর সরকার যা করেছে তা মিত্রবাহিনী হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা। সেখানে কোন কলোনি গড়ে তোলার জন্য নয়। তাই তিনি যে এখান থেকে দ্রুত সৈন্য প্রত্যাহার করবেন, বাংলাদেশ যে সম্পূর্ণ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে, সেখানে ভারতের কোন আধিপত্য থাকবে না- তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যেদিন তিনি পশ্চিমখ-ে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন সেদিনই। তারপরেও ১৭ মার্চ মিসেস গান্ধী তাঁর ভাষণের পঞ্চম প্যারায় বলেন, যদি ভারত আপনাদের সাহায্য করে থাকে- তা কেবলমাত্র আপনাদের দাবি ও আপনাদের দুঃখ ও ভোগান্তি শোনার পরে ভারত চুপ করে বসে থাকতে পারে না এ কারণেই। যদি আমরা আপনাদের সাহায্য করে থাকি তবে তা ভারতআত্মা যে নীতি, আদর্শ বিশ্বাস করে, তারই প্রতিফলন। আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে আমরা আপনাদের যে সহযোগিতা করেছিলাম, তাঁর কোন প্রতিফলন থাকবে না। দুটি সার্বভৌম দেশ শুধু যেভাবে সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা করে সম্পর্ক তৈরি হয়, আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হবে। ভাষণের ১৩ প্যারায় এসে তিনি বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলেন, আপনারা আমাদের ধন্যবাদ দিয়েছেন, কিন্তু আমরা যাই করি না কেন, আমাকে বলতে দিন, আমরা আমাদের নিজস্ব দায়িত্ব বোধ থেকে করেছি, মানবতার দাবি থেকে করেছি। এটা আমাদের কর্তব্য মাত্র। ইন্দিরা গান্ধীর এই রাজনৈতিক ও আত্মিক বোধের অবস্থানের কারণে, শুধুমাত্র তার কয়েকদিনের ভেতর বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য শুধু চলে যায়নি, দক্ষিণ এশিয়ার সদ্যজাত এই দেশটি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমানতালে তখনই ভারতের সঙ্গে পা ফেলে। কখনই মনে হয়নি, ভারত একটি বৃহৎ প্রতিবেশী। বরং তার থেকে বেশি মনে হতো ইন্দিরা গান্ধী যদিও সে সময়ে বিশ্বনেত্রী, তারপরেও বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিব বিশ্ব মানবের মুক্তির প্রতীক। আর এই বিশ্ব মানবের মুক্তির প্রতীক বঙ্গবন্ধু আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারেন তা তিনি উল্লেখ করেন তাঁর ভাষণের চৌদ্দ প্যারায় এসে। তিনি তাঁর ভারতবর্ষের কথা উল্লেখ করে বলেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ তৈরি হয়েছে বহু ধর্ম ও বহু চিন্তার সমন্বয়ে। যাদের মাত্র কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ বোস, চিত্তরঞ্জন দাশ, আবদুল গাফফার খান, খান সাহেব, মৌলানা আজাদ প্রমুখ। তাঁর এ ভাষণের এ অংশের পরেই মিসেস গান্ধীর পরিমিতবোধের কথা বা তাঁর বিনয়ের নিদর্শনের দিকে না তাকালে তাঁকে উপলব্ধি করতে ভুল হয়ে যাবে। এই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ তৈরিতে তাঁর পিতামহ মতিলাল নেহরু ও তাঁর পিতা প-িত জওয়াহেরলাল নেহরুর ভূমিকা ইতিহাসের অংশ। কিন্তু তিনি তাঁদের নাম অতি সাবধানে এড়িয়ে গেছেন। নিজ মুখে বলেননি। যা হোক, এই অংশে এসে তিনি বলেছেন, দেশ গড়ার ক্ষেত্রে ভারতের পথ ভারতের নিজস্ব, বাংলাদেশের পথ বাংলাদেশের নিজস্ব। বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষাই বাংলাদেশের পথ তৈরি করে দেবে। তবে বাংলাদেশের উন্নত পথ তৈরি করতে হলে যে বঙ্গবন্ধুর হাতকেই শক্তিশালী করতে হবে, বাংলাদেশের জনগণের সে কথাই বলেন মিসেস গান্ধী। তিনি তার ভাষণে বলেন, আপনারা ভাগ্যবান যে, আপনারা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো আকাশছোঁয়া এক ত্যাগী নেতা পেয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুধু আপনাদের দেশের ভেতর সীমাবদ্ধ নন, পৃথিবীতে যেখানে মূল্যবোধের জন্য, সাহসের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, সত্যের জন্য, মানুষ দাঁড়াবে সেখানেই থাকবে, শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। এমনকি যেখানে মানুষ মানবতার স্বার্থে এক হবে, সেখানেই সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। আপনাদের এর সম্পূর্ণ সুযোগ নেয়া উচিত। একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের হাতকে শক্তিশালী করেই, তাকে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করেই আপনারা আপনাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন। এই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ধর্ম যে মূল বিষয় নয়, সে কথা মিসেস গান্ধী তাঁর ভাষণের পনেরো প্যারায় উল্লেখ করেন। তিনি স্বীকার করেন, প্রত্যেকটা জাতি তার ধর্ম থেকে শক্তি নেয় ঠিকই কিন্তু তার মৌলিক চাহিদা মেটাতে দরকার হয় ঐক্য, দরকার হয় সোশ্যাল জাস্টিস। আর এই ঐক্যের ক্ষেত্রে সোশ্যাল জাস্টিসের চেয়ে ধর্ম যে বড় নয় তা উল্লেখ করে ওই প্যারায় বলেছেন, আমি গর্বিত যে এই মাটিতে আমার দেশের সৈনিকদের রক্ত মিশে আছে। যা আমাদের ভবিষ্যতের বন্ধুত্বকে সুদৃঢ় করতে সাহায্য করবে। ভাষণের শেষ প্রান্তে এসে অর্থাৎ ধন্যবাদ জানানোর আগের দুই প্যারায় অর্থাৎ ষোলো ও সতেরো প্যারায় দেখা মেলে আধুনিক রাষ্ট্র বির্নিমাণের কারিগর জওয়াহেরলাল নেহরুর কন্যা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর। অর্থাৎ শান্ত মাথার এক রাষ্ট্রনায়কের। তিনি বলেন, এখানে এক মহা কর্মযজ্ঞের শুরু হয়েছে, আমি বিশ্বাস করি সেটা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে। এর প্রতিটি ধাপই বাংলাদেশকে শক্তিশালী করবে। এবং এই উন্নতি কোন একটি বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। পৌঁছে যাবে প্রতিটি দুয়ারে। সেটাই সোনার বাংলা বা গ্লোডেন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পরে যে দূরন্ত গতির সৃষ্টি হয়, তরুণরা অস্থির হয়ে ওঠে সেটাকে খাটো না করে তিনি বললেন, এই কর্মযজ্ঞ একদিনের নয়, এক লাফের নয়, ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে। আর ধন্যবাদ দেয়ার শেষ প্যারায় এসে তিনি তাঁর পিতার মতো দার্শনিক উক্তির ভেতর দিয়েই প্রকৃত বাস্তবতা ও প্রকৃত ধন্যবাদটি জানালেন, রাস্তা দীর্ঘ এবং দুর্গম, তবে সাহসী কোন বাধা মানে না, গুরুত্ব দেয় না কোন বিপদকে।
×