ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গল্প ॥ মওলানা শামসুল হক -আলমগীর সাত্তার

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

গল্প ॥ মওলানা শামসুল হক  -আলমগীর সাত্তার

একাত্তরের ২৬ মার্চের পর আমি আমার মা-ভাই-বোন সবাইকে আমাদের মাদারীপুর জেলার গোপালপুর গ্রামে এবং স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠিতে রেখে এসেছিলাম। এরপর ঢাকায় ফিরে এলাম। ঢাকায় ফিরে আসার পর পিআইএর পাইলট ক্যাপ্টেন রফিউল হক এবং আমি শলাপরামর্শ করে স্থির করলাম, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আমরা ভারতে যাব। তবে রফিক বলল, ভারতের পথে রওনা করতে ওর দশ-বারো দিন সময় লাগবে। তাই আমি মনে করলাম, এই দশ-বারো দিন সময়ের মধ্যে গোপালপুর এবং স্বরূপকাঠি থেকে ঘুরে আসি। এই লেখাটা মাদারীপুর থেকেই শুরু করা যাক। পরিকল্পনামতো এপ্রিলের ২২ বা ২৩ তারিখ সন্ধ্যেবেলা মাদারীপুর গিয়ে পৌঁছলাম। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণে সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। লঞ্চ যখন মাদারীপুরের ঘাটে ভিড়ল তখন দমকা বাতাসের সঙ্গে প্রচন্ড- বৃষ্টি হচ্ছিল। লঞ্চঘাট থেকে মাদারীপুর শহরে দূরত্ব হয়ে দেড় থেকে দুই মাইল। শহরে যাওয়ার জন্য কোন রিক্সা পেলাম না। বৃষ্টিতে ভিজে হেঁটেই রওনা হলাম। পথে কোন লোকজনকে দেখতে পেলাম না। একদিন আগে মাদারীপুর শহরে পাক আর্মি এসেছে। ভয়ে বেশিরভাগ লোকই শহর ছেড়ে চলে গেছে। কোন দোকানপাট, হোটেল-রেস্তরাঁ খোলা দেখতে পেলাম না। সন্ধ্যের পর প্রবল বৃষ্টির কারণে আলোবিহীন শহরটাকে ভুতুড়ে মনে হচ্ছিল। মাদারীপুর শহরে আনোয়ার হোসেন নামে আমার এক বন্ধু ছিল। তার বড় ভাই ছিলেন আইয়ুব খান সমর্থক কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতা। সন্ধ্যে আটটা সাড়ে আটটার সময় আনোয়ারদের বাসায় পৌঁছে দেখলাম তাদের বাসার সদর দরজায় ঝুলছে বড় একটা তালা। ভেবেছিলাম, তাদের মতো ঘোরতর পাকিস্তান সমর্থক পাক আর্মির ভয়ে শহর ছেড়ে পালাবে না। কিন্তু তারাও পালিয়েছে। আনোয়ারদের বাসায় কেউ নেই দেখে, অন্ধকারে বৃষ্টির ভেতরেই আবার জনমানবহীন রাস্তা ধরে হেঁটে চললাম। বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজছিলাম বলে তখন আমার ভয়ানক শীত করছিল। প্রায় আধ ঘণ্টা হাঁটার পর বাদামতলী সিনেমা হলের কাছে আমার এক আত্মীয়ের বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু বিধিবাম, আমার ওই আত্মীয়রাও বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছে। রাত তখন ন’টা- সাড়ে ন’টা বাজে। আমি বুঝতে পারছিলাম না। এমন দুর্যোগভরা রাতে আর কোথায় যাওয়া যেতে পারে? আমার বাড়ি গোপালপুর মাদারীপুর শহর থেকে সাত- আট মাইল দূরে। এ রকম ঝড়বৃষ্টির রাতে অতটা পথ হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। আমার আত্মীয়ের শূন্য বাসার সামনে যখন অসহায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে, তখন হঠাৎ করেই পাশের বাসার জানালা দিয়ে একটু আলোর রেখা দেখতে পেলাম। তাই তড়িঘড়ি আমি সে বাসার সামনে গিয়ে দরজার কড়া নারলাম। প্রথমে বাসার ভেতর থেকে কেউ সাড়াশব্দ করল না। তবু নিরুপায় হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ঠিক তখন একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক দরজাটা একটুখানি ফাঁক করে দেখবার চেষ্টা করলেন, আসলে আমি কে? আর এই সুযোগে ভদ্রলোককে সোজা বললাম, আমি তাদের পাশের বাসার রাজনদের আত্মীয়। আমার বাড়িঘরের পরিচয় দিয়ে বললাম জানি না, এমন দুর্যোগপূর্ণ রাতে আমি কোথায় যাব? মাঝবয়সী ভদ্রলোক দরজা খুলে এবার আমাকে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিলেন। বৃষ্টিতে আমর জামা কাপড় ভিজে গিয়েছিল। আমার কাঁধে ঝুলানো অবস্থায় আরও একটা লুঙ্গি আর জামা ছিল। সেগুলোও তখন ভিজে জবজবে। আমার জামা কাপড়ের এই হাল দেখে অপরিচিত অনাত্মীয় ভদ্রলোক আমাকে একখানা শুকনো কাপড় এবং একখানা কাঁথা দিলেন। তাদের ছোট পরিসরের বাসার বারান্দায় আমার ঘুমানোর ব্যবস্থা করলেন। একটু পরে দু’খানা গরম আটার রুটির সঙ্গে একটুখানি আলুভাজি আহার হিসেবে দিলেন। সবশেষে দিলেন এক কাপ গুড়ের চা। বৃষ্টিতে একটানা ও রকমভাবে ভেজার পর তার দেয়া শুকনো কাপড় পরে আহার পর্ব শেষে গুড়ের তৈরি চা বড়ই উপাদেয় মনে হয়েছিল। রাতটুকু কোনমতে কেটে গেল। ফজরের আজান দেয়ার আগেভাগে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। আত্মীয় ভদ্রলোককে সবকিছুর জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হলাম। রাস্তায় তেমন কোন লোকের দেখা পেলাম না। বাসস্ট্যান্ডের কাছে আসতেই দেখা পেলাম মোটাসোটা এক লোকের। তবে তার ভাবভঙ্গি তেমন সুবিধার মনে হলো না। সে আমার নামধাম পরিচয় জানতে চাইল। বললাম। তার পরেও সে বেশ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে জেরা করার মতো করে আমাকে আমার সত্যিকারের নাম বলতে বলল। এবার বুঝতে পারলাম, আমি রাজাকারের পাল্লায় পড়েছি। জানতাম, এর কাছে দুর্বলতা প্রকাশ করলে সে আমাকে পেয়ে বসবে। তাই বুদ্ধি করে গলার স্বর ছড়িয়ে আমার পরিচয় দিলাম। তাতে বেশ কাজ হলো। আমার দাদারা ছিলেন এগারো ভাই। দাদাদের আবার চাচাত ভাই মামাত ছিল। সব মিলিয়ে আমার চাচা খুড়োর সংখ্যা ছিল চল্লিশ পঞ্চাশ জনের কম না। সব থেকে বড় কথা তারা নিরীহ ধরনের মানুষ ছিলেন না। তাই ওই অঞ্চলের লোকরা আমাদের খানিকটা সমীহ করত। আমার বাড়ির পরিচয় পেয়ে রাজাকার লোকটা বেশ দমে গেল। আমার পরনে ছিল তসরের পাঞ্জাবি এবং বার্মিজ লুঙ্গি। আমার আপদমস্তক নিরীক্ষণ করে সে এবার বলল, ভাই আপনার চেহারা এবং পোশাক দেখলে লোকজন আপনাকে হিন্দু মনে করবে। মাথায় একটু টুপি পরেন। না হলে পথে বিপদ হতে পারে। লোকটাকে বললাম, আমার কাছে তো টুপি নেই। এ কথা শুনে লোকটা দ্রুত তার বাসার ভেতরে ঢুকে গেল এবং একটা টুপি এনে আমার হাতে দিল। এবার আমি টুপি সজ্জিত হলাম। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে, ওই গরমের মধ্যে স্যুটকোট পরিহিত আমার এক ভগ্নিপতির (চাচাত বোনের স্বামী) দেখা পেলাম। তিনি আমার সঙ্গে আমাদের বাড়ি যাবেন। গতকাল বিকেলে আমার কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি অন্য একটা লঞ্চে চেপে ঢাকা থেকে মাদারীপুর এসেছেন। গতকাল বাস পাননি বলে এখানে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। অবশ্য তিনি আমার মতো কষ্ট করে রাত কাটাননি। মাদারীপুরের ধনাঢ্য পরিবার হাওলাদারদের বাড়িতে তিনি মেহমান হিসেবে ছিলেন। তবে আমার এই ভগ্নিপতি বিপদে পড়ে আমাদের বাড়ি যাচ্ছেন না। মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ঢাকা শহরকে তিনি নিরাপদ মনে করেননি। তখন তিনি তার পরিবারকে আমাদের বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন। ২৬ মাসের পর তিনি ঢাকা শহরকে নিরাপদ মনে করে পরিবারের সবাইকে আবার ঢাকায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আমাদের বাড়ি যাচ্ছেন। আমার এই ভগ্নিপতি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিল। তিনি ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা খয়েরউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে বলে এতটাই খুশি ছিলেন যে তিনি বাংলায় কথাই বলছিলেন না। বাগচিত করছিলেন আগাগোড়া উর্দুতেই। আমিও তাঁর সঙ্গে বাংলা-উর্দু মিশিয়ে জগাখিচুড়ি ভাসায় কথা বলছিলাম। বাসে উঠে আমার ভগ্নিপতি প্রবর বঙ্গবন্ধুকে অবিরাম গালাগাল করে চললেন। তিনি বলছিলেন, পাকিস্তান না থাকলে আমাদের হিন্দুদের গোলামি করতে হবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী হলো ওয়ার্ল্ডের বেস্ট ফাইটিং ফোর্স। তাদের সঙ্গে ব্যাটা মুজিব লাঠি নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে। এই যে এত লোক মারা গেছে সে জন্য শেখ মুজিবই দায়ী। সে সবাইকে খেপিয়ে তুলেছে। এখন ব্যাটা পাকিস্তানের করাগারে বন্দী। এবার ঠ্যালাটা বুঝুক! আমার ভগ্নিপতিকে আমি বললাম, আমরা হিন্দুদের গোলামী করব না। প্রয়োজনে পাকিস্তানী মুসলমানদের গোলামী করব। কথাটা বলেই নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম, এখন তাকে খ্যাপানো ঠিক হবে না। বরং ভাবলাম, এমন একজন ভগ্নিপতি সঙ্গে থাকায় ভালই হলো পাকবাহিনীর সঙ্গে মোলাকাত হলে তিনি ভালভাবেই সামলাতে পারবেন। গোপালপুর পৌঁছে দেখলাম। মা ভাই বোন সবাই ভাল আছে। গোপালপুরে একদিন থেকে স্বরূপকাঠির উদ্দেশে রওনা হলাম। বাড়ি থেকে চলে আসার আগে শুধু মায়ের কাছে বললাম, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য আমি স্বরূপকাঠি থেকে ঢাকা হয়ে ভারতে চলে যাব। মা আপত্তি না করে, আমাকে আশীর্বাদ করলেন। মায়ের এই আশীর্বাদ আমার কাছে অনেক মূল্যবান ছিল। যে কোন পীর দরবেশের চেয়ে আমার কাছে, আমার মায়ের স্থান ছিল অনেক ওপরে। ২৫ এপ্রিল খুব ভোরে, রওনা করে নৌকা এবং হাঁটা পথে স্বরূপকাঠি উপজেলার মুটিয়াকাটি গ্রামে পৌঁছেছিলাম বিকেল বেলায়। আমি আমাদের বাড়ি থেকে বরিশালগামী বাসে শিকারপুর এবং সেখান থেকে লঞ্চে স্বরূপকাঠি যেতে পারতাম সহজে। কিন্তু শিকারপুরে, দু’দিন আগে পাকিস্তান আর্মি ঘাঁটি করেছে। তাই ওই পথ পরিহার করতে হয়েছে। মুটিয়াকাঠি যাওয়ার পথে বানারিপাড়ায় আবার বেশ হেনস্থা পোহাতে হয়েছিল। সেখানেও কয়েকজন রাজাকার ধরনের যুবক আমাকে হিন্দু মনে করেছিল। বরিশাল জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে রাজাকারদের সংখ্যা ছিল বেশি, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। মুটিয়াকাঠিতে আমার মামা বাড়ি পৌঁছে দেখলাম, আমার স্ত্রী এবং আমার ছেলেও মেয়ে ভাল আছে। আমি মুটিয়াকাঠি পৌঁছাবার পরদিনই পাকবাহিনী গানবোটে চেপে এখানে আসে এবং এখানকার সন্ধ্যা নদীর দুই তীরের বেশিরভাগ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। শোনা যায়, আমার সম্পর্কে মামা পাকিস্তানী গানবোটের সামনে বোরকা পরে একা দাঁড়িয়ে কোন কোন এলাকা হিন্দু অধ্যুষিত তা পাক বাহিনীকে দেখিয়ে দিচ্ছিল। পাক বাহিনীর গানবোট স্বরূপকাঠি থানার কাছে এবং ইন্দুরহাটের কাছে অল্প সময়ের জন্য নোঙ্গর করেছিল। এমন জ্বালানো, পোড়ানো এবং হত্যাযজ্ঞের অভিযানের ভেতরেই শান্তি কমিটির লোকজন মাথায় টুপি চাপিয়ে, পাকিস্তানী পতাকা হাতে দলবেঁধে পাক বাহিনীকে অভ্যর্থনা জানাতে এতটুকু কার্পণ্য করেনি। মজার ব্যাপার হলো, যারা পাক বাহিনীকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল তাদের মধ্যে জনা দু’এক মাথায় টুপি পরা হিন্দুও ছিল। এই দু’জনের মধ্যে একজন ছিল নিমাই কর্মকার। ২৬ মার্চের পর সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। জনশ্রুতি আছে, বাংলাদেশের অনেক বড় মাপের একজন হিন্দু অর্থনীতিবিদ আছেন, যার পিতাও নাকি একাত্তর সালে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার পর স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করেন। ২৫ এপ্রিল বিকেল বেলা আমার বউ বলল, এখানে রাজাকারদের তৎপরতা খুব বেশি। তোমার পক্ষে এখানে বেশি দিন না থাকাই ভাল। এই কথার রেশ ধরেই ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা বউকে বললাম। সে নির্দ্বিধায় আমার এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করল। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে মন ততটা বিচলিত হয়নি। কিন্তু বউ-বাচ্চাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। মুটিয়াকাঠিতে অবস্থানকালে ২৭ বা ২৮ এপ্রিল মুটিয়াকাঠি বাজারে গেলাম। ওই বাজারে আমাদের বন্ধু শামসুল হকের সুন্দর একটি দোকান ছিল। সে এক সময় কয়েক বছর শর্ষিনার মাদ্রাসায় পড়েছে। পরে এসে মুটিয়াকাঠি হাই স্কুলে আমাদের সঙ্গে একই শ্রেণীতে ভর্তি হয়। মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়ার কারণে এবং বেশভূষার জন্য সবাই তাকে মওলানা বলে সম্বোধন করে। ২৮ এপ্রিল শামসুল হকের দোকানো আমরা তিন চার বন্ধু মিলে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। একদিন আগে শামসুল হক লঞ্চযোগে ঢাকা থেকে শিকারপুর হয়ে স্বরূপকাঠি এসেছিল। শিকারপুরে পাক আর্মি হিন্দুযাত্রীদের আলাদা করে এখানে আটকে রাখে। পরে পাক আর্মি হিন্দুযাত্রীদের নিয়ে কি করে তা জানা যায়নি। ছেলেদের সম্ভবত হত্যা করে এবং মেয়েদের জৈবিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য রেখে দেয়। শামসুল হক যেদিন ওই পথে আসছিল। সেদিন সব যাত্রীদের মধ্য থেকে হিন্দুযাত্রীদের বাছাই করার দায়িত্ব পাক আর্মি মওলানা শামসুল হককে দিয়েছিল। শামসুল হকের মুখে চাপদাড়ি এবং মাথায় টুপি দেখে পাক আর্মি বোধহয় তাকে এমন দায়িত্ব দিয়েছিল। আমরা বন্ধুরা শামসুল হককে প্রশ্ন করলাম, তুই কি করে হিন্দু আর মুসলমানদের আলাদা করে শনাক্ত করলি? ব্যাটা ছেলেদের বিশেষ অঙ্গের চিহ্ন দেখে না হয় আলাদা করা যায়। কিন্তু ২৬ মার্চের পর থেকে কোন হিন্দু মহিলা বিবাহিতা হলেও শাঁখা সিদুঁর পরে না। তাই মহিলাদের মধ্যে কে হিন্দু আর কে মুসলমান, তা তুই কেমন করে নির্ধারণ করলি? শামসুল বলল, দ্যাখ, হিন্দু মেয়েরা পেচ্ছাপ করে পানি ব্যবহার করে না। তাই তাদের শরীর থেকে পেচ্ছাপের গন্ধ আসে। আমি প্রশ্ন করলাম, তা হলে তুই প্রত্যেক মহিলার শরীরের গন্ধ শুকে দেখেছিস, কার শরীর থেকে আতরের খুশবু আর কার শরীর থেকে পেচ্ছাপের গন্ধ আসে? আমি আরও বললাম, আমার চরিত্র তো তেমন ভাল না। শামসুল বলল, দ্যাখ, হিন্দু মেয়েরা পেচ্ছাপ করে পানি ব্যবহার করে না। তাই তাদের শরীর থেকে পেচ্ছাপেরত গন্ধ আসে। আমার স্ত্রী ছাড়াও ভিন্নধর্মী দু-একজন মহিলার সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশেছি। দেখেছি, হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান সব মহিলার শরীর থেকে একই ধরনের সুবাস আসে। এটা মেয়েলি সুবাস, যা পুরুষের শরীর থেকে পাওয়া যায় না। আমি বললাম, শামসুল তোকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। তুই তো একজন ভ- মাওলানা। এবার শামসু বলল, দ্যাখ, তোদের সঙ্গে এতক্ষণ রসিকতা করছিলাম। জানিস তো শিকারপুর, রাজপুর, গোপালগঞ্জ হয়ে অনেক হিন্দু ভারতে যাচ্ছিল। আমাদের লঞ্চে ২৫-৩০ জন হিন্দু ভারতে যাচ্ছিল। তারা জানত না যে, শিকারপুরে পাক আর্মি ক্যাম্প রয়েছে। আমি অনেক ঝুঁকি নিয়ে বিশ-পঁচিশ জন হিন্দুকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। মাত্র চার পাঁচ জনকে একান্ত বাধ্য হয়ে পাক বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছি। এমনটা না করলে ওই বিশ- পঁচিশ জনকে বাঁচাতে পারতাম না। এবার বল, আমি কি খুব বড় একটা অন্যায় করেছি? শামসুল হক বলল, যাদের আমি বাঁচিয়েছি তার ভেতর একটি মেয়ে ছিল খুবই সুন্দরী। পরে লঞ্চে উঠে জানতে পেরেছিলাম, মেয়েটির নাম রাধিকা। মেয়েটির সঙ্গে ওর দুটি ভাইও ছিল। ভাগ্য ভাল পাক আর্মির ক্যাপ্টেনের নজরে পড়েনি রাধিকা। ও জওয়ান ভাই দুটিকে নিয়ে রাজাপুর লঞ্চঘাটে নেমে যাওয়ার আগে আমার পায়ের ধুলা নিয়ে গিয়েছিল। ৩০ এপ্রিল মুটিয়াকাঠি থেকে আমি ঢাকার পথে বরিশাল হয়ে যাত্রা করি। মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে আমি অনেকবার ভেবেছি। সব মাওলানা যদি মওলানা শামসুল হকের মতো হতো? শামসুল হকের কথা আমার আরও একটা কারণে মনে পড়ে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কি চার কলেমা মুখস্থ বলতে পারিস? বললাম, তা মুখস্থ করেছি। ও বলল : ওতে করে তেমন কাজ হবে না। এখন হিন্দুরাও চার কলেমা মুখস্থ বলতে পারে। জিজ্ঞেস করলাম তা হলে কি করতে হবে? ও বলল, এখন পাক আর্মির লোকরা পরীক্ষা করে দ্যাখে, হাতের কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত পশমের ডগা কোন্দিকে বিন্যস্ত? যারা পাঁচবেলা নামাজ পড়ার জন্য অজু করে, তাদের হাতের পশম থাকে কব্জি থেকে কনুই অভিমুখী। কারণটা আর কিছুই নয়। অজু করার সময় হাতে পানি নিয়ে কব্জি থেকে কনুই পর্যন্ত দিনের পর দিন হস্ত চালনা করতে হয় বলেই এমনটা হয়ে থাকে। যেমন যারা, মাথার চুল নিয়মিত ব্যাকব্রাশ করে, তাদের মাথার চুলের বিন্যাস হয় কপাল থেকে মাথার পেছন দিকে। আমি চিন্তা করে দেখলাম, কথাটায় যুক্তি আছে। আমি শামসুকে বললাম, দেখি তোর হাতের পশমের বিন্যাস কোন্ দিকে? দেখলাম, সত্যই ওর হাতে পশম কব্জি থেকে কনুই অভিমুখী। শামসুলকে বললাম, বল দেখি এবার কি করি? ও বলল, এখন সারাক্ষণ হাতের লোম কনুই অভিমুখী করার চেষ্টা কর। আমি মে মাসের নয় তারিখ ভারতে যাই। ২৮ এপ্রিল থেকে ভারতে যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত সারাক্ষণ হাতের লোমের গতি ফেরানোর জন্য সারাক্ষণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি।
×