ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবন্ধ ॥ ইতিহাসের শিক্ষা ও স্বাধীনতার পঞ্চাশৎবার্ষিকী -মফিদুল হক

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রবন্ধ ॥ ইতিহাসের শিক্ষা ও স্বাধীনতার পঞ্চাশৎবার্ষিকী  -মফিদুল হক

বিজয় দিবস আমাদের কাছে আসে উৎসবের আমেজ নিয়ে। মুক্ত স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠার এই ক্ষণটি নিঃসন্দেহে আনন্দের, নানাভাবে উদযাপনের। আবার বিজয় দিবসের প্রাক-ক্ষণটিতে আমরা পাই ১৪ ডিসেম্বর, বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস, গভীর বেদনা আবৃত দিন। ফলে যথার্থ অর্থেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস হয়ে আছে একই সঙ্গে আমাদের চরম দুঃসময়, আমাদের পরম সুসময়। উৎসবের আনন্দ-আয়োজনের সঙ্গে মিশে থাকে বেদনার পরশ, স্মরণ-করিয়ে দেয় আমাদের দায়বদ্ধতা, রক্তের ঋণ, শহীদের প্রতি অঙ্গীকার। আর এই সবকিছু ছাপিয়ে যে জিজ্ঞাসা বড় হয়ে ওঠে সেটা বাংলাদেশের আগামীর পথচলার প্রেরণা ও শক্তি, যার যোগানদাতা হতে পারে ইতিহাস এবং সে জন্যই জাতির অভ্যুদয়ের ঘটনাধারা আমাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৭ সালের বিজয় আয়োজনে সামনের দিকে তাকাবার বড় অবকাশ তৈরি করেছে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী, যা দুয়ারে এসে করাঘাত করছে। ২০২১ সালে বাঙালী জাতি উদ্যাপন করবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর, মুক্তির লড়াই ও তৎপরবর্তী পঞ্চাশ বছরের হিসাব-নিকাশ করাটা আমাদের জন্য যদি হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের পথে দৃঢ় অভিযাত্রার পাথেয়, তবেই তো উৎসব পেতে পারে সার্থকতা। আরও একভাবে ইতিহাসের খেলার অংশী হয়ে উঠছি আমরা, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপনের পূর্ববর্তী বছরটি আমরা উদ্যাপন করব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম-শতবার্ষিকী হিসেবে, স্বপ্নের স্বদেশ ও তার রূপকার, দুইয়ের মিলনের মধ্য দিয়ে উৎসব পাবে ইতিহাস-প্রদত্ত আরেক আনন্দময় মাত্রা। এই আয়োজন সার্থক করার লক্ষ্যে এখনই সূচিত হওয়া দরকার ইতিহাসের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত। রোড টু বাংলাদেশ যেন আমাদের জন্য হয়ে উঠতে পারে রোড টু দ্য ফিউচার। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বিশ্ব-মানবের মুক্তিপথ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে অসাম্প্রদায়িক জাতিচেতনায় উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠীর এই লড়াই ছিল বিভাজন ও বিদ্বেষের ধর্মান্ধ চেতনার বিরুদ্ধে মিলন ও সম্প্রীতির আহ্বান। নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে সমন্বয় গড়বার ক্ষেত্র ও উপাদান হিসেবে ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের যে শক্তি, যা কাউকে আঘাত করে না, বরং সবার সঙ্গে মিলনের ক্ষেত্র নির্মাণ করে সেটা প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশের আন্দোলনে। এই পথে এসেছে নানা বাধা, রাজনীতির হিসাব-নিকাশ আদর্শের জায়গাটিতে নানা ক্ষয় ঘটিয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিবেশ ক্রমে হয়ে উঠেছে সংঘাতপূর্ণ ও সহিংস, ধর্মসত্তাকে সর্বপ্লাবী করে এক ধর্মসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অপর ধর্মগোষ্ঠীকে দাঁড় করানো হচ্ছে অপরের অস্তিত্ব-বিনাশী সংহারক রূপে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গভীর সঙ্কটময় এহেন পরিবেষ্টনে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপনকালে তাই অনেক গভীর জিজ্ঞাসার মুখোমুখি আমাদের হতে হবে। সেসব জিজ্ঞাসা এড়িয়ে নিছক আনন্দ-আয়োজনে মেতে উঠতে চাইলে তা নিরোর বাঁশি বাজানোর মতোই হবে বেসুরো ও বেতালা, সারবস্তুহীন অলিক সুরবিহার। উৎসব আয়োজন তাই বড়ভাবে সূচিত হতে হবে ভাবরাজ্যে, ইতিহাসের বিচার-বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে আমরা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের গভীরতর তাৎপর্য এবং আগামীর জন্য এর গুরুত্ব বুঝতে পারগ হব না। সেদিকে দৃষ্টিপাত করলে উপমহাদেশের এবং তৃতীয় বিশ্বের পটভূমিকায়, বিশেষভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর বিশ্ব-বিন্যাসের নিরিখে বাংলাদেশের অভ্যুদয় বিচার না করে আমাদের উপায় থাকে না। কেননা বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিছক এক রাষ্ট্র ভেঙে আরেক রাষ্ট্রের উদ্ভব ছিল না। এ-ছিল উপনিবেশিক শাসকদের সৃষ্ট ও ফেলে-যাওয়া সভ্যতার ভগ্নস্তূপের ওপর মুক্তির বার্তাবহ নতুন উদার অভ্যুদয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সভ্যতার সঙ্কট’-এ হাহাকার ধ্বনির মধ্যেও প্রত্যাশার যে পরশ বয়ে এনেছিলেন বাংলাদেশ হয়েছিল সেই প্রতিশ্রুতির বাহক। উপমহাদেশের নিরিখে দেখলে ১৯৪৭-এর দেশভাগ মহাবিপর্যয় হিসেবে গণ্য হতে পারে। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা ও সংঘাত নিরসনে দেশভাগের রাজনৈতিক ফর্মুলা প্রয়োগে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও তা’ যথার্থ অর্থে জাতীয় ঐক্য ছিল না। রাজনৈতিক ডামাডোলে ছিল সাময়িক এক ধরনের সমঝোতা। নেতৃত্বের সেই সমঝোতাকে যখন রাষ্ট্রীয় রূপ দিয়ে স্বাধীনতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন সংঘাত পায় শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় ভিত্তি। ফলে স্বাধীনতা দাঙ্গা নিরসন করে না, বরং রক্তনদীকে রক্তসমুদ্রে রূপান্তর করে এবং জন্ম দেয় মানবেতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম উদ্বাস্তু সমস্যার যা পাঞ্জাবে ও বাংলায় লাখ লাখ মানুষকে শেকড় থেকে বলপূর্বক উৎপাটন করে পাঠিয়ে দেয় অজানা অচেনা আরেক ভূমিতে, যেখানে স্বধর্মের মানুষেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু যে-দেশ তার দেশ নয়। এই রক্তপাত হানাহানি ও দেশান্তরের প্রক্রিয়া যদি পার্টিশনের দিনগুলোর মধ্যে সমাপ্ত হতো তাহলেও হয়ত ফর্মুলার মাহাত্ম্য প্রমাণ পেত। কিন্তু দেশভাগ সাম্প্রদায়িকতা দ্বারা উপমহাদেশের শরীর স্থায়ীভাবে করে তুলল বিষাক্ত এবং এর হন্তারক ফলাফল অব্যাহতভাবে বয়ে বলল। উপমহাদেশ আর কখনই দেশভাগের পরিণাম থেকে মুক্ত হতে পারল না। সাতচল্লিশে বাংলা শান্ত ও অচঞ্চল রইলেও ১৯৫০ সালের দাঙ্গা রক্তাক্ত করে দিল বঙ্গভূমির জীবন, সীমান্তের এ-পার এবং ও-পারে, শুরু হলো ব্যাপক উদ্বাস্তু প্রবাহ। লিয়াকত-নেহরু চুক্তি পাঞ্জাবের মতো নিষ্ঠুর জনবিনিময় থেকে বাংলাকে রক্ষা করলেও উদ্বাস্তু হওয়ার প্রবণতা শীতল ও অন্তঃশীলাভাবে রইল অব্যাহত। ১৯৬৪ সালে আবার দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো উপমহাদেশজুড়ে হযরতবাল মসজিদের তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে। সেই দাঙ্গা পাকিস্তানকে হিন্দুশূন্য করে ফেলে সম্পূর্ণভাবে, পূর্ব পাকিস্তানেও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি হ্রাস পায় বিপুলভাবে। এর পরপর ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে রাষ্ট্রীয় সংঘাতের রূপ দেয়। যুদ্ধের অজুহাতে পাকিস্তান সরকার দেশের সকল হিন্দু নাগরিককে সম্পত্তির মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের অধস্তন নাগরিকে পরিণত করে। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পরিচালিত পাকিস্তান রাষ্ট্র ধর্মের নামে বাঙালীর অধিকার পদদলিত করেছিল এবং তারই বিপরীতে লড়াই করে প্রতিষ্ঠা পায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। উপমহাদেশের নেতিবাচক প্রবণতার বিপরীতে ইতিবাচক এক উদার অভ্যুদয়, যার তাৎপর্য ঐতিহাসিক। বিশ্ব শতকের রাষ্ট্রব্যবস্থায় বড় ধরনের দুই পরিবর্তন বয়ে এনেছিল প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজতন্ত্রের পতন ইউরোপে জন্ম দিয়েছিল জাতিভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। রুশ দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যার-শাসিত বিশাল ভূখণ্ডজুড়ে প্রতিষ্ঠা করে সমাজতান্ত্রিক শাসন। অটোমান-সাম্রাজ্যের পতন মধ্যপ্রাচ্যে উপনিবেশিক আধিপত্যে নতুন রাজ্যের পত্তন ঘটায়। এর ভেতরে যে দ্বন্দ্ব ও অসঙ্গতি ছিল তা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জন্ম দেয় এবং যুদ্ধশেষে ইউরোপের রাষ্ট্রব্যবস্থা পায় আরেক বিন্যাস, ঘটে অনেক নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাব। একই সঙ্গে ঘটে উপনিবেশিক শাসনে ফাটল এবং তৃতীয় বিশ্বের পদানত দেশসমূহ একে একে অর্জন করতে থাকে স্বাধীনতা। তবে উপনিবেশিক আওতাধীন দেশসমূহ স্বাধীনতা পেলেও অভ্যন্তরীণ নানা সঙ্কট সংঘাতে তারা ছিল দীর্ণ, সমস্যাকীর্ণ, যার অনেকটাই উপনিবেশবাদ সৃষ্ট। এমনি পটভূমিকায় কৃত্রিম ও কিম্ভূত রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয় পাকিস্তান, যার দুই অংশের মধ্যে ভৌগোলিক ব্যবধান হাজার মাইলের, আর সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক সামাজিক ব্যবধান তো আরও বিশাল। রাষ্ট্রের মধ্যে অসঙ্গতি যাই থাকুক, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব-ক্ষমতা বলয়ে এক ধরনের সমঝোতা ও ঐকমত্য গড়ে উঠেছিল যে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের সীমানা সবাই মান্য করে চলবে এবং এক রাষ্ট্র ভেঙে আরেক রাষ্ট্র গঠন তথা বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রশ্রয় দেয়া হবে না। ফলে সকল অসঙ্গতি সত্ত্বেও পাকিস্তানের ছিল বিশ্বজনীন স্বীকৃতি, আর তাই বাংলাদেশ আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে চিহ্নিত করতে তারা ছিল তৎপর এবং অনেকাংশে সফলও বটে। এমত সব বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী বাস্তবতায় জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের প্রথম স্বীকৃতি, পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যার বিস্তার আমরা লক্ষ্য করি। বাংলাদেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মিলনমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ জাতিরাষ্ট্রের যে উদাহরণ তৈরি করেছে সেখান থেকে অনেক শিক্ষা নেয়ার রয়েছে। আজকে পৃথিবীর বুকে বিভাজনের রেখা প্রবল হয়ে উঠছে ধর্ম অবলম্বন করে। অথচ সকল রাষ্ট্রেই দেখা মেলে বহু ধর্মের, বহু জাতিসত্তার। মানবিক সমাজ ও বিশ্ব গড়ে তোলার পথে ধর্মান্ধতা সহিংস ও ধ্বংসাত্মক রূপ নিচ্ছে। অন্যদিকে একক বিশ্বে শক্তিশালী কর্পোরেট ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বহু দেশের অভ্যন্তরীণ বিন্যাস ও বাতাবরণ ধ্বংস করে দিচ্ছে সন্ত্রাস-দমন কিংবা এমত অন্য অজুহাতে, প্রতিষ্ঠিত করছে দেশের সম্পদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ। মুনাফার পেছনে ছোটা বাজার-ব্যবস্থা বিশ্বজনীন সঙ্কট তৈরি করছে যেমন রাজনৈতিকভাবে, তেমনি সামাজিকভাবে। জটিল কঠিন এই সময়ে মানবিক সমাজ ও সৌহার্দ্যরে শক্তি জোরদার করা ব্যতীত আর কোন পথ নেই। সেই পথের ইশারা মেলে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মৌল আদর্শে, মুক্তির যে-আদর্শের জন্য আত্মদান করেছিল বিপুলসংখ্যক মানুষ। বাংলাদেশের ইতিহাসের শিক্ষা ধারণ করে তাই আমরা এগিয়ে যেতে পারি সামনের দিকে।
×