ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খোদ নিজামীর নির্দেশে তাকে ধরে নিয়ে যায় আলবদররা

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

খোদ নিজামীর নির্দেশে তাকে ধরে নিয়ে যায় আলবদররা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ তিনি ছিলেন বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ। রাজনৈতিক কর্মী। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। এক কথায় বললে একেবারেই প্রগতিশীল মানুষ। মুক্তচিন্তা জুড়ে ছিল দেশপ্রেম, মানুষ আর মানবতা। ছিলেন ভাষা সৈনিক। বাঙালীর স্বাধিকার ও স্বাধীনতার প্রয়োজনে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। এজন্য তাকে জেলও খাটতে হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী (আলবদর বাহিনী) অপশক্তি পাকিস্তানী হানাদারদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে তাকে বাঁচতে দেয়নি। বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে ঢাকার পুরানা পল্টনের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মুক্তমনা মানুষটিকে। এরপর এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। বলছি শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরীর কথা। একাত্তরে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তানের পিএমএ থেকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য ঢাকাকে নয়টি জোনে ভাগ করা হয়েছিল। এর দায়িত্বে ছিলেন ডাঃ আলীম চৌধুরী। ভারত সীমান্তে যে ক্যাম্পগুলো ছিল সেখানে ওষুধ সরবরাহ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেয়া; শুধু তা নয়, নকল ব্যান্ডেজ বেঁধে মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন। তথ্যের আদান-প্রদান হতো। ওষুধের আদান-প্রদান হতো। রাত জেগে আলীম চৌধুরীর সহধর্মিণী টর্চ ধরে রাখতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন তিনি, অর্থের যোগান দিতেন। অথচ কুলাঙ্গারদের হাতে নির্মমভাবে জীবন দিতে হলো দেশপ্রেমিক মানুষটিকে। এক নজরে ॥ পুরো নাম আবুল ফয়েজ মোহাম্মদ আবদুল আলীম চৌধুরী। বাংলাপিডিয়া রয়েছে, ১৯২৮ সালের তিন বৈশাখ কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে তাঁর জন্ম। ১৯৪৫ সালে কিশোরগঞ্জ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৮ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী এবং ১৯৬১ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স এ্যান্ড সার্জনস থেকে ডিপ্লোমা ইন অপথালমোলজি ডিগ্রী লাভ করেন। লন্ডনের সেন্ট জেমস ও হুইপস ক্রস হাসপাতালের রেজিস্ট্রার হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি মীর্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালের প্রধান চক্ষু চিকিৎসক, ঢাকা মেডিক্যাল, রাজশাহী মেডিক্যাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যালসহ বিভিন্ন হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ ছিলেন ডাঃ আবদুল আলীম। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর ধর্মঘট সফল করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে শহীদ দিবসে পতাকা উত্তোলনের কারণে কারারুদ্ধ হন তিনি। ১৯৫৪-৫৫ সালে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ছিলেন। ছিলেন পাকিস্তান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার যুগ্ম সম্পাদক। একজন লেখক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি ছিল যথেষ্ট। মাসিক পত্রিকা ‘খাপছাড়া’, ‘যান্ত্রিক’ এর সম্পাদক ছিলেন তিনি। সংবাদপত্রেও নিয়মিত লিখতেন। নিজামীর নির্দেশে আলীম চৌধুরীকে ধরে নেয়া হয় ॥ জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জবানবন্দী দেন তাঁর স্ত্রী শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। জবানবন্দীতে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে নিজামীর নির্দেশে তাঁর স্বামী শহীদ ডাঃ আবদুল আলীম চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর সদস্যরা। তিন দিন পর রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১৩তম সাক্ষী ছিলেন। জবানবন্দীতে শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, তাঁর পেশা শিক্ষকতা। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ও পরে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে এমএড ডিগ্রী অর্জন করেন। একাত্তরে তিনি স্বামী, মা-বাবা, ভাইবোনসহ ঢাকার ২৯/১ পুরানা পল্টনের তিনতলা বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। তাঁর স্বামী চক্ষু বিশেষজ্ঞ আলীম চৌধুরী পিজি হাসপাতাল (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়), ঢাকা মেডিক্যাল, রাজশাহী মেডিক্যাল ও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কাজ করেন...। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ ॥ জবানবন্দীতে শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন বলেন, আলীম চৌধুরী প্রগতিশীল ও বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বায়ান্নর ভাষাসৈনিক, ১৯৫৪ সালে শহীদ মিনারে পতাকা উত্তোলনের সময় গ্রেফতার হন। তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় তাঁকে তৎকালীন সরকারের অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। এ জন্য তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানেও তিনি সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি লন্ডনে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা। পরে দেশে ফিরে তিনি আবার বাঙালী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেন। পুরানা পল্টনের বাসায় তাঁর চেম্বারটি ছিল সামাজিক-রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর মিলনকেন্দ্র। ওই চেম্বার থেকে উপার্জিত অর্থের অর্ধেকের বেশি তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ে ব্যয় করতেন। একাত্তরের ২৫ মার্চের পর তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিভিন্ন কাজ করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে তাঁদের পৌঁছে দিতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি গোপন হাসপাতাল ছিল, যেখানে তিনি ও ডাঃ ফজলে রাব্বী গিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতেন। শ্যামলী নাসরিন বলেন, একাত্তরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমাদের পুরানা পল্টনের বাসায় এক ব্যক্তি আসেন, পরে জানলাম তাঁর নাম মাওলানা আবদুল মান্নান। আমরা তাঁকে চিনতাম না বলে আশ্রয় দিতে চাইনি। তখন আমাদের প্রতিবেশী পিডিপির (পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি) মতিন অনেক অনুরোধ করে বললেন, মাওলানা মান্নানের বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে, তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে একেবারে পথে বসেছেন। তাঁকে দুই-তিন দিন আশ্রয় দেন। পরে আমরা তাঁকে আশ্রয় দিই। রাষ্ট্রপক্ষের এই সাক্ষী বলেন, কয়েক দিনের মধ্যে তাঁরা দেখেন, মাওলানা মান্নানের ঘর আসবাবে ভরে গেছে, পাকিস্তানী সেনারা সেখানে যাতায়াত শুরু করেছে। একপর্যায়ে জানতে পারেন, মাওলানা মান্নান বাড়িওয়ালার সঙ্গে যোগাযোগ করে বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিয়েছেন। কয়েক দিন পর দেখেন, ছাই রঙের প্যান্ট ও নীল শার্ট পরা কয়েক যুবক অস্ত্র হাতে তাঁদের বাড়ির চারদিকে পাহারা দিচ্ছে। তাঁর স্বামী ওই যুবকদের পরিচয় জানতে চাইলে মাওলানা মান্নান জানান, তারা আলবদর বাহিনীর সদস্য ও তিনি আলবদরের সংগঠক। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে (মাওলানা মান্নান) মেরে ফেলতে পারে এজন্য পাহারা বসানো হয়েছে। শ্যামলী নাসরিন বলেন, তাঁরা জানতে পারেন, মূলত ইসলামী ছাত্রসংঘের (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন) সদস্যরাই আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। আলবদরের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ পাকিস্তানী সেনাদের সব অপকর্মের সহযোগী ছিল আলবদর বাহিনী। তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে চোখ বেঁধে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা ইনস্টিটিউটে ধরে নিয়ে যেত। সেখানে আলবদরের হাইকমান্ডের নির্দেশে তাঁদের নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। এ খবর রেডিও, পত্রিকা, লিফলেট, মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর স্বামীর কাছে তিনি শুনেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ট্রাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় অনেক লোককে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছেন। ‘কাপড়টা পাল্টে আসি’ ॥ শ্যামলী নাসরিন বলেন, একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তিনি, তাঁর মা ও স্বামী দোতলার বারান্দায় বসেছিলেন। এ সময় ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকা শহরে বোমাবর্ষণ করছিল। তখন একটি কাদালেপা মাইক্রোবাস মাওলানা মান্নানের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আনুমানিক ৩০ মিনিট পর তাঁদের বাসার উত্তর দিকের দরজায় প্রচ- শব্দ হতে থাকে এবং দরজা খুলতে বলা হয়। তিনি জানালা থেকে দেখতে পান, অস্ত্র হাতে তিন আলবদর দরজায় লাথি মারছে। স্বামীর কথামতো তাঁর চেম্বারের দুই সহকারী হাকিম ও মমিন দরজা খুলতে যায়। শ্যামলী নাসরিন বলেন, আলবদর সদস্যরা ভেতরে ঢুকেই বলে ‘হ্যান্ডস আপ।’ আমার স্বামী বলেন, কী ব্যাপার? আলবদরদের একজন বলল, আমাদের সঙ্গে গেলেই জানতে পারবেন, এটা আলবদরের হাইকমান্ড মতিউর রহমান নিজামীর নির্দেশ। আমার স্বামী তখন বললেন, ‘কাপড়টা পাল্টে আসি।’ ওরা বলল, তার আর দরকার হবে না। এরপর তারা আমার স্বামীর চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর পাওয়া গেল তাঁর লাশ ॥ স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি মাওলানা মান্নানের কাছে গিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে আনার জন্য অনেক অনুরোধ করেন। মাওলানা মান্নান তাঁকে জানান, আলবদর হাইকমান্ডের নির্দেশে তাঁর স্বামীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ডাঃ ফজলে রাব্বীকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁদের নেয়া হচ্ছে চিকিৎসা করানোর জন্য। কাজ শেষ হলে ফিরিয়ে দেয়া হবে। ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর লাশের পাশ থেকে তাঁর স্বামীর লাশ উদ্ধার করে আনা হয়। তাঁর হাত পিছমোড়া করে ও চোখ বাঁধা ছিল, সারা শরীরে অসংখ্য বেয়নেটের আঘাত, গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। ‘বুকের ভেতরে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন ছিল’ ॥ গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার ও প্রকাশিত লেখায় শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ আবদুল আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডাঃ নুজহাত চৌধুরী বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন আমি খুবই ছোট। তেমন কিছু মনে নেই। আমার সঙ্গে আমার বাবার কোন ছবি নেই। আমার কাছে বাবা মানেই বাবা। বিকল্প কিছু হতে পারে না। আমি নিজেও দু’ বাচ্চার মা। মানুষ যখন বাবার কথা বলে তখন বুকের ভেতরে শূন্যতা বাড়ে। জাতীয় পতাকার লাল বৃত্তে বাবার রক্ত লেগে আছে। বাবাকে খুঁজি প্রিয় পতাকায়, মানুষের ভিড়ে, বিজয় মিছিলে। কিন্তু বাবা আর ফিরে আসে না। তিনি বলেন, আমার বাবা খুবই মেধাবী ছিলেন। এদেশের বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য বুদ্বিজীবীরা আন্দোলন করেছেন। যে কারণে দিনের পর দিন আন্দোলন ক্রমাগতভাবে বেগবান হয়েছিল। সেই আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন আমার বাবা। সেই আন্দোলনের বেশিরভাগই ছিলেন আওয়ামী লীগার। সেজন্যে তিনি খুব চিহ্নিত ব্যক্তি ছিলেন। ’৭১ এ উনি যেহেতু সরব ছিলেন সেজন্য অনেক ভীতু লোকও সেসময় আলীম চৌধুরীর গাড়িটা দেখলে গেট বন্ধ করে দিতেন। আলিম চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে এটা যদি প্রকাশ পায়, যদি ওদের সমস্যা হয়। উনি তেমন চিহ্নিত ব্যক্তি ছিলেন। আগস্টের শেষের দিকে আমাদের বাসায় পিডিবির মতিন এক লোককে নিয়ে আসলেন। তিনি হলেন মাওলানা মান্নান। যিনি ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি মূলত বাবাকে হত্যা করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, বিজয়ের আগের দিন রাতে আমাদের দরজা নক করেন। বন্দুকধারী ক’জন এসে বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। আমার মা বাবাকে ফেরত চাইলে তিনি বলেন, তিনি ফিরে আসবেন। হয়ত যুদ্ধে কেউ আহত হয়েছেন সেজন্য তাকে নিয়ে গেছেন। সেসময় তিনি নিজেকে আলবদর বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন। পাকিস্তানীরা তো আর বুদ্বিজীবীদের চিনত না, এরাই চিনিয়েছে। এরপর আমার চাচা ও মা মিলে শহরের সবখানে বাবাকে খুঁজে ফিরলেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। চারদিকে বিজয়ের আনন্দে মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে এলো। হাতে পতাকা নিয়ে মিছিল হলো। কিন্তু বিজয়ের আনন্দে নিজেদের শামিল করতে পারেনি আমার পরিবার। আমার চাচা মিছিলের মধ্যে বাবাকে খুঁজেছেন। তারপর ১৮ তারিখ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় বাবার লাশ খুঁেেজ পাওয়া গেল। পাকিস্তানীদের নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে তাদের এ দেশীয় দোসররা এদেশকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্বিজীবীদের হত্যার নেশায় মেতে ওঠে। এতে নেতৃত্ব দেয় রাজাকার, আল বদর, আল শামসসহ শান্তিবাহিনীর লোকজন। এই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্বাধীন বাংলাদেশ চাওয়ার অপরাধে বিজয়ের সূর্য উদিত হওয়ার আগে ১৪ ডিসেম্বর চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়। সারারাত নির্মম নির্যাতনের পরে যখন পূর্বের আকাশে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হচ্ছে তখন বাবাকে ওরা বেয়নেট চার্জ করে। ওরা ব্রাশ করে বুকটা ঝাঁঝরা করে দেয়। আমি আমার বাবার বুকে ঘুমাতাম। যে বুকের উপরে ঘুমাতাম সেই বুকের ভেতরে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন ছিল। ওরা সেই বুকে বেয়নেট চার্জ করেছে। ব্রাশ করে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। আর আমার বুকে চিরদিনের জন্যে শূন্যতা ভরে দিল। এই শূন্যতা কতটুকু তা আমি জানি। যারা ’৭১ এ স্বজন হারিয়েছেন তারাই ভাল বলতে পারবেন এই বেদনা কতদূর। কি ভীষণ বেদনা বয়ে চলি। আমার এত বয়স হয়ে গেল। অথচ,এই বেদনার অশ্রু আজও থামাতে পারলাম না।
×