ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সম্প্রসারণে দ্রুততার তাগিদ

অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে হিমশিম চট্টগ্রাম বন্দর

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭

অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে হিমশিম চট্টগ্রাম বন্দর

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশের অর্থনীতি ও ক্রমবর্ধমান আমদানি রফতানির সঙ্গে পাল্লা দিতে হিমশিম অবস্থা চট্টগ্রাম বন্দরের। প্রতিবছরই কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতায় উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও আরও সক্ষমতা প্রয়োজন এ বন্দরের। কিন্তু উন্নয়ন ঘটাতে অসংখ্য পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়নের গতি বেশ ধীর বলে অভিযোগ বন্দর ব্যবহারকারীদের। কর্মসংস্থান এবং উৎপাদন ও রফতানি বাড়াতে দেশে ১শটি ইকোনমিক জোন গড়ার পরিকল্পনা দৃশ্যমান হতে থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান ক্ষমতা দিয়ে ভবিষ্যতে কতটা সেবা প্রদান সম্ভব হবে সে প্রশ্ন উঠে আসছে ঘুরেফিরে। এ অবস্থায় চলতি বছরের মধ্যেই বেশকিছু বড় প্রকল্প দৃশ্যমান করতে চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, দেশের অর্থনীতির গতির সঙ্গে তাল মেলাতে বন্দরের সক্ষমতাও বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে সরকার। অনেক দিন ঝুলে থাকা বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি সঞ্চার হচ্ছে। নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি) যন্ত্রসজ্জিত করা হচ্ছে নতুন নতুন ইক্যুইপমেন্টস আমদানির মধ্য দিয়ে। সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ৬টি রাবার টায়ার গ্র্যান্ট্রি ক্রেন। এছাড়া নতুন নতুন জেটি নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ লাভ করছে। সাগর পাড়ে বে-টার্মিনাল নির্মিত হয়ে গেলে সেটি হবে আগামীর বন্দর। দেশে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার এই টার্মিনাল বাস্তবায়নে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। সে প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বাস্তবায়নাধীন বে-টার্মিনাল নিয়ে অনেক স্বপ্ন এদেশের ব্যবসায়ী এবং শিল্পোদ্যোক্তাদেরও। মীরসরাইয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক জোন। এছাড়া আনোয়ারাসহ অন্তত দশটি ইকোনমিক জোন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। আর এসস জোনে গড়ে ওঠা শিল্পের কাঁচামাল আমদানি এবং উৎপাদিত পণ্য রফতানির জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান সক্ষমতাকে যথেষ্ট মনে করছেন না ব্যবসায়ী নেতারা। শুধু এ বন্দরের উন্নয়নই নয়, পাশাপাশি নতুন বন্দর সৃষ্টির গুরুত্বও তুলে ধরছেন তারা। তবে চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বে-টার্মিনাল বাস্তবায়িত হয়ে গেলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে। কেননা, এই টার্মিনালের একক সক্ষমতাই হবে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে অনেক বেশি। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ৯০৭ একর ভূমিতে নির্মিত হবে বে-টার্মিনাল। এতে একসঙ্গে বার্থিং নিতে পারবে ৩০ থেকে ৩৫টি জাহাজ। অথচ, বর্তমান বিদ্যমান সুবিধায় বার্থিং নিতে পারে ১১টি জাহাজ। তাছাড়া অনেক বড় জাহাজ ভেড়ানো যাবে বে-টার্মিনালে। টার্মিনালটি নির্মিত হলে বর্তমান বন্দরের ওপর চাপ অনেকটাই কমে আসবে। সেখানে ভেড়ানো যাবে ১০ থেকে ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজও। কিন্তু বর্তমান বন্দরে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। ৫ হাজার টিইইউএস কন্টেনার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ হ্যান্ডলিং করা যাবে বে-টার্মিনালে। কিন্তু বর্তমান সুবিধায় সর্বোচ্চ ১৮শ কন্টেনারের জাহাজ হ্যান্ডলিং করা যায়। নতুন এই বন্দর জোয়ার ভাটা নির্ভর থাকবে না। যে কোন সময় জাহাজ ভিড়তে পারবে, নাইট নেভিগেশনেও সমস্যা থাকবে না। ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদনসহ প্রাথমিক অনেক কাজ সম্পন্ন হয়ে যাওয়ায় বড় এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আর কোন অনিশ্চয়তা নেই। দেশের অর্থনীতি এবং আমদানি রফতানির স্বার্থে এ টার্মিনাল নির্মিত হবেই। চট্টগ্রাম বন্দর-পতেঙ্গা আসনের সংসদ সদস্য এমএ লতিফ সামগ্রিক বিষয়ে বলেন, বিদ্যমান সক্ষমতায় চট্টগ্রাম বন্দর ২৩ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করছে। সে দৃষ্টিতে বন্দরকে মোটেও অদক্ষ বলা যাবে না। তবে বন্দরের সম্প্রসারণ যতটা হওয়ার প্রয়োজন ছিল ততটা হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বন্দরে জেটি ছিল ১৩টি। এতদিনে অন্তত ৫০টি জেটি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু জেটি বেড়েছে মাত্র ৬টি। দেশের অর্থনীতি এবং শিল্প স্থাপন বাড়ছে। ফলে আমদানি রফতানিকে সার্ভিস দিতে বন্দরের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার বে-টার্মিনাল। সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিক রয়েছে বলে জানান এই জনপ্রতিনিধি। এদিকে প্রায় ৬শ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এনসিটিকে কার্যকর করতে সংগৃহীত হচ্ছে যন্ত্রপাতি। অনুমোদিত হওয়ার পরও দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল যন্ত্রপাতি সংগ্রহের কাজ। এনসিটির জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের চাহিদা ছিল ৬১টি যন্ত্রপাতি। চলতি বছরের জুলাই মাসে বন্দরে আসে ৩টি আরটিজি। চলতি মাসের শুরুতে চীন থেকে আরও ৪টি এবং গত ১১ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসে টিজিপিসি ব্র্যান্ডের ২টি আরটিজি। আগামী বছরের জুনে বন্দরে আরও ২টি আরটিজি আসবে বলে জানিয়েছেন বন্দরের অপারেশনাল বিভাগের কর্মকর্তারা। পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সকল যন্ত্রপাতিই কেনা হবে বলে জানিয়ে বন্দরের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক কর্মকা- বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্দরের সক্ষমতাও বৃদ্ধির ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। এখন থেকে আর কোন দীর্ঘসূত্রতা হবে না। প্রসঙ্গত, গত ১০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে অনেক সমস্যার কথা তুলে ধরেন জনপ্রতিনিধি এবং ব্যবসায়ী নেতারা। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ফজলে করিম চৌধুরী এমপি, এমএ লতিফ এমপি, শামসুল হক চৌধুরী এমপি, বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল। সেখানে বন্দর ব্যবহারকারীরা প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির অভিযোগ এনে বলেন, অনেক পরিকল্পনাই রয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই। তাদের অভিমত, এত বেশি পরিকল্পনা না নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কম পরিকল্পনা নিয়ে সেগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়া উচিত। বিশেষ করে অর্থনৈতিক কর্মকা- যেহারে বাড়ছে তাতে করে বর্তমান বন্দর দিয়ে সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে কিনা তারা শঙ্কা প্রকাশ করেন। তবে নৌপরিবহনমন্ত্রী সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নে আন্তরিকতার কথাই ব্যক্ত করেন।
×