ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে স্বস্তি পরিষদে গুতেরেসের ৫ সুপারিশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে স্বস্তি পরিষদে গুতেরেসের ৫ সুপারিশ

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস। মঙ্গলবার নিউইয়র্কে নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে মহাসচিবের পক্ষে এসব সুপারিশ উপস্থাপন করেন জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জেফ্রি ফেল্টম্যান। এদিকে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। গত ৬ নবেম্বর মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্ট গ্রহণ করে ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে বিবৃতি দিতে জাতিসংঘ মহাসচিবকে অনুরোধ জানিয়েছিল নিরাপত্তা পরিষদ। মঙ্গলবারের বৈঠকে মহাসচিবের সেই বিবৃতি তুলে ধরতে গিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে ওই পাঁচ সুপারিশ উপস্থাপন করা হয় বলে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের দেয়া সুপারিশগুলো হলো- কোফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনকে ভিত্তি ধরে শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ীভাবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা, বাস্তুচ্যুতদের মূল ভূমিতে বা পছন্দনীয় কাছাকাছি কোন স্থানে প্রত্যাবাসন করা, জীবন ধারণের মৌলিক সব প্রয়োজন মেটাতে অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, প্রত্যাবাসনের যোগ্যতার ক্ষেত্রে উদার মানদ- নির্ধারণ এবং সকল প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো। নিরাপত্তা পরিষদের ডিসেম্বর মাসের সভাপতি জাপানের সভাপতিত্বে এ সভায় পরিষদের সদস্য দেশগুলোর বাইরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকেও বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হয়। বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, এখনও প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ৪০০ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এতে প্রতীয়মান হয়, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গত ২৩ নবেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত সম্মতিপত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, ওই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী শীঘ্রই যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে এবং মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে। কিন্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক দুর্দশার যে মূল কারণ, তা দূর করতে এ সংক্রান্ত বহুবিধ বিষয় ও অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো মিয়ানমারকেই সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সহাযোগিতা ও পর্যবেক্ষণ একান্তভাবে প্রয়োজন, আর তা করতে হবে অসহায় রোহিঙ্গাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। রাষ্ট্রদূত মোমেন তার বক্তব্যে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত অসহায় নাগরিকদের মানবিক সহায়তা দেয়া, সহিংসতার নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন তদন্ত ও বিচার, রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে একত্রে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের পাশাপাশি অন্যের মধ্যে বৈঠকে বক্তৃতা করেন সংঘাতময় এলাকায় যৌন সহিংসতা বিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমীলা প্যাটেন। সাম্প্রতিক সফরে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলোয় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ওপর রাখাইনে যে ভয়াবহ যৌন সহিংসতা হয়েছে, নির্যাতিত নারী ও শিশুদের কাছ থেকে শোনা সেই নির্যাতনের বর্ণনা তিনি বৈঠকে তুলে ধরেন। প্রমীলা প্যাটেন বলেন, যারা এখনও যৌন সহিংসতার ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন এবং যারা নিষ্ঠুরতম এই যৌন সহিংসতার দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছেন, তাদের সকলেই আমাকে বলেছেন, নারকীয়ভাবে মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং সেনা ক্যাম্পে আটক রেখে দিনের পর দিন যৌনদাসত্বে বাধ্য করার মত জঘন্য কাজ করেছে। তিনি সহিংসতার শিকার এমন অনেক নারীর উদাহরণ দেন, যাদের কেউ কেউ টানা ৪৫ দিন সেনা ক্যাম্পে ধারাবাহিক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্যাটেন জানান, অনেক মেয়েকে তার স্বামী অথবা বাবার সামনে নগ্ন করে ধর্ষণ করা হয়েছে। অনেক মায়ের সন্তানদের গ্রামের জলকূপে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। শিশুকে কেড়ে নিয়ে শিশুর সামনে মাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, ধর্ষণ শেষে শিশুটিকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এমনই সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা জানিয়ে প্যাটেন দ্রুততম সময়ে এই সহিংসতার সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদকে সর্বক্ষমতা প্রয়োগের আহ্বান জানান। নিরপত্তা পরিষদের বৈঠকে সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। তারা রোহিঙ্গাদের অব্যাহতভাবে মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের ভূয়সী প্রশংসা করেন। প্রতিবারের মতো বিশ্ব সম্প্রদায়কে মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির সাফল্য কামনা করেন। বৈঠকে উপস্থিত সকলেই জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমীলা প্যাটেনের মর্মস্পর্শী বর্ণনা মনোযোগসহকারে শোনেন। একই সঙ্গে মিয়ানমার সঙ্কটের সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। গত ১৬ নবেম্বর মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটি উন্মুক্ত ভোটের মাধ্যমে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। থার্ড কমিটির ওই প্রস্তাব শীঘ্রই সাধারণ পরিষদের প্লেনারিতে উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। এছাড়া গত ৫ ডিসেম্বর জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলে মিয়ানমারের মানবিক পরিস্থিতির উপর একটি বিশেষ বৈঠক হয়। সেখানেও এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল।
×