ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে উভয় সঙ্কটে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে উভয় সঙ্কটে বাংলাদেশ

তৌহিদুর রহমান ॥ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এখন উভয় সঙ্কটে পড়েছে বাংলাদেশ। রাখাইনে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিরোধিতা করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। সে কারণে বাংলাদেশ দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইলেও তা সম্ভব নয়। মিয়ানমার সরকার থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্র হতে পারে। তবে এসব সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরাতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সরকার। সূত্র জানায়, রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ তৈরি না করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিপক্ষে মত দিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির শরণার্থী বিষয়ক ডেপুটি হাইকমিশনার কেলি ক্লেমেন্টস বলেছেন, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নেই। সেখানে প্রথমে নিরাপত্তা পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তারপরেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা প্রয়োজন বলেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের জোর করে মিয়ানমারে পাঠানো যাবে না। যখন তারা নিরাপদ বোধ করবেন, কেউ যখন তাদের জোর করে কোথাও যেতে বাধ্য করবে না, কেবল তখনই তারা নিজের দেশে ফিরে যাবেন। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাখাইনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ নিরসনে এখনও কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে মানবিক সংস্থাগুলোর প্রবেশাধিকার সীমিত। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের আগে এসব বিষয় সমাধান হওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও মানসিক আঘাতের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা এখনও বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন। এসব শরণার্থীদের অনেকেই পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছেন। তাদের অনেকেরই বাড়িঘর ও গ্রাম ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তাই তাদের ফিরে যাওয়ার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সূত্র জানায়, গত ২৫ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে এসেছেন। এখনও রোহিঙ্গাদের আসা অব্যাহত রয়েছে। দীর্ঘসময় ধরে রোহিঙ্গা নাগরিকদের এই বিশাল বোঝা বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। সে কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায়। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি অনুযায়ী আগামী দেড় মাসের মধ্যেই রোহিঙ্গা ফেরত প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। সে অনুযায়ীই বাংলাদেশ সরকার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে এখন বলা হচ্ছে, মিয়ানমারের রাখাইনে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরির পরেই রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠাতে হবে। কবে নাগাদ সেখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। সে কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঝুলে যেতেও পারে। রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব মিয়ানমার সরকারের। সেখানে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে আসছে। তবে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা নাগরিকদের আসা অব্যাহত থাকায় সেখানে নিরাপদ পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেননা সেখানে নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হলে রোহিঙ্গাদের আসা বন্ধ হয়ে যেত। এ ছাড়া রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ তৈরির আগ্রহ মিয়ানমার সরকারের আদৌ রয়েছে কি-না সেটা নিয়েও অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে অনেকেরই কোন ঘরবাড়ি নেই। থাকার জায়গা নেই। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যও নেই। সে কারণে সেখানে সাময়িক আবাসস্থল তৈরির জন্যও বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সহযোগিতা চেয়েছে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের কাছে এ বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য আবাস্থল তৈরিতে চীন ও ভারতের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সেখানে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো তৈরিতে ওই দুইটি দেশই সহযোগিতা করবে বলেও বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, রাখাইনে রোহিঙ্গারা ফিরে গিয়ে কোথায় থাকবেন। সেটা নিয়েও আমরা চিন্তা করছি। নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি সেখানে আবাসস্থলও তৈরি করতে হবে। এই আবাসস্থল তৈরির জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলেও জানান তিনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ তৈরি না করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। নিরাপদ পরিবেশ তৈরি না হলে রোহিঙ্গারাও সেখানে যেতে আগ্রহী হবে না। এ ছাড়া জোর করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোও সম্ভব নয়। সে কারণে রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গেও তারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৯ অক্টোবর সেনা অভিযানের মুখে ৮৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
×