ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তরুণদের উজ্জীবিত করতে হবে ॥ মঞ্জুলা দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১২ ডিসেম্বর ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তরুণদের উজ্জীবিত করতে হবে ॥ মঞ্জুলা দাশগুপ্ত

বয়স এখন ৭৮। বার্ধক্য মনের তারুণ্যকে হার মানাতে পারেনি। এখনও স্বপ্ন দেখেন সুন্দর, সুখী, সমৃদ্ধশালী একটি দেশের। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক মঞ্জুলা দাশগুপ্ত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসী কণ্ঠ দিয়ে উদ্দীপ্ত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের, সংগঠিত করেছিলেন লক্ষ লক্ষ স্মরণার্থীসহ সাধারণ মানুষদের। বিজয়ের মাসের ঘটনাবলী নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। আপনার দেখা মুক্তিযুদ্ধ... মঞ্জুলা দাশগুপ্ত : আমরা ঢাকার বড় মগবাজারের একটি দোতলা বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। আমার স্বামী মৃন্ময় দাশগুপ্ত আগারগাঁওয়ে সরকারী মিউজিক কলেজে রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের লেকচারার ছিলেন। ২৫ মার্চ, রাতে প্রচ- রকমের কিছু হতে যাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম। পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতিহত করার জন্য পাড়ার ছেলেদের ছোটাছুটি দেখতে পেলাম। চারিদিকে অন্ধকার, মাঝে মাঝে গুলির আওয়াজ। শুনলাম রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করেছে পাক সেনারা। আমার ছেলেটি খুলনায় আমার স্বামীর কাছে ছিল। সারারাত বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আমাদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর ভাটপাড়ার উদ্দেশ্যে ২৭ তারিখ রওনা হলাম। কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও নৌকায় পৌঁছলাম সেখানে। দিনে পাক সেনাদের অত্যাচার, রাতে ডাকাতির কারণে গ্রামেও থাকতে পারছিলাম না। জুন মাসের মাঝামাঝি আগরতলা পৌঁছলাম। যাওযার পথে দেখলাম অসংখ্য লোক যাচ্ছে, নদীতে হাজার হাজার নৌকা। একটি নৌকা থেকে ছোট্ট একটি শিশুর কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম, কিচুক্ষণ পর আর শুনতে পেলাম না। ওপার গিয়ে একজন মহিলার কান্নায় সেখানে এগিয়ে শুনলাম তার বাচ্চাটি কানছিল বলেই তাকে মুখ চেপে ধরেছিল, সে কারণেই সে মারা যায়। স্বাধীন বাংলা বেতারে কিভাবে যুক্ত হলেন? মঞ্জুলা দাশগুপ্ত : আগরতলায় গিয়ে খবরের কাগজে দেখলাম কলকাতার ১৪৪ নম্বর লেনিন স্মরণিতে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামে বাংলাদেশের শিল্পীদের নিয়ে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে। আমি, আমার স্বামী ও ভাই অমিতাভ সেনগুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলাম। সেখানে হাসান ইমাম, ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, বিপুল ভট্টাচার্য, ডালিয়া নওশীন, শাহীন সামাদসহ অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। জহির রায়হানও সেখানে মাঝে মাঝে আসতেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন খবরাখবর দিতেন। ভারত থেকে সুচিত্রা মিত্র, রুমাগুহ ঠাকুরতাসহ অনেকেই আসতেন। প্রতিদিন গানের রিহার্সাল হতো, মুক্তাঙ্গনে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সেই গান শুনিয়ে উদ্দীপ্ত করতাম। ‘রূপান্তরের গান’ নামে একটি গীতিনাট্য তৈরি হয়েছিল। আমরা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এটি পরিবেশ করে জনমত সৃষ্টি করতাম। জুলাই মাসে স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দেই। ওখান থেকে নিয়মিত আমাদের গান প্রচার হতো। যখন খবর আসল বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তখন গান তৈরি হলো ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই বাংলার ঘরে ঘরে’। এটাই স্বাধীন বাংলা বেতারে আমাদের শেষ গান ছিল। স্বাধীনতার স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে? মঞ্জুলা দাশগুপ্ত : স্বাধীন ভূখন্ড পেলেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এখনও পৌঁছতে পারিনি। মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় এই ভেবে যে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা আবার বাংলাদেশের অস্থিত্বই মুছে ফেলতে চাইছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তরুণ প্রজন্মের ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছে মনে করেন? মঞ্জুলা দাশগুপ্ত : খুব নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম। এখন দেখছি তরুণরা মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের গান করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তরুণদের উজ্জীবিত করতে হবে। এই ভেবে দুঃখ হয় যে, জীবন বাজি রেখে আমরা যুদ্ধ করেছি আমাদের কণ্ঠ নিয়ে, এখন কেউ আমাদের খোঁজ রাখে না। -গৌতম পাণ্ডে
×