ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইস্তেহারা খানম

অভিমত ॥ শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া ও তার প্রতিকার

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৭

অভিমত ॥ শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া ও তার প্রতিকার

মানসম্মত ও যুগোপযোগী প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও আজও আমরা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারিনি। তার কারণ এই অগ্রযাত্রায় আমাদের রয়ে গেছে কিছু প্রতিবন্ধকতা। দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় সামাজিক মূল্যবোধ, কুসংস্কার, পুরনো আমলের শিখন পদ্ধতি ইত্যাদি প্রাথমিক শিক্ষার যথাযথ মান অর্জনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ। আর এসব সমস্যার ফলশ্রুতিতে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে যে সমস্যাটি তা হলো ঝরেপড়া। এ সমস্যার মূল উৎপাটনের জন্য করণীয় যা দরকার তা হলো ঝরেপড়ার জন্য দায়ী বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা এবং এ সমস্যাগুলোর প্রতিকারের ব্যবস্থা করা। সমাজের সচেতন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি, নাগরিক কমিটি ইত্যাদি সংগঠনকে এ দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীর ঝরেপড়া প্রতিরোধ করার জন্য সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে শিক্ষক। কিন্তু এ কাজের জন্য শিক্ষককে অবশ্যই মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে। শিক্ষককে মনে রাখতে হবে বিদ্যালয়ে প্রত্যেক শিশু শিক্ষার্থী হলেও সবাই সমান নয়। প্রত্যেকের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের প্রতি আগ্রহ, ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা। শিশুর অপারগতাকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রাধান্য দিতে হবে তার পারদর্শিতাকে। শিশুর ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলার কাজটি শিক্ষক ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। শিক্ষকের অমনোযোগিতা, শিক্ষকের অবহেলা, শারীরিক ও মানসিক শাস্তিই অনেক শিশুর বিদ্যালয়ভীতি তৈরি করে, যা মোটেই কাক্সিক্ষত নয়। শিশুর মনে নতুন পৃথিবীর দুয়ার উন্মোচন করবে শিক্ষক। শিক্ষকের দেখানো স্বপ্ন নিয়ে বড় হবে প্রতিটি শিশু। শিশুর পৃথিবীতে শিক্ষকের অবস্থান হবে পথপ্রদর্শকের ন্যায়। শিশুর স্বপ্নের চেয়েও তার সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণে শিক্ষককে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক হবে শিশুদের জন্য সূর্যস্বরূপ। সূর্য যেমন পৃথিবীকে আলোকিত করে সমস্ত অন্ধকার দূর করে, তেমনি শিক্ষককেও শিক্ষার্থীর জীবন ও জীবনদর্শনকে আলোকিত করার দায়িত্ব নিতে হবে। বিদ্যালয়কে রূপান্তর করতে হবে শিশুস্বর্গে। বিভিন্ন ধরনের চিত্তাকর্ষক উপকরণে সাজিয়ে দিতে হবে বিদ্যালয়কে। শুধু পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নের ব্যবস্থা না করে শিশুদের জীবন ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন এসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন করতে হবে। বিদ্যালয়ের পরিবেশ হবে এমন যেখানে শিশু সারাদিন থাকার পরও তার একঘেয়েমি আসবে না। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর স্কুলের প্রতি আকর্ষণই তাকে স্কুলে নিয়ে আসবে। শিশুর চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাঠের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করতে হবে। বিদ্যালয়ের পরিবেশ সব সময় শিশুবান্ধব হতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে ঝরেপড়া একটি অন্যতম সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান নিয়ে কঠোর হতে হবে সবাইকে। শিশুর ঝরেপড়ার সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্র নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। যেমন শিশুদের প্রতি সামাজিক অবজ্ঞা ঝরেপড়ার একটি অন্যতম কারণ হতে পারে। শিশুরা তাদের নিজের সম্পর্কে বিশেষণ শব্দের ব্যবহার শুনতে খুব পছন্দ করে। যদিও তারা বুঝে উঠতে পারে না তারা বিশেষণের উপযুক্ত কিনা। শিশুকে তার পরিবার, পরিবেশ ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধে বিবেচনা করার মানসিকতা আমাদের এখনও কম। ধনী ও দরিদ্র পরিবারের শিশুদের একই বিশেষণ ব্যবহারেও দ্বিমত দেখা যায় অনেকের মাঝে। এতে করে শিশুরা নিজের ওপর বিশ্বাস হারায়। শিশুরা নিজেকে অবহেলিত অথবা অযোগ্য বিবেচনায় শ্রেণীকরণ করে, যা কখনোই কাম্য হতে পারে না। শিশুদের মূল্যায়নে শিক্ষকদের আরও কৌশলী হতে হবে। শিশুদের আত্মমূল্যায়নের পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে। শিশুকে খুশি করতে বিশেষণ ব্যবহারে সঙ্কীর্ণতা পরিহার করতে হবে। অতি সংবেদনশীল শিশুদের একান্তে ডেকে এমনভাবে তার সমস্যার নিরাময়ের ব্যবস্থা করতে হবে যেন শিশু তার বন্ধু মহলে নিজেকে হেয় মনে না করে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণী শিশুদের জীবন পরিক্রমার অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় শিশুরা নিজেকে প্রকাশ করতে চায় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে অগ্রগামী সৈনিকের ভূমিকায়। শিশুদের প্রতি সমাজের যে কোন স্তরের বিরূপ মন্তব্য তার শিক্ষাজীবনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই কোন কঠোর অবস্থানে না গিয়ে শিশুকে বুঝতে হবে তার চাহিদা মোতাবেক। শুধু উপবৃত্তি দিয়ে শিশুদের ঝরেপড়া থামানো সম্ভব নয়। প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সমাজে আমরা যে অবস্থানেই থাকি না কেন আমাদের ভাবতে হবে ঝরেপড়া শিশুদের নিয়ে। শিশুকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে একটি জাতি কখনোই সভ্যতার উচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে না। শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা প্রশাসন, সিভিল প্রশাসন, নাগরিক সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলকে একত্রিত হতে হবে শিশু শিক্ষার উন্নয়নে। লেখক : শিক্ষক
×