ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দীর্ঘ ৪৬ বছরেও শহীদের স্বীকৃতি পায়নি একই পরিবারের ৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০১:২০, ১১ ডিসেম্বর ২০১৭

দীর্ঘ ৪৬ বছরেও শহীদের স্বীকৃতি পায়নি একই পরিবারের ৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা ॥ আজ ১২ ডিসেম্বর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাবনার একই পরিবারের ৫ শহীদ ভাইয়ের মৃত্যু দিবস। একই পরিবারের ৫ জন শহীদ হলেও দীর্ঘ ৪৬ বছরেও নূন্যতম শহীদের স্বীকৃতি জোটেনি। এই দু:খ বেদনা মাথা নিয়েই ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন শহীদ মাতা রোকেয়া খাতুন। এমনকি এই শহীদ পরিবারের সব সদস্য এখন চরম কষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ১৯৭১ সালে দেশ মাতৃকার টানে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে পাবনা শহরের সাধুপাড়া এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মোতাহার হোসেন মাষ্টারের ৫ মেধাবী ছেলে ও এক জামাতা। এরা হলেন-ক্যাপ্টেন মোজাম্মেল হোসেন, মোশারোফ হোসেন রঞ্জু, মোস্তাক হোসেন অঞ্জু, মোকাররম হোসেন মুকুল, মনসুর হোসেন মঞ্জু ও তাদের ভগ্নিপতি ইউসুফ আলী। এদের মধ্যে ১৯৭১ সালে ৮ ডিসেম্বর সন্মুখযুদ্ধে শহীদ হন মোশারোফ হোসেন রঞ্জু ও মোস্তাক হোসেন অঞ্জু। দুই ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ জানাতে এবং বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে অপর দুই ভাই মোকাররম হোসেন মুকুল ও মনসুর হোসেন মঞ্জু এবং ভগ্নিপতি ইউসুফ আলী তাদের ঢাকার মধুবাগের বাসায় আসেন। ঐ সময় পাক হানাদারদের দোসর রাজাকার আল বদর ও আল শামসের ক্যাডাররা তাদের আগমনের খবর পাক সেনাদের জানিয়ে দেয়। মুহুর্তেই পাক সেনারা ঐ বাড়ী ঘিরে তাদের তিনজনকে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করে বলে জানা যায়। তবে শহীদ ৫ জনের কোন লাশই পাওয়া যায়নি। শহীদদের আতœীয়স্বজন জানান, পাবনার একমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে সবার শ্রদ্ধেয় মোতাহার হোসেন মাষ্টারের সব ছেলে মেয়েই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে মোশারোফ হোসেন রঞ্জু ছিলেন এডওয়ার্ড কলেজের মাষ্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, মোস্তাক হোসেন অঞ্জু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল সায়েন্সের ছাত্র, মোকাররম হোসেন মুকুল ছিলেন জেলা বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী, মনসুর হোসেন মঞ্জু ছিলেন পানি ও বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (ওয়াপদা) হিসাবরক্ষণ অফিসার এবং তাদের ভগ্নিপতি ইউসুফ আলী ছিলেন ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের কর্মকর্তা। সবার বড় ভাই ক্যাপ্টেন মোজাম্মেল হোসেন ৭ নং সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ১৯৭১ সালে সরাসরি যুদ্ধের সময় কামানের গোলায় বীরশ্রেষ্ট জাহাঙ্গীর তার সামনেই শহীদ হন। ২০০২ সালের ২৯ নবেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। এত সূখ স্বাচ্ছন্দ এবং পরিবার পরিজন ছেড়ে দেশকে মুক্ত করতে যারা জীবন উৎসর্গ করলেন অথচ দীর্ঘ ৪৬ বছরেও ওই পরিবারের কেউ কোন খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে প্রতিষ্টিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট্র, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদও তাদের কোন খোঁজ রাখেনি বলে অভিযোগ শহীদ পরিবারের সদস্যদের। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু পাবনা সফরকালে শহীদ মাতা রোকেয়া খাতুনকে সার্কিট হাউসে ডেকে নিয়েছিলেন। এ ছাড়া বিগত ৪৬ বছর ধরে প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসে শুধু মাত্র একটি করে চিঠি (আমন্ত্রণপত্র) দেওয়া হয় তাদের। এমনকি ৪ ভাইয়ের মৃত্যুর পর জীবিত দুই ভাই সংসারের ঘানি টানতে সময় চলে গেছে তাই তাদের ভাগ্যে জোটেনি ভাল কোন চাকুরি। ৫ শহীদের জীবীত দু‘ভাই এখন বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। ৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বোন মকবুলা মঞ্জুর শোভা জানান, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই সবাই দেশপ্রেমিক হয়ে পড়ে। অনেকই এসে শান্ত¡না দেয়, নানা সহায়তার কথা বলে। পর দিনই সবাই তা ভূলে যায়। সারা বছর কেউ কোন খোঁজ পর্যন্ত রাখেনা। বেঁেচ থাকা আমার দুই ছেলের আজ পর্যন্ত কোন কর্মসংস্থান হলো না ; এমনকি তাদের (শহীদদের) সন্তানদের। এ কেমন কথা। কারো কোন দায়িত্ব নেই। যারা জীবন দিয়ে এ দেশকে স্বাধীন করলো তাদের পরিবারের দায়িত্ব রাষ্ট্র নেবে না ? মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সন্তান হারিয়ে অনেকে শহীদ মাতা হয়েছেন অথচ আমাদের পরিবারের ৪ সন্তান ও এক জামাতা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করলো তাদেরকে সবাই ভূলতে বসেছে। এমনকি স্বীকৃতি টুকু দেওয়া হচ্ছে না।
×