ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

১৬ বছরেও চালু হয়নি রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র

প্রকাশিত: ০০:৫৫, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

১৬ বছরেও চালু হয়নি রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর ॥ নারী জাগরণের পথিকৃত মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মভুমি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে নির্মিত বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রটি দীর্ঘ ১৬ বছরেও চালু হয়নি। বর্তমানে এটি তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশাল অবকাঠামোটি এখন ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। কার্যক্রম চালু না হওয়ায় স্মৃতি কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সরেজমিনে বেগম রোকেয়ার বসতভিটা পায়রাবন্দে গিয়ে দেখা গেছে, স্মৃতি কেন্দ্রটিতে মানসম্মত একটি রেস্টহাউস, অডিটরিয়াম, সেমিনার কক্ষ, লাইব্রেরী, গবেষণাগার, সংগ্রহশালা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, নামায ঘর ও স্টাফ কোয়ার্টার রয়েছে। এগুলো বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘদিন অব্যহৃত থাকায় কমপ্লেক্সের বিভিন্ন স্থানে স্যাঁতস্যাতে অবস্থা। কোথাও কোথাও পলেস্তারা খসে পড়েছে। মূল ভবনের সামনে পিতলের তৈরী বেগম রোকেয়ার একটি ভাস্কর্য রয়েছে। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০০১ সালের ১ জুলাই পায়রাবন্দ সফরে এসে পায়রাবন্দকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম পাদপীঠ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিনই তিনি উদ্বোধন করেন এ স্মৃতি কেন্দ্রটি। কিন্তু দীর্ঘ ১৬ বছরেও শুরু হয়নি এর কোন কার্যক্রম। এর ফলে হতাশ হয়ে পড়েছে পায়রাবন্দবাসি। জানা গেছে, দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রাবন্দে ৩ একর ১৫ শতক জমির ওপর ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রে’র ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন । পরে ২০০১ সালের ১ জুলাই এটি উদ্বোধন করেন তিনি। প্রথমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কেন্দ্রটির দায়িত্বভার গ্রহণ করলেও ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর স্মৃতি কেন্দ্রটি বাংলা একাডেমির কাছে হস্তান্তর করা হয়। বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তাঁর গ্রন্থাবলির অনুবাদ, প্রচার ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং স্থানীয় যুবকদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করার উদ্দেশ্যে এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে এই স্মৃতি কেন্দ্রটিতে মানসম্পন্ন রেস্টহাউস, অডিটরিয়াম, সেমিনার কক্ষ, লাইব্রেরী, গবেষনাগার, সংগ্রহশালা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, নামায ঘর ও স্টাফ কোয়ার্টার সবই রয়েছে। এছাড়াও মুল ভবনের সামনে পিতলের তৈরী বেগম রোকেয়ার একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। বাংলা একাডেমীতে হস্তান্তর করায় বর্তমানে এ কেন্দ্রে কর্মরত আছেন একজন উপ-পরিচালকসহ বিভিন্ন পদে ৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। বাংলা একাডেমি থেকে ২০০৮ সালে স্মৃতি কেন্দ্রটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। একই বছরের ১৭ মার্চ অলিখিতভাবে স্মৃতিকেন্দ্রটি বিকেএমই’র শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য অনুমতি প্রদান করা হয়। শুরু হয় পোশাক শ্রমিক তৈরীর প্রশিক্ষণ। এটির উদ্বোধন করেন, তৎকালীন সেনা প্রধান মঈন ইউ আহমেদ। স্মৃতিকেন্দ্রটির মূল উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে সেখানে পোশাক শ্রমিক তৈরীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করায় বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন স্থানীয়রা। পায়রাবন্দ স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল ও হিউম্যান রাইট্স এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ বিকেএমই’কে উচ্ছেদের লক্ষ্যে ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বেগম রোকেয়ার স্মৃতিকেন্দ্রের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং শ্রমিক তৈরীর কারখানা বন্ধের আদেশ দেন। পরে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ২০১২ সালের ১ মে বিকেএমই’কে উচ্ছেদ করে। স্মৃতিকেন্দ্রটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলা একাডেমীর অধীনে হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে স্মৃতিকেন্দ্রর উপ-পরিচালক আবদুল্যাহ্ আল-ফারুক উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন। যার নং-৯২২৬/২০০৮। আদালত বাংলা একাডেমীর কাছে স্মৃতিকেন্দ্রটি হস্তান্তরের আদেশ প্রদান করেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ সুপ্রীমকোর্টে একটি লিভ টু আপীল করে। ২০১৫ সালের ১২ মে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সরদার মতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, স্মৃতি কেন্দ্রটির কার্যক্রম পুনরায় চালু ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরী রাজস্বখাতে স্থানান্তর বিষয়ের ওপর অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়। ‘বিদ্যমান সমস্যাসমুহ চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলা একাডেমীর তত্বাবধানে পরিচালিত হবে।’ এর ২ মাস পর সুপ্রীমকোর্ট হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। এর ফলে, বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রটি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রাণালয়ের আওতাধীন বাংলা একাডেমীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব আবদুল জলিল এ বছরের ৫ মে চিঠি দিয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধিন বাংলা একাডেমীর কাছে হস্তান্তর করেন। কিন্তু, স্মৃতি কেন্দ্র চালুর ব্যপারে কোন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশাল অবকাঠামো নির্মিত হলেও বর্তমানে এটি ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। কার্যক্রম চালু না হওয়ায় স্মৃতি কেন্দ্রটির প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পায়রাবন্দ স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, বেগম রোকেয়ার জন্মভূমিতে প্রতিষ্ঠিত স্মৃতি কেন্দ্রটি চালু না হওয়া খুবই দুঃখজনক। মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মামুন-অর রশীদ বলেন, যতদুর জেনেছি বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রের জটিলতা মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের রায়ে নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন এটির কার্যক্রমে আর কোন বাঁধা নেই। অন্যান্য সমস্যাগুলোও খুব দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে আমি মনে করি। ২০/২৫ বছর আগেও পর্দা প্রথা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ফতোয়া ও কুসংস্কারে ভরা ছিল বেগম রোকেয়ার জন্ম স্থান রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ। এখন সে অবস্থা আর নেই। বদলে যাচ্ছে এই জনপদ। এখানকার নারীরা এখন অনেক অগ্রসর। বেগম রোকেয়ার দেখানো পথে কঠোর পরিশ্রমে তাদের স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে পায়রাবন্দে। এখানকার মেয়েরো এখন দল বেঁধে স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। বাল্য বিয়ে অনেক কমেছে। নারী নির্যাতনের খবরও খুব একটা পাওয়া যায়না। এই এলাকায় প্রতিষ্ঠিত পোশাক তৈরীর কারখানা, বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র, দুগ্ধ খামারে এলাকার নারীরা কাজ করে অর্থ উপার্জন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এবারে রোকেয়া দিবসে এলাকাবাসির দাবি বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি চালু করা হোক। অনেক নারী আবার নিজেই পোশাক তৈরীর কারখানা দিয়েছেন। এমনই এক নারী লাইজু বেগম রূপালী। পায়রাবন্দ সোয়েটার ফ্যাশন নামে একটি পোশাক কারখানা নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর কারখানায় ৫০ জনেরও বেশি নারী কাজ করেন। তিনি বলেন, বেগম রোকেয়া আমাদের শিখিয়েছেন, কিভাবে পুরুষের সাথে সমানতালে কাজ করে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। আমি বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি পায়রাবন্দের নারী হিসেবে গর্বিত। বৈরাগীগঞ্জে দুটি ছোট ছোট পোশাক তৈরীর কারখানায় ২ শতাধিক, এসিআই বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে শতাধিকসহ পাঁচ শতাধিক নারী বিভিন্ন কারখানায় কাজ করে থাকেন। এদিকে, শনিবার, ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস। নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস। এ উপলক্ষ্যে রংপুর জেলা প্রশাসন ৩ দিন ব্যাপি নানা কর্মসুচী গ্রহণ করেছে। শনিবার সকাল ৯ টায় বেগম রোকেয়া স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণের মধ্য দিয়ে কর্মসুচী শুরু হয়। সকাল ১০ টায় পায়রাবন্দ জামে মসজিদে মিলাদ মাহফিল, সকাল সাড়ে ১০ টায় প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনী, সকাল ১১ থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় রক্তদান ও রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা এবং বিকেল ৪ টায় আনুষ্ঠিকভাবে মেলা উদ্বোধন করা হয়। সাড়ে ৪টায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন, রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কাজী হাসান আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন, রংপুরের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বিপিএম, পিপিএম. রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, আওয়ামীলীগ নেতা ও বিশিষ্ট সমাজসেবক রাশেক রহমান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাম্মেল হক মিন্টু মিয়া। সভায় সভাপতিত্ব করেন, রংপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান। স্বাগত বক্তব্য দেন, মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহি অফিসার মামুন-অর রশীদ। বেগম রোকেয়ার অসাম্প্রদায়িক ও সাম্য চেতনা শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন, প্রফেসর মোহাম্মদ শাহ্ আলম। প্রধান আলোচক ছিলেন, প্রফেসর আতাহার আলী খান ও রোজী রহমান। সন্ধ্যা ৬ টায় নাটিকা, সন্ধ্যা ৭ টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি, রচনা ও বির্তক প্রতিযোগিতা এবং প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। বিকেল সাড়ে ৪টায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডক্টর কলিমউল্লাহ্ । বিশেষ অতিথি থাকবেন রংপুরের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ও স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) রুহুল আমিন মিঞা। সভাপতিত্ব করবেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রশিদুল মান্নাফ কবীর। আলোচক থাকবেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ ও বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল। তৃতীয় দিনে বিকেল ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সংসদীয় বির্তক অনুষ্ঠিত হবে। বিকেল সাড়ে ৪টায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সর্ম্পকিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এইচএন আশিকুর রহমান এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন, এ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া এমপি ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ব্যবস্থাপনা পর্ষদ সদস্য রেহানা আশিকুর রহমান। সভাপতিত্ব করবেন, রংপুর জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. সরিফা সালোয়া ডিনা। বিকেল ৫টায় পুরস্কার ও পদক বিতরণ এবং সন্ধ্যায় নাটিকা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
×