ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রফতানি আয় দু’শ’ কোটি ছাড়াবে ॥ মানিকগঞ্জে বড় বিনিয়োগ

প্লাস্টিকের বোতল থেকে তৈরি হচ্ছে তুলা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

প্লাস্টিকের বোতল থেকে তৈরি হচ্ছে তুলা

এম শাহজাহান ॥ টোকাইয়ের কুড়িয়ে নেয়া প্লাস্টিকের পানির বোতল থেকে দেশে তৈরি হচ্ছে শতকোটি টাকার তুলা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্লাস্টিকের এই তুলা রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। আশা করা হচ্ছে, বছর শেষে রফতানি আয় ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। পোশাক খাতে বার্ষিক তুলার চাহিদা ৪৫ থেকে ৫০ লাখ বেল। উৎপাদন হয় ১ লাখ বেলের সামান্য বেশি। এ অবস্থায় টেক্সটাইল শিল্প সুরক্ষা ও ঘাটতি পূরণে তুলা উৎপাদনের বিকল্প নেই। তুলার অভাব পূরণে নতুন সম্ভাবনা প্লাস্টিকের তুলা উৎপাদন ও তা থেকে সুতা তৈরি করা। গেঞ্জি, জার্সি, ট্রাউজার এবং ব্লেজারের মতো দামী কাপড়ে প্লাস্টিকের সুতা অপরিহার্যভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। জানা গেছে, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করে রিসাইকেল পদ্ধতিতে তুলা তৈরিতে ইতোমধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করা হয়েছে। ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের পানিয়াশাইলে চীনা প্রযুক্তির একটি কারখানা তৈরি হয়েছে। মুমানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের কারখানাটিতে কয়েক মাস ধরে প্লাস্টিক পেট বোতল দিয়ে দৈনিক ৪০ টন তুলা উৎপাদন করা হচ্ছে। চীন, ভারত, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডে এ ধরনের কারখানা থাকলেও বাংলাদেশে বর্জ্য থেকে তুলা উৎপাদনের এটিই প্রথম কারখানা। সূত্রমতে, বর্তমান প্লাস্টিক শিল্পের বার্ষিক টার্নওভার হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা। রফতানিমুখী এ শিল্প খাত থেকে সরকার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পেয়ে থাকে। এটি একটি উদীয়মান শিল্প। সরকার ইতোমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় বিসিকের মাধ্যমে ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বড়বর্ত্তা মৌজায় ৫০ একর জমির ওপর প্লাস্টিক শিল্প নগরীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একনেকে অনুমোদনক্রমে কাজ চলছে। এছাড়া ঢাকার কেরানীগঞ্জে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন হচ্ছে। বেজা কর্তৃপক্ষ বিপিজিএমইএকে ১০৫ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় বোতল থেকে তুলা হচ্ছে ॥ পানি খাওয়ার পর ফেলে দেয়া স্বচ্ছ বোতল টোকাইদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তাদের কাছ থেকে এই পেট বোতল সংগ্রহ করে ছোট করে কেটে ফ্লেক্স তৈরি করা হয়। এর পর গরম পানি দিয়ে সেই ফ্লেক্স ধোয়া হয়। উচ্চ তাপ ও চাপে সেই ফ্লেক্স আট ঘণ্টা বায়ু নিরোধক ড্রামে রাখা হয়। ভ্যাকুয়াম ড্রামে তাপ দেয়ার পর তৈরি হয় পেস্ট। সেই পেস্ট স্পিনারেট দিয়ে স্নাইবার করা হয়। এর পর তা সূক্ষ্ম সুতার আকারে বেরিয়ে আসে। ওই সুতা আবার বিভিন্ন আকারে কাটিং করে মেশিনে ঢোকানোর পর পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবার (পিএসএফ) হিসেবে সাদা তুলা বেরিয়ে আসে। উৎপাদিত তুলা বাজারে বিক্রি করা কার্পাস তুলার মতোই মোলায়েম ও মসৃণ। প্লাস্টিক বোতল থেকে তুলা তৈরির এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর রফতানির উদ্দেশে মেশিনেই তা প্যাকেজিং করা হয়। এ থেকে সুতার মতো যে বর্জ্য বের হয় সেটিও আবার রিসাইকেল পদ্ধতিতে তুলা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। জানা গেছে, প্লাস্টিকের তুলার চাহিদা দেশে বাড়ছে। এছাড়া এ ধরনের তুলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে চীনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশে। আগে চীন কাঁচামাল হিসেবে সরাসরি প্লাস্টিক পেট বোতল আমদানি করে নিজেরাই এ ধরনের তুলা উৎপাদন করত। সম্প্রতি দেশটি প্লাস্টিক বোতল আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। ফলে এখন ফিনিশড পণ্য হিসেবে তুলা বা পিএসএফ আমদানি করছে দেশটি। এ কারণে রফতানি পণ্য হিসেবে এ ধরনের পিএসএফ তুলার কদর বাড়ছে। মুমানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এমডি আবুল কালাম মোহাম্মদ মূসা জনকণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের কারখানা গড়ার পেছনে দুটো উদ্দেশ্য কাজ করেছে। প্রথমত, তুলা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে প্লাস্টিকের ফেলে দেয়া বোতল ব্যবহার করায় পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয়ত, এই বর্জ্য থেকে উৎপাদিত তুলা বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে এই প্রথম স্থাপিত এ ধরনের কারখানা থেকে দৈনিক প্রায় ৪০ মেট্রিক টন তুলা উৎপাদন হচ্ছে, যা শীঘ্রই ৮০ মেট্রিক টনে উন্নীত হবে। তুলা উৎপাদনে যেসব চ্যালেঞ্জ ॥ সম্ভাবনাময় এই শিল্পটিতে সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন প্রযুক্তির কারখানাটি স্থাপনের পর কাঁচামাল সংগ্রহসহ দেশীয় বাজারে উৎপাদিত তুলার যথাযথ মূল্য না থাকায় এটি অলাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে সরকার পেট বোতল ফ্লেক্স রফতানিতে ১০ শতাংশ হারে ভর্তুকি দিচ্ছে। কারখানা সংশ্লিষ্টরা পেট বোতল ব্যবহার করে তুলা উৎপাদন করার ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন করছেন। ফলে এই খাতে তারা ২০ শতাংশ রফতানি ভর্তুকির সুযোগ চান সরকারের কাছে। ভতুর্কি দেয়া হলে রফতানি বহুমুখীকরণের পাশাপাশি এ খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক এ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, (বিপিজিএমইএ) প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ে এখনও ডেভেলপ করতে পারেনি বাংলাদেশ। এর পরও টোকাই, ভাঙ্গারির দোকানের মাধ্যমে রাস্তার আর্বজনা থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য কুড়িয়ে ৭০ শতাংশ রিসাইক্লিং করে এই শিল্পের পণ্য তৈরি হয়। রিসাইক্লিং পণ্যের কারণে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হচ্ছে। বিপিজিএমইএর সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, রিসাইক্লিং খাতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেয়া প্রয়োজন। প্লাস্টিক রিসাইক্লিং ডেভেলপ করতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। তিনি বলেন, চলতি বাজেটে প্লাস্টিক খাতের কিছু প্রস্তাব উপেক্ষিত হয়েছে। তিনি জানান, প্লাস্টিকের বোতল থেকে তুলা এবং সেই তুলা থেকে পলিয়েস্টার কাপড় তৈরি হচ্ছে। এটি একটি সম্ভাবনাময় শিল্প খাত।
×