ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বীরেন মুখার্জী

সুতো কেটে জুড়ে যাওয়া বোধ

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

সুতো কেটে জুড়ে যাওয়া বোধ

রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ পরবর্তী উজ্জ্বল কবি হিসেবে বিনয়কে গণ্য করা হয় মূলত কবিতায় গণিত ও বিজ্ঞানের যুক্তি উপস্থাপন এবং স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণের কারণে। ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি; কবি কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে বাংলা কবিতার এক উজ্জ্বলতম কবিতাকুহক হিসেবে বিনয় মজুমদারকে বিবেচনা করেন কাব্যবোদ্ধারা। গতানুগতিক কবিতার বাইরে এসে কবিতার প্রকরণে তিনি ব্যবহার করেছেন ‘গাণিতিক ফর্ম’। অনেক আলোচক মনে করেন, ব্যক্তি জীবনে গণিতজ্ঞ হওয়ার কারণেই তার কবিতায় গণিতের মাপজোঁক উঠে এসেছে। যে কারণে তার কবিতায় জ্যামিতিক একটা আবহ সবসময় দৃশ্যমান। তার কবিতার স্বর উচ্চকিত নয়, অন্তর্মুখী (ওহঃৎড়াবৎঃ). আবার সংশয়-সন্দেহের দোদুল্যমানতার বিষয়েও জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। যদিও সময়ের সীমারেখা অতিক্রম করে জীবনানন্দ দাশ এবং বিনয় মজুমদার উভয়েই হয়ে উঠেছেন সমসাময়িক। একে অন্যের পরিপূরক যেন! সহজাত বেদনাবোধে আক্রান্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে দুজনের কবিতায়। নিচের কবিতাটি লক্ষ্য করা যেতে পারে ‘নেই, কোনো দৃশ্য নেই, আকাশের সুদূরতা ছাড়া। সূর্য পরিক্রমারত জ্যোতিস্কগুলোর মধ্যে শুধু ধূমকেতু প্রকৃতই অগ্নিময়ী, তোমার প্রতিভা স্বাভাবিকতায় নীল, নর্তকীর অঙ্গ সঞ্চালন ক্লান্তিকর নয় বলে নৃত্য হয় যেমন, তেমনি। সুমহান আকর্ষণে যেভাবে বৃষ্টির জল জমে বিন্দু হয়, সেভাবেই আমিও একাগ্র হয়ে আছি। তবু কোনো দৃশ্য নেই আকাশের সুদূরতা ছাড়া।’ বিনয় মজুমদারের ফিরে এসো, চাকার ১৯ সংখ্যক এ-কবিতাটিতে সংশয়-সন্দেহের বিষয়টি উচ্চকিত। কিন্তু তিনি কী দর্শন তুলে ধরতে চেয়েছেন কিংবা কোন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন সে বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে। বিনয়ের কবিতার গভীর পাঠে ‘অবচেতন’-এ বিচরণের বিষয়টি সামনে আসে। চেতন-অবচেতনের দুল্যমানতা বিনয়ের কবিতাকে কোন স্তরে পৌঁছে দিয়েছে, সে বিষয়টিও সামনে আসে। সমকালে একটি বিশেষ শ্রেণী ‘বিনয় অসুস্থ’ বলে প্রচার করেছেন। প্রশ্ন হলো, মানসিক অসুস্থতা নিয়ে বিনয় কীভাবে কবিতাগুলো লিখলেন! এটা ঠিক যে, বিনয় অবচেতনে চলেছেন, যাকে কবিতার ঘোরও বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ পরবর্তী উজ্জ্বল কবি হিসেবে বিনয়কে গণ্য করা হয় মূলত কবিতায় গণিত ও বিজ্ঞানের যুক্তি উপস্থাপন এবং স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণের কারণে। ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি; কবি কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নবনব কাব্য-বিকিরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভেতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্য প্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।’ জীবনানন্দ দাশ লিখিত ‘হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভেতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে’ বক্তব্যটি বিনয় মজুমদারের ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য বলে ধরে নেয়া যায়। ‘গণিতসূত্রের নির্যাস দর্শনটুকু প্রয়োগ করেই’ কবিতা রচনায় ব্রতী হওয়ার পাশাপাশি ‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?’ জাতীয় স্মরণীয় গভীর পঙ্ক্তি রচনা করে তিনি জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছেন কাব্যবোদ্ধা এবং পাঠকের মন। বাল্যকাল থেকে গণিতের প্রতি সহজাত টান আর পরিণত জীবনে এসে কবিতায় গণিতের প্রয়োগ, গণিতের প্রতি তার গভীর ভালোবাসারই সাক্ষ্যবহ। তবে বিনয় মজুমদারের কবিতা পাঠ করতে গিয়ে অনেক সময় জীবনান্দনীয় কাব্যবোধ স্পষ্ট হয়। জীবনানন্দের মতো একই কথা তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কবিতায় উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। এছাড়া কবিতায় কথা বলার যে মৌন ভঙ্গিমা তাও জীবনানন্দের কাব্যভাষাকে সমর্থন করে। হতে পারে, অনেকের মতো তারও প্রিয় কবি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। বিনয় মজুমদার অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে কবিতায় তুলে ধরেছেন তার যাপনের নানা অভিজ্ঞতা, আশা-ব্যর্থতা, অনুরাগ, অপ্রাপ্তির বিভিন্ন অনুষঙ্গ যা জীবনানন্দের মৌনতাকে সমর্থন করলেও বিনয়কে চিনতে বেগ পেতে হয় না। প্রকৃতপ্রস্তাবে, বিনয়ের কবিতাগুলো যেন স্বগতোক্তি কিংবা আত্মকথন, যা শান্তরস সিক্ত, তীব্র ব্যঞ্জনাধর্মী ও গভীর অর্থবোধক। এ বৈশিষ্ট্যের কবিতাকে কাব্যবোদ্ধারা আত্মমুখিনতা বা ইন্ট্রোভার্ট কবিতা বলে আখ্যায়িত করেন। এবার বিনয়ের কবিতা থেকে পাঠ নেয়া যেতে পারেÑ ‘আর যদি নাই আসো, ফুটন্ত জলের নভোচারী বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো না-ই মেশো, সেও এক অভিজ্ঞতা; অগণন কুসুমের দেশে নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো তোমার অভাব বুঝি; কে জানে হয়তো অবশেষে বিগলিত হতে পারো; আশ্চর্য দর্শনবহু আছে নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতন তোমাকেও হয়তো পাই না আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি অস্ফুট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে, গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে।’ ‘আর যদি নাই আসো’ কবিতায় তিনি কোন দর্শনের কথা বলতে চেয়েছেন, তার মর্মার্থ উদ্ধারে কবিতাটি একবার পাঠ করে ছেড়ে দিলে চলে না। কেননা, অন্যান্য কবির মতো বিনয়ের কবিতার বোধ আপাতসরল পথ অতিক্রম করে না। তার কবিতা পাঠে নতুন চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটে বিধায় তার কবিতা গভীর পাঠ অভিনিবেশ দাবি করে। বাংলা কবিতার গতানুগতিক যে ভাষায় পাঠক অভ্যস্ত তা বিনয়ের কবিতায় অনুপস্থিত। তিনি ভাষাকে ঘষে মেজে গণিতের সূত্রে দাঁড় করিয়েছেন। ফলে বিনয়ের কাব্যভাষা হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র। পাঠকও বিনয়ের কবিতা সহজে শনাক্ত করতে পারেন স্বতন্ত্র কাব্যভাষার কারণে। ‘আর যদি নাই আসো’ কবিতায় তিনি নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলেছেন এবং একটি সূত্র অনুযায়ী একটি আপাত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন বলে মনে হওয়া অযোক্তিক নয়। ‘ফুটন্ত জলের নভোচারী’ যদি না ফিরে আসে, বাষ্পের সঙ্গে যদি বাতাসের মতো না-ই মেশেÑ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কবির অভিজ্ঞতা তার অন্তর্বয়ানই এই কবিতাটি। বিনয় মজুমদারের কবিতায় বাক্য গঠন ও পোয়েটিক টার্মিনোলজির ব্যবহার থেকেও স্পষ্ট হয় তার স্বতন্ত্র সত্তা। যেমন, কবিতায় ‘কী প্রকার’, ‘প্রকৃত প্রস্তাব’ জাতীয় শব্দবন্ধ সহজেই বিনয় মজুমদারকে অন্যান্য কবি থেকে পৃথক করে তোলে। তার ‘ফিরে এসো, চাকা-৫৫’ সংখ্যক কবিতাটির পাঠোদ্ধার করা যেতে পারে ‘হৃদয়, নিঃশব্দে বাজো; তারকা, কুসুম, অঙ্গুরীয়- এদের কখনো আরো সরব সঙ্গীত শোনাবো না। বধির স্বস্থানে আছে; অথবা নিজের রূপে ভুলে প্রেমিকের তৃষ্ণা দ্যাখে, পৃথিবীর বিপণিতে থেকে। কবিতা লিখেছি কবে, দু-জনে চকিত চেতনায়। অবশেষে ফুল ঝরে, অশ্রু ঝরে আছে শুধু সুর। কবিতা বা গান ভাবি, পাখিরা কোকিল গান গায় নিজের নিষ্কৃতি পেয়ে, পৃথিবীর কথা সে ভাবে না।’ এ কবিতাটিতেও কবি নিজের সঙ্গে কথা বলেছেন। নিকট অতীতের স্মৃতিচারণের পাশাপাশি যৌথ চলনের অভিঘাতে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতাবোধে বিপর্যস্ত কবিমনের উপস্থিতি কবিতাটিকে করেছে হতাশাতাড়িত। বর্ণনার ধরনে মনে হওয়া অযৌক্তিক নয় যে, কবি তীব্র হতাশায় নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। অথচ তার কাব্যভাষ্যে বিষয়টি অবস্তুগত রূপেই প্রতিভাত। কেননা, হৃদয় বস্তুগত হলেও তার অনুভূতি অবস্তুগত। ফলে কবিতার সুর হয়ে উঠেছে তন্ময় ব্যক্তিগত, কিংবা মন্ময় বস্তুগত। এটা সত্য যে, ‘মানবজীবন ঘনিষ্ঠ হতাশা, বিষণœতা, প্রত্যাখ্যান, বিরহ-দাহ এক ধরনের মনোবিকারের জন্ম দেয়। এই মনোবিকারই প্রকৃত কবির সৃজনযন্ত্রণার সময়কাল। কবি দেশ-কাল, সময়, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-সভ্যতা ধারণ করে পথ পরিক্রমণে অগ্রবর্তী। মানুষ তার জন্ম থেকে পর্যায়ক্রমের দিকে চলিষ্ণু তেমনি, কবিতাকেও হতে হয় ‘বিন্দু থেকে সিন্ধু’ অভিমুখী’ (বীরেন মুখার্জী : ফিরে এসো চাকা পুনর্পাঠ)। কবি বিনয় মজুমদারও কবিতার মাধ্যমে হৃদয়কে সসম্ভ্রমে বুঝিয়েছেন, ‘নিঃশব্দে বাজো; তারকা, কুসুম, অঙ্গুরীয়Ñএদের কখনও আরও সরব সঙ্গীত শোনাব না’Ñ কবির এ অভিব্যক্তি দারুণ মর্মপীড়া এবং অভিমানের পরিশীলিত বয়ান বলেই প্রতীয়মান হয়। ‘যে অন্তর্দাহ একজন কবিকে চিন্তার গভীরে নিয়ে যায়, তা টি এস এলিয়ট পাঠে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ফুটে ওঠে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়ও। আবার একই প্রণোদনা স্পষ্টতর হয় বিশ শতকের পঞ্চাশ দশকের বিনয় মজুমদারের কবিতায়’ (বিনয় মজুমদারের কবিতা: প্রেম বিরহের ডিসকোর্স, বীরেন মুখার্জী)। আবার পাঠক বিনয়ের অন্তর্জ্বালার সঙ্গে জীবনানন্দের মর্মজ্বালারও সাদৃশ্য খুঁজে পান। জীবনানন্দকে নিয়ে বিনয়ের একটি কবিতা উল্লেখ করা যেতে পারে- ‘ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে কতিপয় চিল শুধু বলেছিল ‘এই জন্মদিন’! এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ দর্শনে বিফল বলে, ভেবেছিল অক্ষমের গান। সংশয়ে-সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে দেখে দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে একদিন সচেতন হরীতকী ফলের মতন ঝরে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেলো।’ বিনয়ের ‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম’ পঙ্ক্তিটি যেমন বিফলতা নির্দেম করে, তেমনি ‘সময়ের সঙ্গে এক বাজি ধরে পরাস্ত হয়েছি পঙ্ক্তি তীব্র দহনের ইঙ্গিতবাহী। কবিমানসের প্রেম, বিরহ-বেদনার বিউগলে বেজে অতিক্রম করে সব স্থূলতা যার সারাংশ পৌঁছে যায় ভাবনার তুরীয়লোকে। পাঠক বিমোহিত হয়, বিরহের সঙ্গে মানব হৃদয়ের যোগসূত্রের প্রকাশ্য ব্যঞ্জনায়। আর এভাবেই আসে বিনয়ের সফলতা। তার ‘একটি গান’ কবিতাটির পাঠ নেয়া যাক- ‘ঢ = ০ এবং ণ = ০ বা ঢ = ০ = ণ বা ঢ = ণ শূন্য ০ থেকে প্রাণী ঢ ও ণ সৃষ্টি হলো এভাবে বিশ্ব সৃষ্টি শুরু হয়েছিল।’ ‘একটি গান’ কবিতায় বিনয় মজুমদার ‘সৃষ্টির উৎস’ অন্বষণের চেষ্টা করেছেন, কবির ভাষায় শূন্যবিন্দু থেকে। মূলত সৃষ্টির আঁধার খুঁজতেই কবি গাণিতিক এই ফর্মটির প্রয়োগ ঘটিয়েছে। বাংলা কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও বিনয়ের আগে কোন কবি প্রয়োগ করেছেন বলে জানা যায় না। আবার ‘সৃষ্টির উপায়’ কবিতায় তিনি বলেন- ‘শব্দ ব্রহ্ম। অর্থাৎ শব্দের আকার আছে। ‘সফেদা’ একটি শব্দ-ধ্বনি। এই শব্দের আকার সফেদা ফলটি যেমনি ঠিক তেমনি এর শব্দতাত্ত্বিক প্রমাণ আছে। ‘আতা’ একটি শব্দ-ধ্বনি। আতা শব্দটির চেহারা ঠিক আতা ফলটির মতো। পাঠক আপনিও এইরকম নতুন শব্দ দিয়ে ধ্বনি দিয়ে নতুন ফল বানাতে পারেন। একটি নতুন শব্দ-ধ্বনি ‘হিবয়া’। হিবয়া উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে একটি নতুন ফল দেখা যাচ্ছে।’ আসলে, এ-জাতীয় কবিতা শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় ‘গবেষণা’ এবং এ-জাতীয় কবিতা উজিয়েও বিনয়ের কবিতার মূল প্রতিপাদ্য হয়ে দাঁড়ায় এক ধরনের বিপন্নতাবোধ। আর আর তা থেকে সৃষ্ট মনোবৈকল্য। বিনয়ের কবিতার মৌলভাষ্য অনেকাংশে এই বক্তব্য সমর্থন করে। তবে ফাঁদে ফেলে কিংবা কারো চলার পথ রুদ্ধ করে প্রেমময় আখ্যান গড়া বিনয়ের মোটেও উদ্দেশ্য নয় বলে ধরা যায়। এখানে তার কাব্যবোধ প্রেমিকসত্তাকে প্রজ্ঞাবান করার পাশাপাশি জ্ঞানের গভীরতায় জারিত করে। বিনয় বলেছেনÑ ‘আমার সৃষ্টিরা আজ কাগজের ভগ্নাংশে নিহিত কিছু ছন্দে, ভীরু মিলে আলোড়িত কাব্যের কণিকা এখন বিক্ষিপ্ত নানা বায়ুপথে, ঝড়ের সম্মুখে। আমাকে ডাকে না কেউ নিরলস প্রেমের বিস্তারে।’ বিনয়ের কবিতার গভীর পাঠে বোঝা যায়, তিনি ‘বিরহের জীবন’কে একটি সমীকরণে মেলাতে চেষ্টা করেছেন। বাস্তব আর বিরহকে মুুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রেমের সত্যদর্শন খোঁজার চেষ্টা করেছেন। আর গণিতের সূত্রে জীবনের মর্মার্থ উপলব্ধি করেছেন বলেই কবিতায় ব্যক্তিক অভিনবত্ব, প্রেমের অভিভাষণ ভিন্নতর প্রকরণে উপস্থাপনে সক্ষম হয়েছেন। যদিও তার কবিতার গভীর পাঠে এক ধরনের মনোবৈকল্য ধরা পড়ে। জীবনের শেষভাগে রচিত কবিতায় তাকে কামোন্মাদ হতে দেখা যায়। নারীবাদী চিন্তায় তার জাগতিক সঙ্কল্প প্রকাশিত হয় বিচ্ছেদের প্রজ্ঞারূপে। জৈবিক মিথুন-সত্তায় আক্রান্ত বিনয় মজুমদার না পাওয়ার তীব্রতর বেদনা শব্দমাধুর্যে উপস্থাপন করেন ঠিকই কিন্তু তা অত্যন্ত নিচুস্বরে। যেমন ‘কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারী, ক্রমে-ক্রমাগত ছন্দিত, ঘর্ষণে, দ্যাখো, উত্তেজনা শীর্ষলাভ করে, আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে, শান্তি নামে। আড়ালে যেও না যেন ঘুম পাড়াবার সাধ করে।’ কাব্যবিশেষজ্ঞদের মতে, কবিতা হলো একজন প্রকৃত কবির জীবনচারিত অভিজ্ঞতার সারাৎসার, কবির বেদনাবিদ্ধ হৃদয় থেকে উৎসারিত আলোকপর্বমুখী বোধ। কবির বেদনা-অনুভূতির রূপান্তর-ক্রিয়া সম্বন্ধে ইতালীয় সমালোচক ও ভাববাদী দার্শনিক বেনেদেত্তো ক্রোচেও মনে করতেন- ‘চড়বঃরপ রফবধষরুধঃরড়হ রং হড়ঃ ধ ভৎরাড়ষড়ঁং বসনবষষরংযসবহঃ, নঁঃ ধ ঢ়ৎড়ভড়ঁহফ ঢ়বহবঃৎধঃরড়হ রহ ারৎঃঁব ড়ভ যিরপয বি ঢ়ধংং ভৎড়স ঃৎড়ঁনষড়ঁং বসড়ঃরড়হ ঃড় ঃযব ংবৎবহরঃু ড়ভ পড়হঃবসঢ়ষধঃরড়হ.’ অর্থাৎ, এর অর্থ দাঁড়ায় কবিতা কোনো তুচ্ছ অলঙ্করণ নয়, এটা উৎকর্ষতার ভেতরে গভীরভাবে প্রবেশ করার মতো একটি বিষয়, যা আমরা অতিক্রম করি অস্থির আবেগ থেকে ধ্যানের প্রশান্তির দিকে। বিনয় মজুমদারের কবিতাভাষ্যেও আত্মত্যাগ, দুঃখবোধ, মৃত্যুচেতনা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিঃসঙ্গচেতনা, স্মৃতিমুগ্ধতা গভীরভাবে সঞ্চালিত, যা ক্রোচের অভিজ্ঞানকেও সমর্থন করে। বিনয়ের আত্মজীবনী পাঠেও জানা যায়, নারী হৃদয়ের অনুগ্রহ লাভে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। ফলে আকাক্সক্ষার মনোজাগতিক জটিল ঘূর্ণন তার কবিতায় যে আলো-আঁধারের চিত্রকল্পে, নৈঃশব্দ্যে পরিক্রমণ করে তাকে কী আত্মবৈপরীত্য বলা যায়? এ প্রশ্ন এড়িয়েও সুলুক সন্ধানী পাঠক বোঝেন তার কবিতা ছুঁয়ে যায় গোপন আকাক্সক্ষার দরজাগুলো। তখন কবিতা হয়ে ওঠে হতাশ্বাস জীবনের পরিপূরক। পরিশেষে, এ কথা বলা বোধ করি অত্যুক্তি হয় না যে, বিনয় মজুমদারের কবিতা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে প্রবল আত্মমুখী ও হতাশাদ্ব্যর্থক, যা তাকে জীবনানন্দ পরবর্তী আধুনিক কবিতার রূপদক্ষ শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
×