ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আশরাফ পিন্টু

বই ॥ মুক্তিযুদ্ধের অনন্য উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

বই ॥ মুক্তিযুদ্ধের অনন্য উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত

শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা (১৫ এপ্রিল ১৯২৮-১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) রচিত ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে লেখা বাংলা সাহিত্যের একমাত্র উপন্যাস। এর রচনাকাল এপ্রিল থেকে জুন মাস। ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে বর্বর পাকবাহিনী নিরীহ বাঙালী জাতির ওপর যে অমানুষিক হত্যাযজ্ঞ চালায়, উপন্যাসটি শুরু করেছেন তিনি সেই ২৫ মার্চের ভোরের বর্ণনা দিয়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে বসে একটি জাতির যুদ্ধজয়ের আকাক্সক্ষা নিয়ে উপন্যাস রচনার মতো কাজটি সহজ ছিল না। যে কোন সময় শত্রুরা এসে তাকে মেরে ফেলতে পারত। তবে তখন তিনি বিপদ মুক্ত হলেও পরে তাকে জীবন দিতে হয়েছে শত্রুদের হাতেই। তবুও যুদ্ধের ময়দানে বসে যুদ্ধের প্রথম তিন মাসেই তিনি লিখে ফেলেছিলেন এই অমূল্য দলিলটি- যেখানে রয়েছে বাঙালী জাতির শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন এবং তার থেকে মুক্ত ও যুদ্ধ জয়ের প্রেরণা। উপন্যাস হচ্ছে বাস্তবজীবনের প্রতিচ্ছবি; অর্থাৎ বাস্তবজীবনের সম্ভাব্য ঘটনাবলীকে যখন লেখক কল্পনার রঙে রাঙিয়ে সুনির্বাচিত ঘটনা ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত করেন তখনই তা উপন্যাসের পদবাচ্য হয়ে ওঠে। অন্য কথায় বলা যেতে পারে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনদর্শন ও জীবনানুভূতি কোন বাস্তব কাহিনী অবলম্বনে যে বর্ণনাত্বক শিল্পকর্মে রূপায়িত হয় তাকে উপন্যাস বলে। উপন্যাসের সংজ্ঞা ও কাহিনী সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা রয়েছে ‘রাইফেল রোটি আওরাত’এ তেমন সংজ্ঞায়িত কাহিনী নেই। তবু কাহিনী তো একটা রয়েছেই। উপন্যাসের নায়ক সুদীপ্তর স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার সূত্রে আমরা খ- খ- অনেক কাহিনী জানতে পারি যার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এক বিশাল কাহিনী। এই কাহিনীর আকাশে ভেসে ওঠে আবদুল মলেক, আবদুল খালেক, সোবহান মৌলভী, গাজী মাসউদ-উর-রহমান, হাসিম শেখ, করিমন বিবি, পলিভাবী, বুলাদি, এমনি অনেক চরিত্র। সকলেই একই অবস্থার শিকার। কিন্তু কত বিচিত্র তাদের প্রতিক্রিয়া। তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব রূপায়িত হয়েছে একটা সাধারণ দ্বন্দ্বে; যার মধ্যে সুপ্ত রয়েছে মানুষের এক পূর্ণাঙ্গ জীবনসত্য পশুশক্তির বিরুদ্ধে মানবসত্তার সংগ্রাম স্পৃহার দুনির্বার আকাক্সক্ষা। এ গ্রন্থের নায়ক সুদীপ্ত শাহীন লেখকের শিল্পীমনের এক অপূর্ব সৃষ্টি। এ চরিত্রকেই কেন্দ্র করেই উপন্যাসের মূল কাহিনী বিকশিত হয়েছে এবং ধীরে ধীরে পরিণতি লাভ করেছে। উপন্যাসের প্রায় সব জায়গায়ই তার উপস্থিতি রয়েছে। অজ¯্র ঘটনা-উপঘটনার ভিড়ে সুদীপ্ত শাহীন হারিয়ে যায়নি। এ গল্পের নায়ক সুদীপ্ত শাহীন বাঙালীর আশা-আকাক্সক্ষা এবং সংকল্প-প্রত্যয়েরই প্রতীক। আবদুল মালেক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক, যিনি সমাজে বুদ্ধিজীবী হিসেবেও পরিচিত। স্বার্থপর এই ব্যক্তিটি পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সেবক। প্রকৃতগত দিক দিয়ে তিনি একজন মিথ্যাবদী ও ধুরন্ধর ব্যক্তি। ওই সময়ের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই চরিত্রটি গড়ে উঠেছে। তার ভাই ড. আবদুল খালেকও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বাঙালী জাতীয়তাবাদের ঘোর বিরোধী তিনি। তিনি তার ভাই আবদুল মালেকের চেয়েও বেশি ধুরন্ধর ও কপটচারী। শুধু কপটচারীই নন, তিনি একজন হীনমানসিকতার ব্যক্তিও; তার প্রমাণ মেলে তিনি যখন নারী অপহরণকারী পাকসেনাদের সাফাই গেয়ে বলেন, ‘আর্মির জেনারসিটি দেখুন, মেয়েদের ফেরত পাঠাবার সময় সঙ্গে চিকিৎসার জন্য তিন শো টাকাও দিয়েছে। দে আর কোয়াইট সেন্সিবল ফেলো।’ সোবহান মৌলবীর অন্তর ধর্মের পরিচয় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে এঁকেছেন ঔপন্যাসিক। তিনি একজন গোঁড়া ও সুবিধাবাদী চরিত্রের মানুষ। দুনিয়াতে একজাতের মানুষ আছে যারা ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে। ধর্মের আলো তারা পায়নি, পাওয়ার চেষ্টাও করে না। কারণ ধর্মকে ব্যবহার করে তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে থাকে। এই ভন্ড-, কাপুরুষ মিথ্যেবাদী জালিয়াতের চরিত্রটি লেখক নিপুণভাবে চিত্রায়িত করেছেন। এ উপন্যাসের দুটি উজ্জ্বল চরিত্র হলো হাসিম শেখ ও মহি উদ্দিন ফিরোজ। হাসিম শেখ সামান্য পুলিশ কর্মচারী কিন্তু তার দেশপ্রেম অত্যন্ত গভীর। তিনি সাহসী এবং সংকল্পও অতি দৃঢ়। মহি উদ্দিন ফিরোজ রাজনীতি করেন বটে, রাজনীতি তেমন বোঝেন বলে মনে হয় না। তবে তিনি একজন সত্যিকারের সহৃদয় ব্যক্তিÑসদালাপী ভদ্রলোক। যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ উপন্যাসের কোন প্রত্যক্ষ চরিত্র নন, তবুও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যে কোন গল্প-উপন্যাসে তার উল্লেখ না এসে পারে না। কেননা এই মহান নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কি না সন্দেহ। আলোচ্য উপন্যাসে ২৫ মার্চের পটভূমি বর্ণনা প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই তার কথা এসেছে। এখানে বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সকল বাঙালীর অনুপ্রেরণার উৎস রূপে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ মন্তব্য করেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ সাহেব একজন খাঁটি বাঙালী। তাই সরল এবং সরল ভাবেই প্রতারিত হয়েছেন।’ এ উপন্যাসে অনেক নারী চরিত্রের সাক্ষাৎ মেলে; এর মধ্যে কয়েকটি চরিত্র স্বল্প পরিসরে হলেও সেগুলো চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে এবং স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রকাশ করেছে। আমেনা বেগম এমনই একটি চরিত্র; যিনি ভাবাবেগের দ্বারা চালিত না হয়ে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি সঙ্কটময় পরিস্থিতিকে ত্বরিত সিদ্ধান্তে পারদর্শিনী। তার কর্তব্যনিষ্ঠা, ধীরস্থির স্বভাব উপন্যাসের বিস্তৃত বক্ষপটে তার স্বচ্ছন্দ পদচারণা এবং নারীসুলভ নমনীয়তা তাকে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পলিভাবী এ উপন্যাসের একটি ট্রাজিক চরিত্র। তিনি শিল্পী আমনে স্ত্রী। তার বুক থেকে তিন বছরের শিশুকন্যাকে ছিনিয়ে নিয়ে পাক সেনারা যখন চোখের সামনে হত্যা করে সেই মুহূর্তে তিনি শপথ নিয়েছিলেন অন্তত একটি পাঞ্জাবি অফিসারকে হত্যা করতে হবে। জীবন দিয়েও তিনি রক্ষা করেছিলেন তার প্রতিজ্ঞা। উপন্যাসের একেবারে শেষে বুলাদি এসে দেখা দিয়েছে। প্রথম সাক্ষাতে আমরা তার সম্পূর্ণ পরিচয় পাই না; দেখতে পাই একটা রহস্যের ঘেরাজালে তিনি বাস করছেন। ক্রমান্বয়ে সে রহস্যের আবহাওয়া কাটতে থাকে এবং সদ্য প্রস্ফুটিত পুষ্পের মতো বুলাদির ব্যক্তিত্ব পাঠকের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তিনি গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য; প্রকাশ্যে জামায়াতে ইসলামের সমর্থক শিক্ষিকা। শুধু রাজনৈতিক কারণেই তার প্রতি পাঠকের আকর্ষণ নয়, তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ দায়িত্ববোধ, বুদ্ধিদীপ্ত ও পরিহাসকুশল বাক্যলাপ এসবই মোহিত করে। এই চরিত্রটি লেখক অত্যন্ত দরদ দিয়ে অনন্য শিল্প মহিমায় চিত্রিত করেছেন। কথাশিল্পী আনোয়ার পাশা ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসে বাঙালী জাতির এক দুর্যোগঘন ঐতিহাসিক যুগ সন্ধিক্ষণের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীনের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিচারণের মাধ্যমে লেখক উপন্যাসটিকে বর্ণনা প্রধান করে ফেলেছেন; তাই চরিত্র চিত্রনের সম্ভবনা এখানে দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছে। তবে এ উপন্যাসে বর্ণিত ঘটনাবলীর একটা প্রশস্ত পশ্চাৎ ভূমি এঁকেছেন লেখক, যার সীমানা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত ব্যাপ্ত। অথচ তিনি মুখ্যত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত অবাধ বিচরণ করেছেন। সেদিনের সেই হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের ভয়াবহ মুহূর্তগুলিকে লেখক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার তুলি দিয়ে নিখুঁতভাবে অঙ্কন করেছেন। উপন্যাসটি বর্ণনা প্রধান হবার ফলে এর ভাষা কখনও ছন্দায়িত লালিত্য, আবার কখনও আবেগধর্মী হয়ে উঠেছে। যেমন, ‘আমনের বুক ভরে ফুটলো এক কথার সূর্যমুখী আমরা বাঙালী, স্বাধীনতার সূর্যের দিকে উন্মুখ একটি ফুলের নাম আমরা বাঙালী।’ তবে শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে যেটা প্রধান বিষয় তা হচ্ছে লেখক ঘটনার উর্ধে উঠে ঘটনা সম্পর্কে নির্লিপ্ত থাকতে পেরেছেন। লেখকের এই সংযত ও সংহত মানসিকতার কারণেই উপন্যাসটি সার্থকতা পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাহিত্যিক আবুল ফজলের উক্তিটি স্মর্তব্য, আনোয়ার পাশার এই বই কোন অর্থেই গদগদ বাক্যের পালা হয়নি। এ এক সংহত, সংযত নির্লিপ্ত শিল্পী মনেরই যেন উৎসারণ। চোখের সামনে ঘটা টাটকা ঘটনাবলীর উত্তাপ তার শিল্পসত্তাকে কেন্দ্রচ্যুত করেনি কোথাও। লেখকের জন্য এর চেয়ে প্রশংসার কথা আর হতে পারে না। উচ্চতর শিল্পকর্মের জন্য স্থান-কালের দূরত্বের প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে; আশ্চর্য, আনোয়ার পাশার জন্য তার প্রয়োজন হয়নি। যথার্থ শিল্পী বলেই হয় তো তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। ঘটনাকে ছাড়িয়ে পৌঁছাতে পেরেছেন ঘটনার মর্মলোকে। ঘটনার মর্মালোকে পৌঁছিতে পারাটা শুধু শিল্পীর শিল্প সচেতনারই পরিচায়ক নয়, এটা শিল্পীর সমাজচেতনারও পরিচায়ক। তাছাড়া শিল্পীর জীবনচেতনাও তার এই শিল্প সৃষ্টির মধ্যে বিধৃত। আনোয়ার পাশার কাছে ‘শিল্প’ আর ‘জীবন’ দুটি অবিচ্ছেদ্য সত্তা। ‘Art for life sake’ জীবনের মহত্ত্বর রূপটি তার এই রচনায় বিধৃত হয়েছে।
×