ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সমতাভিত্তিক অধিকার আদায়ে বেগম রোকেয়া

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

সমতাভিত্তিক অধিকার আদায়ে বেগম রোকেয়া

নাজনীন বেগম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়ার জন্ম। পিতা তৎকালীন ক্ষয়িষ্ণু জমিদার আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির বিস্তার শুরু হলেও মুসলমান সমাজ এই আলো থেকে অনেকটাই দূরে ছিল। ফলে রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া বেগম রোকেয়াকেও কঠোর অবরোধ প্রথা এবং ধর্মীয় বিধিনিষেধের কড়া শৃঙ্খলে শৈশব-কৈশোর পার করতে হয়। তার পরেও পারিবারিক কিছু লেখাপড়ার অনুকূল পরিবেশ রোকেয়াকে জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ করে তোলে। বিশেষ করে বড় বোন করিমুন্নেসা এবং ভাই ইব্রাহীম সাবেরের অনুপ্রেরণায় রোকেয়ার লেখাপড়ার ভিত্তি তৈরি হয়। নিয়মবদ্ধতার বেড়াজালে আটকে পড়া বেগম রোকেয়া বিয়ের আগ পর্যন্ত সেভাবে লেখাপড়ার সাধনায় ব্রতী হতে পারেননি। তার লেখায় আছে পর্দাপ্রথা এমন কঠিন কঠোর ছিল অবিবাহিতা মেয়েদের বহিরাগত মহিলাদের সামনে পর্যন্ত আসতে দেয়া হতো না। শিক্ষা বলতে ধর্মীয় শিক্ষা এবং পারিবারিক গৃহস্থালির কাজে নিয়মিত তালিম নেয়া। অভিজাত ভাষা হিসেবে প্রচলিত ছিল উর্দু। বিহারের উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে মাত্র ১৬ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয়। বিপতœীক সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে রোকেয়ার দাম্পত্য বন্ধন তার জীবনে একটি বিশিষ্ট মাইলফলক। নারী শিক্ষার প্রতি অনুরাগী সাখাওয়াৎ তার স্ত্রীর জীবনের মোড় পরিবর্তনে যে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করেন বেগম রোকেয়া বহু স্মৃতিচারণে তা উল্লেখ করেছেন। পারিবারিক আবহে বাংলা ভাষা তেমন গুরুত্ব না পেলেও মাতৃভাষার প্রতি বেগম রোকেয়ার দরদ তাঁকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। ইংরেজী ভাষায়ও ছিল তার অগাধ পা-িত্য। আর এসব ক্ষেত্রে স্বামীর সহযোগিতা তাকে এগিয়ে যেতে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখে। স্বামীর জীবদ্দশাতেই তার ‘মতিচূরে’র প্রথম খন্ড- এবং SultanÕs Omean বইটি প্রকাশিত হয়। রোকেয়া শুধুমাত্র নারী জাগরণের অগ্রদূত কিংবা নারী শিক্ষা পথিকৃৎই ছিলেন না, তার অদ্ভুত সৃজনশীলতা আজও আমাদের মুগ্ধ করে। ইংরেজীতে তার অনেক সৃষ্টিশীল রচনা থাকলেও মাতৃভাষাকে তিনি ভীষণ ভালবাসতেন। তার বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং চিঠিপত্রে এসবের উল্লেখ আছে। ১৯০৯ সালে স্বামীর মৃত্যু হলে নিঃসন্তান রোকেয়া একাকী এবং নিঃসঙ্গ হয়ে যান। নারী শিক্ষার প্রতি অনুরক্ত সাখাওয়াৎ হোসেন একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ হাজার টাকা রেখে যান। সে টাকায় প্রথমে বিহারের ভাগলপুরে পরবর্তীতে কলকাতায় সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল নামে বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠা হয়। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিলেন বলে ছোট ছোট বালিকাদের স্কুরে পড়ানোর জন্য তিনি বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করতেন। বাল্যবিয়ে মেয়েদের জন্য চরম অভিশাপ এবং নারী শিক্ষার সবচেয়ে বড় বাধা এ বোধ বেগম রোকেয়ার বরাবরই ছিল। যার কারণে তিনি বলেছিলন অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ের জন্য যে টাকা খরচ করতে হয় তার অর্ধেক খরচ করলে একটি মেয়ে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারে। অর্ধেক নারী জাতিকে পেছনে ফেলে সমাজ কখনও সম্পূর্ণ এবং সুস্থভাবে সামনে এগুবে না এই কঠিন সত্যটি বেগম রোকেয়া বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। যা অনেকটা তার যুগের অগ্রগামী চিন্তাধারা ছিল। তার মনে হয়েছিল সমাজের একটি চাকা যদি অতিদ্রুত এগুতে থাকে অপরটি যদি ঠিক সেভাবে পেছনে পড়ে যায় তাহলে সমাজ সমান তালে চলতে পারবে না। পদে পদে হোঁচট খাবে। একজন নারী হয়েও সেই অন্ধকার যুগেও তার ধর্মীয় দর্শন ছিল সময়কে অতিক্রম করার। ফলে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল তার স্বতঃসিদ্ধ। আর এই কারণে রাজা রামমোহনকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বেদ উপনিষদের বাংলার অনুবাদক হিসেবে এবং ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদায়, কারণ সে সময় ব্রাহ্ম ধর্মের নারীরাই শিক্ষার প্রতি সচেতন হয়ে ঘর থেকে বাইরে পা রেখেছিল। কঠোর পর্দাপ্রথাকে পেছনে ফেলে নারীদের যে সামনে এগিয়ে চলা সেটা ব্রাহ্ম সমাজেরই অবদান বলে তিনি মনে করতেন। তিনি শুধু যে নারী মুক্তির দিশারী ছিলেন তা কিন্তু নয় সব মানুষের স্বাধীনচেতা অবস্থান তাকে বার বার আলোড়িত করেছে। বিশেষ করে নির্বিত্ত, অসহায় চাষাদের নিয়ে তার যে মর্মবেদনা তা মূর্ত হয়ে আছে তার ‘চাষার দুক্ষু’ প্রবন্ধে। একসময় এ দেশে গোলাভরা ধান কিংবা পুকুর ভরা মাছ এই প্রবাদ বাক্যকে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তার মতে যারা কৃষির মেরুদ-, আমাদের মুখে অন্ন তুল দেয় তাদের অবস্থা কোন কালে কোন যুগে কখনই ভাল ছিল না। তিনি তার নিজের জেলা রংপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন গ্রামের উদাহরণ টেনে বলেছেন সাত ভাষা নামক সমুদ্র তীরবর্তী গ্রামের লোকেরা পখাল (পান্তা) ভাতের সহিত লবণও জুটাইতে পারিত না। তাহারা সমুদ্র জলে চাউল ধুইয়া ভাত রাঁধিয়া খাইত। রংপুর জেলার কোন কোন গ্রামের কৃষক এত দরিদ্র ছিল যে টাকায় ২৫ সের চাউল পাওয়া সত্ত্বেও ভাত না পাইয়া লাউ, কুমড়া প্রভৃতি তরকারি ও পাট শাক-লাউ শাক ইত্যাদি সিদ্ধ করিয়া খাইত। স্বভাব কবি বেগম রোকেয়া কবিতা তো লিখেছেনই, পাশাপাশি বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং সৃজনশীল রচনায় কাব্য-লক্ষ্মীর আরাধনা করতেন। ‘চাষার দুক্ষু’ প্রবন্ধে একটি ছোট্ট কবিতা উল্লেখ করার মতো এ কঠোর মহীতে চাষা এসেছে শুধু সহিতে; আর মরমের ব্যথা লুকায়ে মরমে জবর-আনলে দহিতে। অসহায়, দীনহীন কৃষকদের প্রতি কি পরিমাণ ভালবাসা আর মমত্ববোধ থাকলে তাদের এমনভাবে অনুভব করা যায়। ইউরোপীয় ধার করা শিল্প প্রযুক্তি আমাদের ঐতিহ্যিক কুটির শিল্পকে যেভাবে ধ্বংস করে দেয় সেটা বেগম রোকেয়াকে আহত এবং ক্ষুব্ধ করেছে। এক সময় তাঁতীরা চরকার সুতা দিয়ে তাঁতের কাপড় বুনত যা এ দেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনই মেটাত না তাঁত শিল্পীদের আর্থিক সংস্থানও হতো। নিপুণ কারুকার্য খচিত এই তাঁতশিল্প আমাদের বংশানুক্রমিক ঐতিহ্যকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিত। কিন্তু এখন কাপড়ের মিল হস্তশিল্পের সেই মহিমান্বিত ধারাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আর তাই নারী মুক্তি কিংবা নারী শিক্ষাই বেগম রোকেয়ার একমাত্র লক্ষ্য ছিল না সাধারণ মানুষরাও তার চেতনাকে নানা মাত্রিকে ভাবিয়ে তুলেছে। সবশেষে রোকেয়ার জীবনের লেখাপড়ার প্রাথমিক ভিত্তি যারা তৈরি করে দিয়েছেন তার সেই বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের এবং ভগিনী করিমুন্নেসা সম্পর্কে তার কিছু অনুভূতি উল্লেখ করা হলো। রোকেয়ার নিজের জবানীতে দাদা, আমি আশৈশব তোমার স্নেহ সাগরে ডুবিয়া আছি। আমাকে তুমিই হাতে গড়িয়া তুলিয়াছ। আমি জানি না, পিতা, মাতা, গুরু, শিক্ষক কেমন হয়Ñ আমি কেবল তোমাকেই জানি। জননী সময়ে সময়ে শাসন করিয়াছেন, তুমি কখনও শাসন কর নাই। তাই মাতৃস্নেহের কোমলতাও তোমাতেই অনুভব করিয়াছি। ‘পুরস্কার তিরস্কার হিত ইচ্ছা, থেকে সেরূপ হিতাকাক্সক্ষী শিক্ষকও তুমি আমার। আর বড় বোন করিমুন্নেসাকে উদ্দেশ্যে রোকেয়া যা বলেন আপাজানÑ আমি শৈশবে তোমারই স্নেহের প্রসাদে বর্ণ পরিচয় পড়িতে শিখি। অপর আত্মীয়গণ আমার উর্দু ও ফারসী পড়ায় তত আপত্তি না করিলেও বাংলা পড়ার ঘোরবিরোধী ছিলেন। একমাত্র তুমিই আমার বাংলা পড়ার অনুকূলে ছিলে। আমার বিয়ের পর তুমিই আশঙ্কা করিয়াছিলে যে, আমি বাংলা ভাষা একেবারে ভুলিয়া যাইব। চৌদ্দ বছর ভাগলপুরে থাকিয়া, বঙ্গ ভাষায় কথাবার্তা কহিবার একটি লোক না পাইয়াও যে বঙ্গ ভাষা ভুলি নাই তাহা কেবল তোমারই আশীর্বাদে। অতঃপর কলকাতায় আসিয়া ১১ বছর যাবত এই উর্দু স্কুল পরিচালনা করিতেছি; এখানেও সবাই পরিচারিকা, ছাত্রী, শিক্ষয়িত্রী ইত্যাদি সকলেই উর্দুভাষিণী, প্রাতঃকাল হইতে রাত্রী পর্যন্ত উর্দু ভাষাতেই কথা বলিতে হয়। আবার বলি, এতখানি অত্যাচারেও যে বঙ্গভাষা ভুলিয়া যাইনি, তাহা বোধহয় কেবল তোমারই আশীর্বাদের কল্যাণে।’ মাতৃভূমি, মাতৃভাষা, স্বজাতি, সাধারণ মানুষের প্রতি দরদী, সহানুভূতিশীল বেগম রোকেয়া তার সৃজনসম্ভার, বহুমাত্রিক সামাজিক কর্মযজ্ঞ এবং নিরলস জ্ঞান সাধনার পথিকৃৎ হিসেবে চিরদিন বাঙালী জাতিকে উৎসাহ আর সাহস যোগাবেন। ১৯৩২ সালে ৯ ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারী মাত্র ৫২ বছর বয়সে মারা যান।
×