ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পুনর্বাসনে দেয়া হয়েছে রিকশা, ভ্যান ও সেলাই মেশিন

মাদক ছেড়ে আলোর পথে বরিশালের ১২৮ মাদকসেবী ও বিক্রেতা

প্রকাশিত: ০০:১৯, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭

মাদক ছেড়ে আলোর পথে বরিশালের ১২৮ মাদকসেবী ও বিক্রেতা

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ দেশকে মাদক মুক্ত করতে হলে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের আরও দায়িত্বশীল এবং সৎ নিষ্ঠাবান হতে হবে। অর্থের বিনিময়ে যাতে কোন মাদক বিক্রেতা কিংবা মাদকসেবী ছাড়া না পায় সেদিকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। ১৪ বছর মাদকের অন্ধকার পথে পা বাড়িয়ে ঘর-সংসার তছনছ হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজন থেকেও হয়েছি বিচ্ছিন্ন। তাই নিজের উপলব্ধি থেকেই মাদক পরিত্যাগ করেছি। এখন থেকে আর কখনো মাদক সেবন করবো না। এমনটাই বললেন, মাদক ছেড়ে আলোর পথে ফিরে আসা জেলার বাকেরগঞ্জের মোঃ রাসেল। জেলার চিহ্নিত ১২৮ জন মাদকসেবী ও বিক্রেতা গত ২৯ নভেম্বর পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। ওইদিন নগরীর জেলা পুলিশ লাইনসে এক আড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করা ওইসব মাদক ব্যবসায়ীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য তাদের আর্থিক সহায়তাসহ রিকশা, ভ্যান এবং সেলাই মেশিন প্রদান করেছেন পুলিশ। মাদকের ভয়াবহ পথ ছেড়ে আলোর পথে আসার কথা বলেন, আত্মসমর্পণকারীরা। আর মাদকের বিস্তাররোধসহ চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের ভালো হওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্যই এমন আয়োজন বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বরিশাল রেঞ্জ পুলিশের চৌকস উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোঃ শফিকুল ইসলাম। জেলা পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মোঃ হাবিবুর রহমান। সূত্রমতে, গত পহেলা আগস্ট মোঃ সাইফুল ইসলাম বরিশালের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের পর জেলার দশ থানা এলাকায় ওপেন হাউজ ডে এবং কমিউনিটি পুলিশিং সভায় মাদক বিক্রেতা ও মাদকাসক্তদের অন্ধকারের পথ ছেড়ে আলোর পথে আসার আহবান করে আসছিলেন। পুলিশ সুপারের সেই আহবানে সাড়া দিয়ে জেলার ১০ থানার ১২৮ জন মাদক ব্যবসায়ী প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণ করেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি চৌকস ডিআইজি তাদের ফুল দিয়ে বরণ করার পর শপথবাক্য পাঠ করান। অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণকারীরা তাদের অন্ধকার জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলেন। আর কখনও মাদক বিক্রি কিংবা সেবন না করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তবে মাদকের বিস্তাররোধে পুলিশকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে বলেও তারা উল্লেখ করেন। আত্মসমর্পনকারী জুয়েল খান বলেন, তিনি মাদক বিক্রি এবং সেবন করতেন। মাদকের কারণে সমাজে তাকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। এ কারণে পুলিশের আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি আলোর পথে ফিরে এসেছেন। মেহেন্দিগঞ্জের মোঃ হাসান বলেন, তিনি নিজের উপলব্ধি থেকে মাদক ছেড়ে দিয়েছেন। এখন থেকে তিনি নিজেতো মাদক গ্রহণ করবেনই না, বরং যে মাদক সেবন করবে তাদেরকেও পুলিশে ধরিয়ে দেবেন। রিক্সাচালক মজিবর মুন্সি বলেন, মাদক সেবক কিংবা বিক্রি করলে মানুষ খারাপ বলে। তাই তিনি ভালো হতে চান। এ কারণেই পুলিশের আহবানে সারাদিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। এখন বাকী জীবন আর অন্ধকার পথে হাঁটবেন না। আত্মসমর্পণের উদ্যোক্তা জেলা পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, শুধু শাসন নয়, ভালোবাসার মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক সেবনকারীদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন তিনি। জেলার ১০ থানা এলাকায় ওপেন হাউজ ডে এবং কমিউনিটি পুলিশিং সভায় মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্তদের অন্ধকারের পথ ছেড়ে আলোর পথে আসার আহবানে সারাদিয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা আলোর পথে ফিরে আসার ক্ষেত্রে সহযোগিতা চেয়েছেন। যে কারণে পুলিশও তাদের এই সুযোগ করে দিয়ে বরিশালকে মাদকমুক্ত করতে প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আত্মসমর্পণকারীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য দেয়া হয়েছে বিভিন্ন সহায়তা। পরবর্তীতে তারা আবারও মাদক ব্যবসায় ফিরে যায় নাকি ভালো পথে চলে সেসব বিষয়েও নজরদারি করবে পুলিশ। পুলিশ সুপার আরও জানান, যাদের বিরুদ্ধে মাদক মামলায় গ্রেফতারী পরোয়ানা কিংবা দন্ডাদেশ রয়েছে তাদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হয়নি। পূর্বের মাদক মামলায় যারা জামিনে আছেন তাদের এবং যাদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে কিন্তু মামলা নেই তাদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। অতীতে যাদের মাদক মামলা রয়েছে তাদের আইন অনুযায়ী আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। আত্মসমর্পনকারী অধিকাংশ মাদকসেবী ও বিক্রেতা বলেন, তারা কেউ বন্ধুদের কবলে পরে বা হতাশা থেকে মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পরেছিলেন। এতে করে তাদের পরিবারের সাথে বিরোধ ও সমাজের মানুষ ঘৃনার চোখে দেখেন। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে পুলিশের সহায়তা করার আহবানে সাড়াদিয়ে তারা আত্মসমপর্ণ করেছেন। এখন থেকে তারা অন্যকেও মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করবেন। উল্লেখ্য, এ জেলার মাদকের স্বর্গরাজ্য হিসেবেখ্যাত গৌরনদী উপজেলাকে সর্বপ্রথম শতভাগ মাদক নিমূর্লের লক্ষ্যে গত ২ এপ্রিল গৌরনদী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে মোঃ ফিরোজ কবির যোগদান করেই স্থানীয় সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভা করে ঘোষনা করেছিলেন, “হয় গৌরনদীতে মাদক ব্যবসায়ীরা থাকবে, না হয় ওসি ফিরোজ কবির থাকবে”। মাদক নির্মূলে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিপ্ত শপথ নিয়ে কাজ শুরু করে ওসি ফিরোজ কবিরের দিনরাত অবিরাম চেষ্টা আর অভিযানের ফলে মাত্র একমাসের মধ্যে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের তিনি (ওসি) পাকড়াও করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওইসময় মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযানে থানা পুলিশ ইয়াবা, গাঁজা ও ফেন্সিডিলসহ প্রায় দেড় শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী ও সেবীকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিলো। সে সময় মাত্র একমাসের ব্যবধানে মাদক বিরোধী অভিযানে দক্ষিণাঞ্চলের প্রভাবশালী এক ইয়াবা ডিলারসহ প্রায় দেড় শতাধিক মাদক বিক্রেতা ও সেবীদের গ্রেফতার করেছিলেন ওসি ফিরোজ কবির। আর ওইসব ঘটনায় ৮৫টি মামলা দায়েরের পাশাপাশি উদ্ধার করা হয়েছিলো বিপুল পরিমান ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। সে সময়কার রেঞ্জ ডিআইজি বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওসি ফিরোজ কবিরের উপমা দিয়ে বলতেন পর্যায়ক্রমে গৌরনদীর মতো বিভাগের প্রতিটি জেলা ও থানায় মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হবে। কয়েকদিনের ব্যবধানে গৌরনদীতে যখন ৮০ ভাগ মাদক নিমূর্ল করা হয় সে সময়ই রহস্যজনক কারণে কোন অভিযোগ ছাড়াই চৌকস ওসি ফিরোজ কবিরকে গৌরনদী মডেল থানা থেকে বদলী করে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অর্ন্তভূক্ত করা হয়। ফলে ফের গৌরনদী এখন মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে। মাদকের ভয়াবহতা, কুফল ও মাদকাসক্তের লক্ষন সম্পর্কে ওসি ফিরোজ কবির বলেন, মাদক ও তার ভয়াবহতা সেই বুঝে যার ঘরে একটা মাদকাসক্ত সন্তান আছে। একটা পরিবারে ধ্বংসের জন্য একটা নেশাগ্রস্থ সন্তানই যথেস্ট। একটা সমাজ ধ্বংসের জন্য গুটি কয়েক মাদক ব্যবসায়ী যথেস্ট। সমাজ, দেশ, পরিবার আজ মাদকের হানায় এক ক্রান্তি লগ্ন পাড় করছে। মা বাবারা আজ তার বুকের মানিককে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন হতাশার মধ্যে। কিভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান মাদকাসক্ত, মাদকাসক্তি নির্মূলের আগে জানতে হবে, মাদকাসক্তির লক্ষণগুলি কি কি? কেউ মাদক গ্রহন করলে তার লক্ষণ কিভাবে অনুধাবন করা যায়, তা জানা একান্ত দরকার। ওসি ফিরোজ কবিরের মতে মাদকাসক্ত সন্তানদের, হঠাৎ করেই স্বাভাবিক আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। অন্যমনস্ক থাকা, একা থাকতে পছন্দ করা। অস্থিরতা প্রকাশ, চিৎকার, চেঁচামেচি করা। অসময়ে ঘুমানো, ঝিমানো কিংবা হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া। কারণে-অকারণে খারাপ ব্যবহার করা। অসংলগ্ন ও অস্পষ্ট কথাবার্তা বলা। কোথায় যায়, কার সাথে থাকে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিরক্ত হওয়া, গোপন করা কিংবা মিথ্যা কথা বলা। ঘর অন্ধকার করে জোরে মিউজিক শোনা। নির্জনস্থানে, বিশেষত বাথরুমে বা টয়লেটে আগের চেয়ে বেশি সময় কাটানো। রাত করে বাড়ি ফেরা, রাত জাগা, দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা। হঠাৎ নতুন অপরিচিত বন্ধু-বান্ধবের সাথে বেশি মেলামেশা করা। বিভিন্ন অজুহাতে ঘন ঘন টাকা পয়সা চাওয়া। স্বাভাবিক খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দেয়া। অভিভাবক এবং পরিচিত জনদের এড়িয়ে চলা। স্বাভাবিক বিনোদন মাধ্যমে ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। বাড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রমাগত টাকা পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র হারিয়ে যাওয়া এবং ঋণ করার প্রবনতা বেড়ে যাওয়া। এসব লক্ষণ প্রকাশ পেলে বুঝবেন আপনার সন্তানকে ভয়ঙ্কর ব্যাধি মাদকাসক্তিতে আক্রান্ত করেছে। নিরাময়ের জন্য জরুরী ব্যবস্থা নিতে হবে। তাই অভিভাবক বা পিতা মাতার উচিত হবে সন্তানদের প্রতি নিবিড় পর্যবেক্ষন বজায় রাখা। স্নেহের পরশ দিয়ে তাদের আগঁলে রাখতে হবে। তা না হলে তারা জীবন যুদ্ধের নষ্ট কীটে পরিণত হবে।
×