ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

১০ বছরে শ্রমিকসহ কৃষক পরিবার কমেছে ১৪ হাজার ॥ বেড়েছে মজুরি

কলাপাড়ায় কৃষি শ্রমিক শঙ্কট যথাসময় ধান কাটতে পারছেনা কৃষক ॥ ভরসা বাইরের শ্রমিক

প্রকাশিত: ০০:১৬, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭

কলাপাড়ায় কৃষি শ্রমিক শঙ্কট যথাসময় ধান কাটতে পারছেনা কৃষক ॥ ভরসা বাইরের শ্রমিক

মেজবাহউদ্দিন মাননু, নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ যেন উল্টোচিত্র। পাঁচ-সাত বছর আগেও আশি^ন-কার্তিকে বেকার থাকত কৃষিতে কামলা দেয়া শ্রমিকসহ এ পেশা সংশ্লিষ্ট হাজারো মানুষ। জমি-জিরেতহীন মানুষগুলো ঘুরত গেরস্ত পরিবারের কাছে। ভূমির মালিকরা পানির দরে শ্রম কিনে নিত। আর এখন বইছে উল্টোচিত্র। ওই দৃশ্যপট এখন বদলে গেছে। খুজে বের করতে হচ্ছে কৃষি শ্রমিক। দুই-আড়াই শ’ টাকা দৈনিক মজুরির বদলে এখন কৃষিশ্রমিকের মজুরি সর্বনি¤œ চার শ’ থেকে পাঁচ শ’ টাকা। তাও মিলছেনা। বরং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে কৃষি শ্রমিক এনে ভূমির মালিকরা জমির চাষাবাদ থেকে এখন কৃষাণ হিসেবে ধান কাটাচ্ছে। উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ। ২০০৯ সালে শুরু। যার গতির ধারা বহমান, বেগবান। এই উন্নয়নযজ্ঞে শামিল হয়েছে কৃষক শ্রেণির একটি বিরাট অংশ। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুত সংযোগ সড়কের উন্নয়নে মানুষ অটোবাইক, অটোরিক্সা, ক্ষুদে দোকান দিয়ে ব্যবসার পসরা বসিয়েছেন। চাহিদা বাড়ায় সবজির আবাদে ঝুকছেন কৃষিশ্রমিক। আবার কৃষকের ছেলে কৃষক হবে- এমন ভাবনার ধারা পাল্টে স্কুল-কলেজে পাঠাচ্ছেন। শিক্ষিত করার স্বপ্নে জীবন ধারা পাল্টে যাওয়ার মানসিকতাও প্রখর হয়ে উঠেছে। এছাড়া কৃষিতে আধুনিকতার ছোঁয়াও কৃষিশ্রমিকের কর্মপরিধি কমে গেছে। মোদ্দাকথা কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা কলাপাড়ায় শঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। স্থানীয় কৃষিবিভাগমতে, শতকরা ৮৫ ভাগের কৃষিশ্রমিকের হিসেব কমে এখন পৌছেছে ৪৪ ভাগ। ভূমির মালিকরা একসনা, বর্গা কিংবা সাত বছরের চুক্তিতে কাউকে দিয়ে জমিজমা আবাদ করছেন। আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যাদের জমি-জিরেত কম তারা এখন নিজের যা আছে তা নিয়েই ১২ মাস সবজির আবাদ করে জীবনের চাহিদা মেটাচ্ছেন। নির্দিষ্ট কৃষিশ্রমিকের সংখ্য আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। রীতিমতো বহু ভূমির মালিকরা ক্ষেতের পাকা ধান কাটা নিয়ে রয়েছেন সঙ্কটে। সরেজমিনে দেখা গেছে, টিয়াখালীর ইটবাড়িয়ায় মংলা উপজেলার ১৮ কৃষিশ্রমিক ধান কাটছিল মামুন হাওলাদারের। ২৪ নবেম্বর এই দলটি বরাবরের মতো এবছরও এসেছেন। এদের সরদার ফারুক হোসেন জানান, মামুন হাওলাদারের ৫২ বিঘা জমির ধান কাটবেন তারা। আরও অনেকের জমি রাখা রয়েছে। নিজেদের খরচে খেয়ে ধান কেটে মাড়াই করে আট মনে এক মন মজুরি পাবেন। দৈনিক প্রায় এক শ’ মণ ধান কাটতে পারছেন ১৮ জনে। মংলার মিঠাখালী সাহেবের মেট এলাকায় বাড়ি। মজুরি হিসেবে পাওয়া ধান থেকে চাল করে বাড়িতে সংসার পরিজনের জন্য চাল নিয়ে যাবেন। গেল বছর একেকজনে ১৪ মণ কুড়ি কেজি চাল পেয়েছিলেন। ইটবাড়িয়া গ্রামের তৈয়ব আলী জানান, আগে তিনি কৃষিশ্রমিক ছিলেন। হাল-চাষ করতেন। ধান কাটতেন। এখন আর করেন না। তার ভাষায়, ‘ কাদায় কাম করতে ভাল লাগেনা।’ অটো চালান পাকা রাস্তায়। মজুরিও বেশি পায়। মোঃ খোকন জানালেন, কৃষি কাজ ছেড়ে এখন ট্রলারে মাছ ধরেন। আগে আমজেদ মিয়ার হাল-চাষ করেছেন। কৃষক পরিবারে এখন উৎপাদন খরচ কমাতে যান্ত্রিকীকরন যোগ হচ্ছে ব্যাপকভাবে। যাতে কৃষি শ্রমের ক্ষেত্র থাকলেও শ্রমের সময়কাল কমে গেছে। আবার কৃষকরা তাঁদের এ পেশাকে অনেকটা মর্যাদাহীন কিংবা মানসম্পন্ন নয়, এমন মানসিকতাও রয়েছে। এজন্য তাঁরা তাদের সন্তানদের পেশায় না এনে শিক্ষিত করছেন। এ ক্ষেত্রে আগামি প্রজন্ম পেশা পাল্টে ফেলছে। উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা মোঃ মসিউর রহমান জানান, মূলত উৎপাদন খরচ কমানো, সময় কম লাগা, শারীরিক শ্রম কম দেয়ার মধ্য দিয়ে আধুনিকভাবে যান্ত্রিকীকরনের দিকে ব্যাপকভাবে ঝুকছে কৃষক। প্রযুক্তিগতভাবে তারা দ্রুত এগিয়ে যাওয়ায় এ পেশার শ্রমিক কম লাগছে। পাশাপাশি মর্যাদাসম্পন্ন পেশায় সন্তানদের নিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের কারণে অন্য পেশায় মজুরি বেশি পাচ্ছে। এ কর্মকর্তার দাবি সরকার যান্ত্রিকীকরন সুবিধার জন্য কৃষককে ব্যাপকভাবে আগ্রহী করছে। তবে কৃষি শ্রমিক ক্রমশ কমছে বলে তিনিও স্বীকার করেন। কৃষি বিভাগসুত্রে জানা গেছে, যেখানে ২০০৭ সালে কলাপাড়ায় ক্ষুদ্র, মাঝারি, বড় ও প্রান্তিক কৃষকসহ কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭১ হাজার। যা বর্তমানে নেমে এসছে ৫৭ হাজারে। তবে প্রবীণ মানুষের মতামত কৃষককে তাদের জায়গায় অর্থাৎ মাঠে রাখার নিবিড় পরিবেশ থাকতে হবে। কৃষিজমির ধরন পরিবর্তন করা যাবে না। উৎপাদনের সঙ্গে কৃষককে উৎসাহের মাধ্যমে সম্পৃক্ত রাখা প্রয়োজন। ন্যায্য বাজারমূল্য প্রয়োজন। সার-কীটনাশকের সহজলভ্যতা থাকতে হবে। নইলে শুধু কৃষি শ্রমিক নয় কৃষক পরিবার হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বলিপাড়া গ্রামের কৃষক নুরুল কবির জানান, তাদের সকল জমি একসনা কিংবা কট কওলা দেয়া। তার দাবি কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিও একটি কারন। ছোটবালিয়াতলী গ্রামের কৃষক রনি হাওলাদার জানান, তার আট বিঘা জমি তিনবছর আগেও চাষাবাদ করেছেন। এখন আর করেন না। একই গ্রামের মজিবর রহমান জানান, তার ২০ বিঘা জমি এখন আর চাষাবাদ করেন না। একসনা দিয়েছেন। এদের দাবি ঠিকমতো কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না। মোট কথা কৃষি শ্রমিক সঙ্কট ক্রমশ বাড়ছে এই জনপদে। যা কৃষিতে একটি নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কার কালো ছায়া ধেয়ে আসছে। ফলে বর্তমানে কৃষকরা ধান কাটা নিয়ে পড়েছেন কৃষি শ্রমিক শঙ্কটে।
×