ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

-মনিষ মালহোত্রা

দেখে দেখে শিখেছি

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭

দেখে দেখে শিখেছি

ধন্যবাদ হার্ভার্ড, আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। যে মানুষটা তেমন কোন পড়ালেখা করেনি, তার জন্য এই সম্মান অনেক বড়। মজার কথা হলো যে ‘ডিজাইন’ নিয়েও আমার কোন ডিগ্রী নেই। তাই ধন্যবাদ আবারও হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের প্রতি । আমি আমার জীবনের অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলাম মুম্বাইয়ের অন্ধকার এক সিনেমা হলে, আজ থেকে বহু বছর আগে। তখন হয়ত তোমাদের অনেকের জন্মও হয়নি। ছেলেবেলার বেশিরভাগ সময়ই সিনেমা দেখেই কেটেছে। কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই আমার মাকে, যিনি আমাকে কখনও নিরুৎসাহিত করেননি। মাকে আমি বলতাম, ‘তোমার এই শাড়িটা সুন্দর নয়। বরং অমুক নায়িকার শাড়ি আমার পছন্দ।’ মা বলতেন, ‘বুঝেছি, তুই আবার সিনেমা দেখে এসেছিস।’ আজ আমার কাজিনরা এখানে উপস্থিত আছে। ওরা জানে, পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে একসঙ্গে হলেই আমার একমাত্র লক্ষ্য থাকত সবাই মিলে সিনেমা দেখা। অতএব, আমার পুরো ছেলেবেলাই ছিল সিনেমা, সিনেমা আর সিনেমা। চলচ্চিত্রের রং, পোশাক, সুর সবসময় আমাকে মুগ্ধ করত। ইয়াশ চোপড়ার ঝকঝকে সিনেমাগুলো যখন দেখতাম আর ভাবতাম, ‘আহা, এমন একটা ফাইভ স্টার হোটেলে খাওয়ার সৌভাগ্য কি আমার কখনও হবে?’ ত্রিশূল নামে একটা ছবি দেখেছিলাম। ছবির একটা গানে গলফ খেলা, ইয়োগা করা, প্রেম আর পার্টির দৃশ্য অবাক চোখে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, পর্দার বাইরে যদি এসব দেখতে পেতাম! এত বড় বড় তারকার সঙ্গে কখনো কি দেখা হবে? এই বিশাল পৃথিবীতে আমি কি কখনও আলোড়ন ফেলতে পারব? এমন বড় বড় স্বপ্ন বুকে লালন করে পা রাখলাম কলেজে। কলেজে উঠে এবার ইংরেজী ছবি দেখা শুরু“ করলাম। স্কুলে পড়ালেখা তেমন শিখিনি, তবে ড্রয়িং ক্লাসে আঁকা শিখেছিলাম। রং করা শিখেছিলাম। এই শিক্ষাটাকে সম্বল করে আঁকাআঁকি চালিয়ে গেলাম। এর মধ্যে কলেজে একদিন এক বন্ধু মডেলিং করার প্রস্তাব দিল। বললাম, ‘বলিস কী! আমি পারব?’ সে বলল, ‘অবশ্যই।’ শুরু“করলাম মডেলিং। ১৯ বছর বয়সে বাবাকে বললাম, ‘আমি পৃথিবীটা দেখতে চাই।’ বাবা বললেন, ‘তুমি তো মডেলিং করছ। টাকা জমাও, তারপর যেখানে খুশি যাও।’ এরপর মডেলিংটা পুরোদমে করা শুরু“ করলাম। সেই আমলে শুধু মডেলিং করে আমি ৯০ হাজার রুপি জমিয়েছিলাম। জীবনে প্রথম ঘুরতে গেলাম সিঙ্গাপুরে, তারপর ব্যাঙ্ককে। নিজের টাকায় বিদেশে যাচ্ছি ভেবে কী যে গর্ব হচ্ছিল সেই সময় বলে বুঝাতে পারব না! ফিরে এসে এতটাই রোমাঞ্চিত ছিলাম যে ঠিক করে ফেলেছিলাম আমি এয়ার ইন্ডিয়ায় চাকরি করব। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো কলেজের সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষায় নিয়মিতই ফেল করছিলাম, কারণ আমার জ্ঞানের জগতে সিনেমা ছাড়া কিছুই ছিল না। এরপর কি করব একটা বুটিকের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ নিলাম। আমার মা-বাবা রীতিমতো আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘করছ কী? বিক্রয়কর্মী হিসেবে শুরু করেছ, শেষ পর্যন্ত তুমি কি দরজি হবে? মা বললেন এর চেয়ে বরং বাবার এয়ার কন্ডিশনের ব্যবসায় যোগ দাও।’ আমার বক্তব্য ছিল, ‘না, আমি হব সিনেমার পরিচালক। বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করার সময় আমি দরজির পাশেই বসতাম। খুব কৌতূহল নিয়ে তার কাজ দেখতাম। প্রশ্ন করতাম। ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলতাম। আর সারা দিন আঁকতাম। ম্যানিকুইনগুলোকে জামা পরাতাম। বলছি ১৯৮৮ সালের কথা, তখন ভারত ফ্যাশনের দুনিয়ায় মাত্রই নাম করতে শুরু“করেছে। পরিচালক হওয়ার ভূত তখনও মাথা থেকে নামেনি। ইচ্ছা ছিল ইয়াশ চোপড়ার সহকারী হব। একদিন বাড়িতে বললাম, ‘আমি ডিজাইনার হতে চাই।’ শুনে মা আঁতকে উঠলেন। ‘ডিজাইনার! মানে দরজি!’ আমি বললাম, ‘না, ডিজাইনার মানে দরজি নয়।’ বাড়িতে দুটি সেলাই মেশিন ছিল। আমি সালোয়ার-কামিজ বানানোর অর্ডার নিতে শুরু করলাম। এবার মায়ের মাথায় রীতিমতো বাজ পড়ল, ‘আমার ছেলে বাড়িতে বসে সালোয়ার-কামিজ বানায়, এ কথা পাড়া-প্রতিবেশীকে বলব কী করে!’ এমন সময় এক আলোকচিত্রীর সঙ্গে পরিচয় হলো, সে আমাকে শ্রীদেবীর সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে গেল। শ্রীদেবী তখন বিরাট তারকা। সময় টা তখন ১৯৯০ সাল। স্বর্গ ছবিতে জুহি চাওলার একটা গানে কাজ করার সুযোগ পেলাম। তখন চলচ্চিত্র জগতে তেমন কোন ডিজাইনার ছিলেন না। সিনেমা আর ফ্যাশন, দুটোর মানই খানিকটা নিম্নমুখী। তখন মনে মনে ভাবলাম এটাই সুযোগ। আমি যদি এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারি, তাহলে হয়ত নাম করতে পারব। বিদেশে গিয়ে ফ্যাশন নিয়ে পড়ার মতো আর্থিক অবস্থা ছিল না। দিল্লীতে গিয়ে যে পড়ব, সেটাও আমি চাইনি। কারণ সেখানে গিয়ে কোন আত্মীয়স্বজনের ঘাড়ে ভর করার ইচ্ছা ছিল না। ভাবলাম যা হয় হোক, কাজ শুরু“ করি। বয়স তখন ২৩। সেই সময় মডেলিং পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে আমি নায়ক-নায়িকাদের পোশাকের ডিজাইন করা শুরু“ করলাম। খুব দ্রুত আঁকতে পারতাম, তাই প্রথম দু-তিন বছর প্রচুর কাজ পেয়েছি। বাবা বলতেন, ‘করছ কী! এসব করতে গিয়ে মডেলিং ক্যারিয়ারটাও হারাবে।’ কিন্তু আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম। আর যাই হোক, বাবার এয়ার কন্ডিশনের ব্যবসা আমি করব না। আমিই প্রথম ভারতীয় ছবিতে চরিত্র অনুযায়ী নকশা করা শুরু করলাম। পোশাকের নকশা করার আগে জানতে চাইতাম, ‘চরিত্রের মেকআপ কেমন হবে? চুলের স্টাইল কেমন?’ অভিনয় শিল্পীরা বলত, ‘কস্টিউম ডিজাইনার কেন মেকআপের কাজে নাক গলাচ্ছে? তার কাজ তো জামা বানানো!’ মনে আছে, রাভিনা ট্যান্ডনের সঙ্গে একটা ছবিতে একবার পরিচালক বললেন, ‘আমি কিছু ওয়েস্টার্ন পোশাক চাই। নায়িকাকে যেন আবেদনময়ী দেখায়।’ আমি বললাম, ‘সিনেমার গল্পটা কী? নায়িকার চরিত্রটা কেমন?’ পরিচালক কড়া দৃষ্টিতে তাকালেন। ুভাবখানা এমন, ব্যাটা কস্টিউম ডিজাইনারের কত বড় সাহস, সে ছবির গল্প জানতে চায়! সেই সময়ের ‘ছোট’ পরিচালক আদিত্য চোপড়া, করন জোহর, রাম গোপাল ভার্মার সঙ্গে কাজ শুরু করলাম। রঙ্গিলা আর রাজা হিন্দুস্তানি ছবিতে কাজ করলাম। ১৯৯৫ সালে ফিল্মফেয়ার এ্যাওয়ার্ডের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন ‘কস্টিউম ডিজাইনার’কে পুরস্কৃত করা হলো, সেই মানুষটা আমি। আমি সুইজারল্যান্ড, লন্ডন, নিউইয়র্কে গেছি। দোকানে দোকানে ঘুরেছি। বেড়ানো, মানুষ আর ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি দেখাÑ এটাই আমার শিক্ষা। দেখে দেখে শিখেছি। চলচ্চিত্রে কাজ করার স্বপ্ন ছিল। আজ দেশসেরা প্রযোজক, অভিনয় শিল্পী, পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করছি। ডি-প্রজন্ম ডেস্ক সূত্র : ভোগ
×