ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ার উডবার্ন লাইব্রেরি

কালের সাক্ষী হাতে লেখা পুঁথি, প্রাচীন উপাখ্যান দুর্লভ গ্রন্থ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭

কালের সাক্ষী হাতে লেখা পুঁথি, প্রাচীন উপাখ্যান দুর্লভ গ্রন্থ

সমুদ্র হক সাদা কাগজ লালচে হয়েছে। চার ধারে একটু করে ক্ষয়েও গিয়েছে। সেদিনের বাইন্ডিং করা কাঠও কিছুটা ভেঙ্গে কাগজ থেকে খসে গিয়েছে। খুব যতনে ধরতে হয়। কাগজগুলো সাবধানে না ধরলে ছিঁড়ে যায়। লম্বা সাইজের এই কাগজে দোয়াত কালির কলমে হাতে লিখা আছে দূর অতীতের পুঁথি, প্রাচীন উপাখ্যান ও সাহিত্যকর্ম। কালের সাক্ষী হাতে লিখা তিন হাজারেরও বেশি পাতার এমন দুর্লভ মূল্যবান সম্পদ কোন রকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে বগুড়ার প্রাচীন উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরীতে। যা দেশের অন্যতম প্রাচীন। যেখানে বাংলা ইংরেজী সাহিত্যের অনেক প্রাচীন বই ঠাঁই পেয়েছে। সুষ্ঠু সংরক্ষণের অভাবে বিরল এই সম্পদ নষ্ট হওয়ার উপক্রম। লাইব্রেরিয়ান মোঃ রোকনুজ্জামান উদ্যোগী হয়ে কিছুটা সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছেন। প্রাচীন এই মূল্যবান সম্পদ রক্ষায় সরকারীভাবে সহযোগিতা খুবই অপ্রতুল। প্রায় পৌনে দুশ’ বছর আগে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বগুড়ার সাহিত্যপ্রেমী সুধীজনের চেষ্টায় করতোয়া নদীর তীরে (বর্তমানে স্টেশন ক্লাব) স্থাপিত হয় একটি পাবলিক লাইব্রেরী। এর ৫৪ বছর পর ১৯০৮ সালে তৎকালীন জেলা কালেক্টরেট জে এন গুপ্ত তদানীন্তন বাংলার লেফটেন্যান্ট গবর্নর স্যার জন উডবার্নের নামে লাইব্রেরীর নামকরণ করেন। সেই থেকে পরিচিতি উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরী। ১৯৩০ সালে এক অগ্নিকা-ে লাইব্রেরীটি আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর বগুড়ার নবাব পরিবারের সহযোগিতায় লাইব্রেরীটি স্থানান্তরিত হয় এ্যাডওয়ার্ড পার্কের ভিতরে উত্তর দিকে। এই শতকের প্রথম দিকে উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরী স্থানান্তর হয় পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায়। ২০১২ সালে লাইব্রেরীর রক্ষণাবেক্ষণ সরকার নেয়। নামকরণ হয় উডবার্ন সরকারী গণগ্রন্থাগার। বর্তমান লাইব্রেরীয়ান মোঃ রোকনুজ্জামানের উদ্যোগে দ্বিতল ভবনকে ত্রিতল করে তিন তলায় উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরী নামটি টিকিয়ে রেখে সেখানে পুরাতন লাইব্রেরীর প্রাচীন বই পুরনো বুক সেলফে সাজিয়ে রেখে জাদুঘরের মতো করে রাখা হয়েছে। দোতলায় রয়েছে উডবার্ন সরকারী গণগ্রন্থাগার। লাইব্রেরীর ক্যাটালগ অনুযায়ী ৪শ’ থেকে ৫শ’ বছর আগের দুর্লভ বইসহ অন্যান্য বই ছিল প্রায় ২৮ হাজার। লাইব্রেরী স্থানান্তর হওয়ার পর পুরনো অনেক বই নষ্ট হয়ে যায় ও কোন কারণে হারিয়ে যায়। প্রাচীন বইগুলো মধ্যে টিকে আছে ৮ হাজার ২শ’ ৫২টি। বর্তমানে মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫১ হাজার। বর্তমান লাইব্রেরীয়ান ২০১০ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর হাতের লিখা প্রাচীন পুঁথি ও উপাখ্যান সাহিত্য কর্ম উদ্ধার করেন। যা অনেকটাই বালির স্তরে ঢাকা ছিল। এছাড়াও অনেক প্রাচীন দুর্লভ বই যার কিছু বই পোকায় খেয়েছে। এগুলো যতনে সংরক্ষণ করে লাল সালু কাপড়ে বেঁধে রাখেন। কিছু বই বাঁধিয়ে নেন। হাতে লিখা পুঁথি ও উপাখ্যানের মধ্যে আছে- হীরণ্য কাশিপুর উপাখ্যান। যা লিখেছেন শ্রী মদজ্ঞানেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য। পুঁথি ও উপন্যাস পদ্মপুরাণ। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনসাদেবীর উপাখ্যান, গোবিন্দ কথামৃত, গুণ কীর্তন উপাখ্যান। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা, ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি, কয়েকটি পুরনো গেজেট যার মধ্যে অসমের প্রাচীন গেজেট। বিশ্বের বরেণ্য অনেক লেখকের বই ঠাঁই পেয়েছে এই লাইব্রেরীতে। গ্রন্থাগারিক বললেন, অভিজ্ঞ রসায়নবিদকে দিয়ে প্রাচীন এই সম্পদ ভালভাবে সংরক্ষণ করা গেলে বহু যুগ টিকিয়ে থাকবে। বিষয়টি তিনি ওপর মহলে জানিয়েছেন। তার ইচ্ছা ও আগ্রহ আছে দেশের অন্যতম প্রাচীন এই উডবার্ন লাইব্রেরীটির প্রাচীন বইগুলোকে নিয়ে একটি বই মিউজিয়াম বানানোর। বর্তমানে এই লাইব্রেরীর স্থায়ী সদস্য সংখ্যা ২২২ জন। প্রতিদিন গড়ে ৩শ’ জন পাঠক লাইব্রেরীতে গিয়ে পাঠ গ্রহণ করেন। লাইব্রেরীতে বগুড়ার ইতিহাসের দুর্লভ বই আছে। অনেক গবেষক এই লাইব্রেরীর বই পাঠ করে সমৃদ্ধ হচ্ছেন। যারা গবেষণা করতে চান তাদের বসবার আলাদা জায়গা করে দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা দেয়া হয়। লাইব্রেরীর প্রবীণ সদস্য এস এম কবির জানালেন, তারুণ্যের বেলায় এই লাইব্রেরীর সদস্য ছিলেন। কলেজ জীবনে এই লাইব্রেরীতে গিয়ে বসে অনেক নোট লিখেছেন। বর্তমানের তরুণ লাইব্রেরীতে গিয়ে বই পড়া ভুলেই গিয়েছে। লাইব্রেরীর আরেক প্রবীণ সদস্য মহল আরা পারুল বললে, বই পড়া ছিল নেশার মতো। বইয়ের মধ্যে ডুব দিয়ে জ্ঞানের ধারার স্রোতে ভেসে জীবনকে সুন্দর রাখা যেত। প্রজন্মের কাছে এ ধারা আমরা পৌঁছে দিতে পারছি না। লাইব্রেরীয়ান রোকনুজ্জামানের কথা : তিন উদ্ভাবন করেছেন বই পড়ার মাধ্যমে মনের অনেক অসুখ দূর হয়। বই হলো মানুষের মনের হাসপাতালের চিকিৎসা।
×