ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আধুনিক যুগেও কুয়া

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৫ নভেম্বর ২০১৭

আধুনিক যুগেও কুয়া

হাজারো তৃষ্ণায় ছটফট করলেও নলকুপের একফোঁটা বিশুদ্ধ পানি পাবার জো নেই। গোসল করতে গেলেও পুকুরের কর্দমাক্ত ঘোলা পানিই একমাত্র ভরসা। খেতে হবে একমাত্র কুয়ার (এঁদেরার) পানি। উন্মুক্ত কুয়োগুলোর গভীরতা প্রায় শতফুটেরও ওপর। বালতির কানায় দড়ি বেঁধে ওই গভীর কুয়া থেকে খাবার পানি তুলতে হয়। শহর এলাকায় যেমন বাড়ি বাড়ি টিউবওয়েল, পাম্প বা সাপ্লাইয়ের পানির ব্যবস্থা থাকে এমনটি নেই সেখানে। কয়েকটি পাড়া মিলে কোন বিত্তবানের বাড়ির খলিয়ানে একটি করে কুয়ো বসানো রয়েছে। সেই কুয়া থেকেই কয়েকপাড়ার নারীরা কলসি ভরে খাবার পানি সংগ্রহ করে থাকেন। সকালে-বিকেলে এসব কুয়ার পাড়ে পানি সংগ্রহে আসা নারীদের ভিড় জমে চোখে পড়ার মতো। বালতিতে পানি তুলে কলসি ভরিয়ে তারা কাঁকে পানির কলসি নিয়ে ছুটে যান নিজ গৃহে। ভাল রাস্তাঘাট না থাকায় মাঠ ভেঙ্গে, জমির আইল ভেঙ্গে, বর্ষায় কাদা-পানি ও খরার সময় ধুলাবালি উপেক্ষা করে তাদের অন্তত ১ থেকে দেড় কিমি দূর থেকে সংগ্রহ করতে হয় খাবার পানি। আধুনিক সভ্যতার এ যুগে এসেও এমন চিত্র চোখে পড়ে উত্তরের নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার সীমান্তবর্তী নির্মইল ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে। সারাদেশে বর্তমান উন্নয়নশীল সরকারের উন্নয়নের জোয়ার বয়ে চললেও নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নির্মইল এখনও বড়ই অবহেলিত। নেই কোন রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, নেই বিদ্যুত, নেই শিক্ষা ব্যবস্থা, নেই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, এমন কি সুস্থ জীবন যাপনের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থাও নেই এখানে। দেশব্যাপী উন্নয়নের জোয়ার বয়ে গেলেও উন্নয়নের এতটুকু ছোঁয়া লাগেনি এই নির্মইল গ্রামে। বিশেষ করে গ্রামে বসবাসরত হিন্দু ও আদিবাসীদের পাড়া মহল্লায় দুর্ভোগের যেন অন্ত নেই। যে গ্রামের নাম অনুসারে ‘নির্মইল’ ইউনিয়নের নামকরণ, সেই নির্মইল গ্রামেরই হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় স্বাধীনতার পর থেকে কোন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। সরেজমিনে দেখা গেছে, পত্নীতলা উপজেলার সীমান্তবর্তী নির্মইল ইউনিয়নের হিন্দু ও আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম নির্মইল, নাথুরহাট থেকে গাঞ্জাকুড়ি, পাড়শাঁওলী থেকে জামালপুর হিন্দুপাড়া পর্যন্ত রাস্তাঘাটের অবস্থা অত্যন্ত করুন। বর্ষা মৌসুমে কাদা-পানিতে একাকার ওইসব রাস্তা দিয়ে জুতা পায়ে হাঁটার জো নেই। রাস্তার কোন কোন স্থানে এঁটেল মাটির কাদায় মোটরবাইকের চাকা বসে আর চলে না। আবার খরা মৌসুমে রাস্তা তো নয় যেন ধুলায় একাকার। ভাল রাস্তা না থাকায় এলাকার কৃষক তাদের জমিতে উৎপাদিত ফসল সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে পারেন না। ফলে ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন তারা। ওই গ্রামগুলোতে এখনও কোন বিদ্যুত পৌঁছেনি। বিদ্যুত না থাকায় গ্রামগুলোর মানুষ এখনও অনেক পিছিয়ে পড়ে আছে। তবে ওই ইউনিয়নের গাঞ্জাকুড়ি ও ফাজিলপুর হিন্দুপাড়ায় বৈদ্যুতিক খুঁটি পোতা হয়েছে অনেকদিন আগে। এখনও তার টানা বা সংযোগ দেয়া হয়নি। কবে দেয়া হবে বলতে পারেন না সেখানকার বাসিন্দারা। নির্মইল গ্রামের বাসিন্দা পত্নীতলা উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ও নির্মইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি রমেন চন্দ্র বর্মন এলাকাটি অত্যন্ত অবহেলিত উল্লেখ করে প্রতিবেদককে বলেন, বিদ্যুত, রাস্তাঘাট ছাড়াও নির্মইল গ্রামে প্রায় ৮শ’ পরিবার বসবাস করলেও এ গ্রামে শিশুদের লেখাপড়ার জন্য কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় বা উচ্চ বিদ্যালয় নেই। কোমলমতি শিশুদের কাদাপানি ভেঙ্গে দূর-দূরান্তের স্কুলে যেতে হয়। নেই কোন আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। জরুরী চিকিৎসা নিতে গিয়ে ওই কাদাপানির রাস্তা ভেঙে যেতে হয়, সাপাহার অথবা পত্নীতলা সদরে। এছাড়া এলাকার আরও একটি বড় সমস্যা হলো বিশুদ্ধ পানীয়জলের অভাব। এলাকার মানুষ এই ডিজিটাল যুগে এসেও কুয়োর পানি খেতে হয়। গোসল ও ঘরকন্নার কাজ চলে পুকুরের পানিতে। সকালে ও বিকেলে বাড়ির নারীরা পার্শ্ববর্তী বাড়ি, পাড়া বা মহল্লা থেকে কলসি-বালতি ভরে কুয়ো থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করে থাকেন। গ্রামবাসীরা জানান, স্বাধীনতার পর এই নির্মইল গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কেউ এগিয়ে আসেনি। পত্নী তলা উপজেলার নির্মইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে চিহ্নিত হলেও এই ইউনিয়নের হিন্দু ও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার কোন উন্নয়ন নেই। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সরকারী আমলাদের কেন এমন বিমাতাসূলভ আচরণ, এলাকাবাসীর এমন প্রশ্ন উন্নয়নের রূপকার বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে। বিদ্যুত, রাস্তাঘাট, স্কুল স্থাপনের পাশাপাশি এসব এলাকায় সরকারীভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করে পানীয় জলের সঙ্কট নিরসনে স্থানীয় এমপিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সহায়তা কামনা করেছেন এলাকার উন্নয়ন বঞ্ছিতরা। -বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ থেকে
×