ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

উন্নয়ন ও খেলাপী সংস্কৃতি যমজ ভাই

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ২৪ নভেম্বর ২০১৭

উন্নয়ন ও খেলাপী সংস্কৃতি যমজ ভাই

গত বুধবারের খবরের কাগজ ধরে লিখলে অনেক অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর লিখতে হয়। কারণ ওইদিন অর্থনৈতিক যেসব বিষয়ের ওপর কাগজগুলোতে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে তার সবই সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন এর মধ্যে আছে রুগ্ন ‘ফার্মারস ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ।’ দ্বিতীয়ত আছে ঋণ খেলাপের খবর যা মারাত্মকভাবে বেড়ে চলেছে। তারপর আছে বিদেশে অর্থপাচারের একটা হিসাব। আরেকটি খবরে দেখলাম ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় আসছে ‘পরিবারতন্ত্র’। এ ধরনের খবর শুধু গত বুধবারের কাগজে নয়, প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা কাগজে ছাপা হচ্ছে। এসবের ওপর আমি লিখছি সেই স্বাধীনতার পর থেকে। যেমন খেলাপী ঋণের ওপর লেখা চোখের সামনে- দেখতে পাচ্ছি আমি খেলাপীদের কেউ কেউ এখন বিখ্যাত সংস্কৃতিসেবী ও বিজ্ঞজনদের আদরের জন। এসব এখন দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়েই আরও লিখতে হচ্ছে। কারণ দেখা যাচ্ছে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। দুই দিন পরে হয়ত বলতে হবে ‘উন্নয়ন ও ঋণখেলাপী’ পরস্পর যজম ভাই। এ জন্যই সবাইকে আগে ভাগে ভাবার কথা বলি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসের সঙ্গে মিল রেখে ভাবতে বলি। কারণ দেখা যাচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যতই বাড়ছে ততই দুর্নীতি বাড়ছে এবং ততই বাড়ছে ঋণ খেলাপ সমস্যা। একটি কাগজে দেখলাম ২০১৭ সালের সেপ্টম্বর মাস পর্যন্ত খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। আর এ পর্যন্ত অবলোপন করা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। দুটো মিলিয়ে দাঁড়ায় এক লাখ পঁচিশ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। কোন সন্দেহ নেই এই খেলাপীর খবর উদ্বেগের খবর, দুশ্চিন্তার খবর, লজ্জার খরব এবং নিশ্চিতভাবেই একটা স্পর্শকাতর বিষয়। তবে এর বিপরীতে একটা খবর হচ্ছে এসব টাকা বকেয়া এবং সব টাকার বিপরীতেই আদালতে মামলা আছে, মামলা চলছে। দাবি তামাদি হয়নি। বিচার-আচার চলছে। কিছু না কিছু টাকা আদায় হবেই। আর আদালত প্রক্রিয়া ব্যাংকগুলো ভালভাবে চালাতে পারলে সব টাকা সুদসহ আদায় হওয়ার কথা। এই কথাটা বললাম এই কারণে যে, লোকমনে ধারণা খেলাপী টাকা মানেই সবশেষ, টাকা মার গেছে, উদ্ধারের এক ভাগ সম্ভাবনাও নেই। এই ধারণাটা ঠিক নয়। তবে যে কথাটা বলা দরকার তা হচ্ছে খেলাপী ঋণের যে বোঝা তৈরি হয়েছে তার জন্য বড় ব্যবসায়ীদের প্রভাবশালী একটা অংশ, কিছু মাঝারি ব্যবসায়ী, ব্যাংকিং মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসমূহ এবং তার অসৎ কর্মকর্তারা দায়ী। এতে সন্দেহ নেই। তবে ব্যবসায়িক কারণকেও যুক্ত করতে হবে। যে কারণেই এই বোঝা তৈরি হয়ে থাকুক না কেন এই খেলাপী ঋণ আজ অর্থনীতির জন্য রক্তক্ষরণে পরিণত হয়েছে। একই রক্তক্ষরণের শিকার চীনা অর্থনীতি, ভারতীয় অর্থনীতিসহ বিশ্বের বহু দেশের অর্থনীতি। বিশ্বের খ্যাতনামা কাগজগুলো পড়লেই বোঝা যাবে যারাই শিল্পায়ন, বাণিজ্যায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয় পুঁজির জন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভর করেছে তাদের দশাও এক। প্রায় সব দেশেই চলছে ‘নিয়মনীতির অধীনে লুট’ (অর্গানাইজড বোরারি)। সবই ঘটছে ‘বিধিবিধানের মধ্যেই’। তা না হলে এত অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের অর্ধেক সম্পদের মালিক এক শতাংশ লোক হতে পারে না। এই এক শতাংশ লোককে ঈশ্বর বিশেষ ধরনের ‘মাথা’ দিয়ে দুনিয়ায় পাঠাননি। তারা সরকারের আনুকূল্যে ‘বিধিবিধানের’ মধ্যে সম্পদের পাহাড় গড়ে বিশ্বকে এক বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা দুর্নীতিকে উন্নয়নের অনুষঙ্গ করে তুলেছেন। এটাই খাঁটি কথা। বাজার অর্থনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, অবাধ বাণিজ্য ইত্যাদি ঋণখেলাপকে উস্কে দিয়েছে, দুর্নীতিকে উস্কে দিয়েছে, টাকা পাচারকে উস্কে দিয়েছে, আন্ডার ইন ভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংকে উস্কে দিয়েছে। সবই চলছে ‘ভোটের’ মেজাজে। তা না হলে ১১ বছরে কি করে সম্ভব চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করা? উল্লেখ্য, ৪৫ বছর এতগুলো ব্যাংক মিলে ব্যবসা করে ঋণখেলাপী তৈরি করল মাত্র সোয়া লাখ কোটি টাকার। অথচ এর বিপরীতে কিছু লোক মাত্র ১১ বছরে দেশ থেকে টাকা পাচার করেছে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা! তাহলে কি দাঁড়াল? সবই জানি এই ‘সোনার বাংলায়’ এক টাকার কাজ কমপক্ষে দুই টাকায় হয়। রাস্তাঘাট কিভাবে হয়, তার অবস্থা কি, মেরামত কাজ কিভাবে হয়। ঢাকায় ফুটপাথ, আইল্যান্ড বছরে কয়বার ভাঙ্গা-গড়া হয় তা দেখলেই বোঝা যাবে টাকা নিয়ে কি হচ্ছে। যদি এক টাকার কাজ দুই টাকায় হয় ধরে নিই তাহলে উন্নয়ন বাজেটের বার্ষিক খরচের অর্ধেকটাই হয় অপচয়-দুর্নীতি ইত্যাদি। এখানে বছরে কত টাকা হয়? পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর হাজার কোটি টাকা কমপক্ষে। ৪৫ বছরে কত হয়? এক টাকার বাল্ব কয় টাকায় কেনা হয় সবাই জানি। স্কুল নেই, এমপিওভুক্তি হয়। জেলে কয়েদিদের খাবার নেই। হাসপাতালে রোগীদের খাবার নিয়ে কি হয় সবারই জানা। মেরামত কাজের টাকা কিভাবে খরচ হয় সবাই জানি। এভাবে দেখলে রাজস্ব বাজেটের কম করে হলেও এক-তৃতীয়াংশ টাকা ‘অপচয়’ হয়। ভদ্রভাবে বললাম। তাহলে ৪৫ বছরে কত হয়? বিদেশী ঋণের টাকায় যে প্রকল্প হয় তার প্রকৃত খরচ কত সে সম্পর্কে প্রতি সপ্তাহে কাগজে ছাপা হয়। এখানে কত টাকা ‘অপচয়’ বা দুর্নীতি হয়। ৪৫ বছরে কত টাকা হয়? এবার সব খাতের ‘অপচয়-দুর্নীতি’র সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের ৪৫ বছরের সোয়া লাখ কোটি টাকার খেলাপীর অঙ্ক মিলালে কি দাঁড়ায়? এ বিষয়ে আমার আর কোন মন্তব্য নেই। রোগটা সার্বিক সামগ্রিক। ‘চিকিৎসা দরকার সার্বিক।’ এ ব্যাপারে অনেকেই পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কিছু কিছু অগ্রগতিও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে, সমাজ ঋণ খেলাপী বন্ধকরণে ও দুর্নীতি দমনে এগিয়ে না আসলে সরকার কতটুকু করতে পারবে? সবাই সহযোগিতা করলে এই রোগ দমনে আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একটা জায়গায় গিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। প্রসঙ্গত একটা কথা বলি। বিদেশে পাচারকৃত টাকা ফেরত আনার কথা। এসব কথা ভারত ও পাকিস্তানেও হচ্ছে। ফলাফল এখনও বড় কিছু দেখা যাচ্ছে না। এই অসফলতার কথা উল্লেখ করে অনেকেই একটা সুপারিশ করছেন। কি সেই সুপারিশ? জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী অনেক কার্যক্রম আছে। তারা দুর্নীতিলব্ধ টাকা স্ব-স্ব দেশে ফেরত আনতে সহায়তা করতে পারে। এর জন্য, শুনেছি, দরকার একটা পদক্ষেপ। সরকার অবৈধভাবে অর্জিত ও পাচারকৃত সকল অর্থ সরকারী আদেশে ‘জাতীয়করণ’ করবে। বিদেশ বাংলাদেশীদের সকল অবৈধ সম্পদ বাংলাদেশ সরকারের অনুকূলে জব্দ করা হবে। তারপর বিদেশী রাষ্ট্রগুলোকে বলা হবে ওইসব সম্পদের হিসাব বাংলাদেশকে দিতে। জাতিসংঘ এই উদ্যোগে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে বাধ্য। ফিলিপিন্সের মার্কোসের টাকা তারা সম্ভবত এভাবেই বিদেশ থেকে দেশে এনেছিল। আমার মনে হয় এ পথে এগোনো যায়। এটা কি রাজনৈতিকভাবে সম্ভব? আমি নিশ্চিত নই। অথচ আমার মনে হয় বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েও খুব বেশি কিছু করতে পারবে না যদি না সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারÑ সকলের সহযোগিতা থাকে। এর অনুপস্থিতিতে আমরা সবাই শুধু কথাই বলে যাব। ফলাফল হবে শূন্য। তাই নয় কি? পরিশেষে দুটো কথা বলব সামগ্রিক আর্থিক খাত নিয়ে। আর্থিক খাত দেশের ‘প্রাণবায়ু’। এটি নষ্ট হলে প্রচ- মূল্য দিতে হবে। আমরা সবাই ব্যাংক নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু আমরা কি জানি দেশের নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা কি? খবর হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান দ্রুতই খারাপ থেকে খারাপতর অবস্থায় যাচ্ছে। গত বুধবারের কাগজগুলোতেই এর ওপর খবর আছে যা রীতিমতো ভয়াবহ। ব্যাংকিং খাতের ওপর আলোচনার অন্তরালে পড়ে যাচ্ছে এসব লিজিং কোম্পানি নামক নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান। বীমা কোম্পানিগুলোর অবস্থা কি? খুবই খারাপ। ‘ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ (ইডরা) হওয়ার পরও এই খাতটিতে সুশাসনের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শেয়ারবাজার ওঠে-নামে। কারা যেন খেলছে ক্রমাগতভাবে। নতুন কোন শেয়ার বাজারে আসছে না। ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি ও শেয়ারবাজারÑ সবার অবস্থাই যদি নাজুক হয় এবং তা পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী তাহলে থাকে কি? অকর্মণ্যতা, অপদার্থতা, অদক্ষতা, অপরিণামদর্শিতা, দুর্নীতি, খেলাপী সংস্কৃতি, মাদক সংস্কৃতিÑ সবকিছু মিলে শেষ পর্যন্ত আমরা যে অবস্থায় পৌঁছেছি তার থেকে মুক্তির পথ খোঁজা জরুরী। উন্নয়ন থেকে দুর্নীতি, উন্নয়ন থেকে খেলাপী সংস্কৃতিকে আলাদা করা দরকার। লেখক : সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×