ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

৪১-এ পদার্পণে ঋষিজের আহ্বান

পৃথিবীর বুক থেকে সংঘাত ঘুচে যাক, অসাম্য মুছে যাক

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৩ নভেম্বর ২০১৭

পৃথিবীর বুক থেকে সংঘাত ঘুচে যাক, অসাম্য মুছে যাক

মোরসালিন মিজান ॥ গানের ভাষা বদলে গেছে এখন। গণমানুষের কণ্ঠটি আর বাজে না। সমাজে অন্যায় আছে। নতুন নতুন মাত্রা পাচ্ছে শোষণ নিপীড়ন। তবু অধিকাংশ গানে ‘আমি-তুমি।’ ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী খুব নতুন কিছু করছে, না, তাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। কিন্তু চির বিদ্রোহের গানগুলো তারা ঠিকই বাঁচিয়ে রেখেছেন। বাঙালীর ইতিহাস আন্দোলন সংগ্রামের। সেই আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাওয়া গণসঙ্গীত আজও গেয়ে চলেছেন দলের শিল্পীরা। এই ধারাবাহিকতায় বুধবার ২৩ নবেম্বর ৪১ বছরে পদার্পণ করে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী। ১৯৭৬ সালের এই দিনে যাত্রা শুরু করেছিল। তারপর দীর্ঘ পরিভ্রমণ। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অনেকে তাই পেছনে ফিরে গেলেন। হলো আবেগঘন স্মৃতিচারণ। গণসঙ্গীত নৃত্য আলোচনা এবং গুণীজন সম্মাননার মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হলো প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি বিরুদ্ধ সময়ে গঠন করা হয় ঋষিজ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকা-ের পর কক্ষচ্যুত বাংলাদেশ। আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরমে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মারাত্মক আক্রান্ত হচ্ছে। মার খাচ্ছে শেকড় সংলগ্ন চর্চা। এমন সময় নিজস্ব ধ্যান এবং চিন্তাকে সঙ্গী করে পথচলা শুরু করে ঋষিজ। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফবির আলমগীর। তার সঙ্গে ছিলেন নাইজার, কাজল, ফাহিম হোসেন, আসাদ, সালেকিন বাবু, ইউসুফ, রতন, কচি, ঝুরু, শুক্কুর, দস্তগীর, আদিল, সুরুজ, নাফিস, আনিস প্রমুখ। জানা যায়, প্রায় সবাই ছিলেন পপ-গানের প্রিয় পরিচিত মুখ। ঋষিজ তাই ব্যান্ড পরিচয়ে শ্রোতাদের সামনে আসে। আর আজকের ঋষিজ, অর্থাৎ, গণসঙ্গীতের ঋষিজ হয়ে ওঠে ফকির আলমগীরের প্রভাবে। ১৯৮১ সালে। এ সময় গণসঙ্গীত হয়ে ওঠে সময়ের দাবি। এ দাবি মেটাতে উদ্যোগী হয়ে প্রথমবারের মতো ঋষিজ’র কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি হন ফকির আলমগীর। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বহু বিখ্যাত গানের গীতিকার আলতাফ আলী হাসু। এর পর থেকে গানে গানে প্রতিবাদ। বিদ্রোহ। ফকির আলমগীরের ভাষায়, ১৯৬৯ সালে কিংবা ১৯৭১ সালে যেসব গান গেয়েছিলাম সেগুলো আবারও কণ্ঠে তুলে নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুণ্ঠিত হচ্ছিল যখন, যখন ইতিহাস বিকৃত হচ্ছিল, দেশ যখন অবৈধ স্বৈরশাসকের কবলে, ঋষিজ তখন প্রতিবাদ করল। আবারও গাইলÑ ভয় কী মরণে, রাখিতে সন্তানে/মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমররঙ্গে...। শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চনা ক্ষোভ বুকে গাইল ‘দুনিয়ার মজদুর ভাই সব’, ‘বিপ্লবের রক্ত রাঙ্গা ঝা-া ওড়ে আকাশে’, ‘কমরেড লেনিনের আহ্বান’ ইত্যাদি গান। বর্ণবাদ সাম্যবাদের কথা আসল ঘুরে ফিরে। ফকির আলমগীর গাইলেনÑ কালো কালো মানুষের দেশে...। এভাবে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকতার বোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে ৪১ বছরে পদার্পণ। এ উপলক্ষে সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতিসহ সব অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো হয়েছিল মিলনায়তনের ভেতর বহিরাঙ্গন। মওনানা ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মতো বিপ্লবী নেতারা ছিলেন। ছিলেন কবিতার রবীন্দ্রনাথ, শামসুর রাহমান। হেমাঙ্গ বিশ্বাস সুধীন দাশ। বাদ যাননি কালিকা প্রসাদও। ছবিতে মুখগুলো দেখতে দেখতে মিলনায়তনে প্রবেশ। অদ্ভুত একটা অনুভূতি! একই সময় মাইকে বাজছিল নজরুলের কারার ঐ লৌহ- কপাট/ ভেঙে ফেল্ র্ক রে লোপাট রক্ত-জমাট/শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী...। পুরনো কণ্ঠ। তবু রক্তে দোলা দিয়ে যায়। নিজের অজান্তেই মন প্রস্তুত হয়ে যায় ঋষিজ’র অনুষ্ঠানের জন্য। জাতীয়সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল আয়োজন। দলের শিল্পীদের নিয়ে মঞ্চে আসেন ফকির আলমগীর। দেশ মাতার প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জানানো শেষে গাওয়া সংগঠনের পরিচিতিমূলক গানটি। শিল্পীরা সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে যান, ‘আমরা ঋষিজ করিÑ/আমরা তো যাত্রিক ঋষিজের সন্তান/শতমুখে সুন্দর শুভগান গাই/ সেই গান প্রাণ ভরে শোনে/পুণ্যবান...।’ ছিল উদ্বোধনী সঙ্গীতায়োজন। নতুন লেখা গানে মানুষের পৃথিবী গড়ার আহ্বান। কথাগুলো এরকমÑ এসো আজ গড়ে তুলি মানবিক বিশ্ব/ থেমে যাক হিংসা ও হানাহানি দৃশ্য/পৃথিবীর বুক থেকে সংঘাত ঘুচে যাক/অসাম্য বৈরিতা কালিমাও মুছে যাক...। আয়োজনের উল্লেখযোগ্য দিক গুণীজন সম্মাননা। এদিন ঋষিজ সম্মান জানায় সাদি মুহম্মদ, লিয়াকত আলী লাকী, ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ ও শিমুল ইউসুফকে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট বাম নেতা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন ও সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। তাদের উপস্থিতিতে চার গুণীজনের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হয়। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের অবদানের কথা তুলে ধরা হয় অনুষ্ঠানে। পরে আবারও সঙ্গীতায়োজন। আবৃত্তি। দলীয় ও একক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সুন্দর একটা সময় কাটে উপস্থিত দর্শক শ্রোতার।
×