ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

নবান্ন-অভিজ্ঞান

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৩ নভেম্বর ২০১৭

নবান্ন-অভিজ্ঞান

হেমন্তের ঐশ্বর্য নবান্নে। হেমন্তের প্রকৃত পরিচয় নবান্নের ঘনঘটায়। বৈষ্ণব পদকর্তা পদ্মলোচন দাস মধ্যযুগে তাই হেমন্ত বন্দনায় নবান্নকে তুলে এনেছেন তাঁর পদ রচনায়- ‘অঘ্রাণে নতুন ধান্য বিলাসে সর্বসুখ ঘরে প্রভু কী কাজ সন্ন্যাসে।’ নতুন ধান্যে হয় নবান্ন। নবান্ন কেবল একটি অনুষ্ঠানমাত্র নয়। নবান্ন একটি ঐতিহ্য, নবান্ন সৃজন-মননের অফুরান উচ্ছ্বাস। কেবল নতুন ধান্যে তৈরি পিঠা বা পায়েসের মধ্যেই নবান্ন থাকে না থেমে। নবান্ন একটি বাঙালী চেতনার নাম। বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশের এক অনন্য সোপান। বিবাহিতা মেয়ে বছর শেষে শ্বশুরবাড়ি হতে বাপের বাড়ি আসে সে তো হেমন্তের নবান্নে, অগ্রহায়ণের ঘ্রাণে। বাপের বুকে নতুন ফসলের বল, গোলায় নতুন ধান। মেয়ে আসে বাপের কাছে সমৃদ্ধির বীণা হয়ে। কিষাণীর গায়ে নতুন কাপড় ওঠে, নাকে কিংবা কানে সোনার ধানে ওঠে সোনার নোলক কিংবা কানের ফুল। কার্তিকের মরা আর খরা কাটে আঘ্রনের প্রাণের উৎসবে। নবান্নের অন্ন পৌষে পিঠের পার্বণ আনে। পূর্ব পুরুষের উদ্দেশ্যে নতুন অন্নের কাকবলী প্রতীকীভাবে ঋণ স্বীকার করায় গুহাবাসী পূর্ব পুরুষদের যাঁরা সূচনা করেছিলেন প্রথম কৃষিকর্মের। আগেকার দিনে নবান্ন শুধু ব্যক্তি জীবনেই আনন্দের সঞ্চার করত না, নবান্ন রাষ্ট্রজীবনে নিয়ে আসত রাজ্য পরিচালনার মূল্যবান রসদ। রাজকীয় এই খাজনার সওগাত নিয়েই বুঝি বলতে চেয়েছেন নজরুল- ‘ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এলো কি ধরণীর সওগাত? নবীন ধানের আঘ্রানে আজি অঘ্রান হলো মাত।’ রন্ধনশিল্পের বিকাশ ও অঙ্কনশিল্পের চর্চার এক বড় উপলক্ষ নবান্ন। নবান্নকে ঘিরে রন্ধনকুশলীরা বিশ থেকে চল্লিশ পদের ব্যঞ্জন সৃজনে মনোনিবেশ করে। যারা আল্পনায় সিদ্ধহস্ত তারা চালের গুঁড়া জলে ভিজিয়ে আঁকেন বিচিত্র নকশা যাতে ফুটে উঠে ধানের ঐশ্বর্যের চেয়েও অধিক মনের ঐশ্বর্য। সুচিন্তার প্রসারিত দিগন্ত উন্মোচিত হয় ঘর লিপে-পুঁছে পবিত্রকরণে। নবান্নে কাজ বাড়ে কিষাণীর। নতুন ধান ঘরে তোলা, উঠোন লিপে তাতে সোনার ফসলের স্তূপ করা, ধান মাড়াই এবং সেই ধানকে ঢেঁকিতে ছেঁটে চালে পরিণত করা- এসব করতে করতেই দিন যায়। ফুরসত মিলে না মোটে। তবু তার মুখে হাসি অমলিন। কিষাণ বধূর এমন হাসিতেই বিমুগ্ধ জসীম উদ্দীন বলেছেন- ‘কিষাণের গায়ে গহনা পরায় নতুন ধানের কুটো এত কাজ তবু হাসি ধরে না মুখে ফুল ফুটো ফুটো।’ নবান্ন মানেই মেয়েলি গীতের ব্যাপক চর্চা। গ্রামের নারীরা একদিকে পিঠাপুলি বানায় নতুন ধানের চালে আর অন্যদিকে বালিকার দল নানা রকম মেয়েলি গীতে মাতিয়ে রাখে আসর। নবান্নে পিঠাপুলি তৈরির গান যেমন আছে তেমনি আছে ধান ভানার গান, নদীতে কলসি ভরার গান এবং বাসন মাজার গান। কৃষি প্রধান বাংলার অনন্য সংস্কৃতিতে নবান্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জনজীবন, জড়িয়ে আছে কৃষকের হাসি-কান্না। নবান্নের ধান আমন। বেশিরভাগ আমনই ভাসমান জাতের যার স্থানীয় নাম জলিধান বা পৌষধান। হাকালুকি হাওড়ে নবান্ন আসে বোরো ধানের সমৃদ্ধিতে। নবান্নের পিঠাপুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভাপাপিঠা, চিতই, দুধচিতই, দুধপুলি, পাটিসাপ্টা, তেলে ভাজা পাকানপিঠা, গোলাপফুল পিঠা ইত্যাদি। তৈরি হয় নতুন কাস্তে, ডালি, কুলা, চালুনি, ঝাঁটা, চাটাই ইত্যাদি। নগরে নবান্ন নামে নতুন ধান্যে নয়। পঞ্জিকা কিংবা বর্ষপঞ্জির তারিখে। নবান্নের নিজস্ব গীত এখানে ধ্বনিত হয় না। নাগরিক পিঠা উৎসবে বংশ পরম্পরা অধিত বিদ্যার প্রয়োগ নেই বরং রেসিপি বুকই এখানে ভরসা। নগরে নবান্ন আসে অগ্রহায়ণ আগমনের উছিলায়। আদতে নবান্নের মাধ্যমে অগ্রহায়ণ আসে, নাকি অগ্রহায়ণ নিজেই নিয়ে আসে নবান্ন? গ্রামে নবান্নই নিয়ে আসে অগ্রহায়ণকে। কিন্তু নগরে অগ্রহায়ণই নবান্নকে নিয়ে আসে তারিখের মারফতে। পল্লীর নবান্নে আছে ঘোলা জল-হাওয়ার শোভা কিন্তু শহুরে নবান্নে আছে ড্রইং রুমের চোখ ধাঁধানো জলসা। স্টেডিয়াম রোড, চাঁদপুর থেকে
×