ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ছাত্র পরিষদের ভিপি থেকে এমপি

প্রকাশিত: ০৩:১৬, ২১ নভেম্বর ২০১৭

ছাত্র পরিষদের ভিপি থেকে এমপি

১৯৫৮ সালে গাইবান্ধা কলেজ (তখন বেসরকারী কলেজ) থেকে আই এ পাস করে রংপুর কারমাইকেল কলেজে বি এ-তে ভর্তি হই। সে সময়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে যে কটি উঁচু মানের বেসরকারী কলেজ তার মধ্যে রংপুর কারমাইকেল কলেজ অন্যতম। ৯০০ বিঘা জমির ওপর ইন্ডো-সারসিনিক স্টাইলে নির্মিত সুন্দর কলেজের মূল ভবন, বড় বড় তিনটি হোস্টেল, অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষসহ সব অধ্যাপকের জন্য সুবিশাল বাসভবনসহ ১৯১৬ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমার আব্বাও এ কলেজ থেকে ১৯৩০ সালে বিএ পাস করেন। তার কাছ থেকে কলেজের সে সময়কার অধ্যক্ষ ডি, এন মল্লিক পরে ডি পি ঘোষ এবং অধ্যাপকদের মধ্যে হৃদয় রঞ্জন লাহিড়ী, হরেন চন্দ্র চন্দ, আর রুদ্রসহ অনেকের নাম ও কথা জেনেছি। আমাদের সময় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ব্যারিস্টার আসকার আলী (ইংরেজীতে এম, এ, লন্ডন ইউনিভার্সিটি), উপাধ্যক্ষ ছিলেন হৃদয় রঞ্জন লাহিড়ী। তিনি ১৯১৮ সালে এ কলেজে ইংরেজীর অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং আমার বাবারও শিক্ষক ছিলেন। লাহিড়ী বাবু বিয়ে করেননি। কলেজে তিনি ফাদার লাহিড়ী স্যার নামে পরিচিত। এ সম্পর্কে পরে জেনেছি যে ক্লাসে পাঠ্য হিসেবে বাইবেল পড়াতেন বলে তিনি ফাদার বলে পরিচিত। ৫৮-এর জুন মাসে কলেজ ছাত্র পরিষদের ১৯৫৮-৫৯ বছরের জন্য সাধারণ নির্বাচন হয়। পরিষদের সব পদে দুটি প্যানেলে দিয়ে প্রার্থী দেয়া হয় । তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে ‘কাফেলা’ বনাম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রশক্তির পক্ষে ‘ছাত্র ফ্রন্ট’ সরাসরি নির্বাচনে নামে । কলেজ অধ্যক্ষ সাহেবের নির্দেশে দেয়ালে বা অন্য কোথাও কোন পোস্টার সাঁটানো বা লেখা বন্ধ। কলেজ কর্তৃপক্ষের দেয়া দুই দলের জন্য অধ্যক্ষের রুমের সামনে চাটাই বাঁশ দিয়ে দুটি বড় করে পোস্টার টাঙ্গানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ নিয়ম আমরা দুই দলই মেনে নিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাই। কলেজ ছাত্র বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী প্রয়াত মোহাম্মদ জাকারিয়া কাফেলার পোস্টারগুলো হাতে লিখতেন। একটি বিভাগীয় সম্পাদকের পদে আমাদের প্রার্থীর নমিনেশন বাতিল হওয়ায় ওই পদে আমার বন্ধু ছাত্র ফ্রন্টের প্রয়াত গোলাম কবির নির্বাচিত হন। বাকি সব পদে আমাদের কাফেলার প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কাফেলার পক্ষে ভিপি পদে ওয়ালিউর রহমান রেজা (বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, গণপরিষদ ও বাংলাদেশ পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য), জিএস পদে আজিজুর রহমান (অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব, বাংলাদেশ সরকার), সহ সম্পাদক পদে আজিজুল হক (অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী), ক্রীড়া সম্পাদক পদে প্রয়াত মোস্তাফিজুর রহমান (বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ও জেনারেল), ম্যাগাজিন ও সাহিত্য সম্পাদক পদে রফিকুল হক (ছড়াকার, দাদুভাই বলে পরিচিত ও দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক) ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক পদে আব্দুল হাকিম (মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সাবেক গণপরিষদ সদস্য, বর্তমানে অসুস্থ হয়ে কুড়িগ্রামে আছেন), কমন রুম সম্পাদক পদে প্রয়াত তৈয়বুর রহমান (সরকারী কলেজের ডেমোনেস্ট্রেটর ছিলেন, পথ দুর্ঘটনায় কয়েক বছর আগে গাজীপুরে ইন্তেকাল করেন), মহিলা কমন রুম সম্পাদিকা পদে কাজী মালহাতুন নাহার বীথি (ছেলে মেয়ে ও নাতি নাতনি নিয়ে রংপুরের আলমনগরে বাস করছেন, মহিলা সদস্য পদে নির্বাচিত ফিরোজা বেগম (অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা, ঢাকা ধানম-ি সরকারী বালক বিদ্যালয়, বর্তমানে ঢাকার মোহাম্মদপুরে আছেন) সদস্য পদে শাহ তাসলিম উদ্দিন (বাড়ি দিনাজপুর, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন), সদস্য পদে মোহাম্মদ হোসেন বসুনিয়া (ভাল কবিতা ও গল্প লিখতে পারতেন। ১৯৫৭-৫৮ কলেজ ছাত্র পরিষদের ভি পি ছিলেন শামসুল আলম হিরু (বগুড়ায় ওর বাড়ি ছিল, পরে ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন), জি এস ছিলেন আওলাদ হোসেন (রংপুর বারে ওকালতি করতেন ও রংপুর আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেন)। তার দুজনেই ছিলেন ছাত্রলীগের মনোনীত। ১৯৫৬-৫৭ সালে ভি পি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মনোনীত সামসুদ্দীন আহম্মেদ (তিনি বাম রাজনীতি করতেন ও পার্বতীপুর কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন), জিএস ছিলেন ছাত্রলীগ মনোনীত মরহুম শামসুল হুদা (উনি বাংলাদেশে একজন আদর্শবান সাংবাদিক ছিলেন, ঢাকার কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন এবং একই সঙ্গে উচিত বক্তা ও ধার্মিক ছিলেন)। কলেজ ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে প্রতিবছর কলেজের ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো। সে সময়ে কলেজের এই ম্যাগাজিনে তিন ভাষায় লেখা ছাপা হতো। প্রথম দিকের পাতাগুলো ছিল বাংলায়, পরের পাতায় ছিল ইংরেজী তার পরের পাতাগুলোতে ছিল উর্দুতে। আমাদের সময়ে বাংলা বিভাগের সম্পাদক ছিলেন গোলাম মোস্তফা (ওর বাড়ি ছিল দিনাজপুর, পরে ঢাকার একজন নাম করা সাংবাদিক ছিলেন। ১৯৭১ ডিসেম্বরে পাকিস্তান বাহিনীর দালাল আলবদর বাহিনীর হাতে ঢাকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাকেও আমরা হারাই), ইংরেজী বিভাগে সম্পাদক ছিলেন লুৎফর রহমান (তিনি পরে অর্থনীতিতে ডক্টরেট করে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, বেশ কয়েক বছর আগে হৃদরোগজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন), উর্দর্ুু বিভাগে সম্পাদক ছিলেন নাজমুল হাসান। সম্পাদকরা লিখিত পরীক্ষা দিয়ে নির্বাচিত হতেন। কলেজের ফুটবল, ক্রিকেট, নাটক, সাংস্কৃতিক বিষয়ে সে সময়ে অনেক প্রতিভাবান ছাত্র ছিলেন। ক্রিকেটে সুনীল দত্ত (মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে কোচবিহারে গিয়ে দেখি তিনি সিপিএম এর জেলা নেতা) ও আশরাফ হোসেন। তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের রংপুর জেলা শাখায় সম্পাদক ও একজন ভাল ক্রিকেট খেলোয়াড়। এখন রংপুর গুপ্তপাড়ায় আছেন। জেলা বিএনপির এক নেতা। ফুটবলে ভাল খেলোয়াড় ছিলেন কুড়িগ্রামের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হাবিবুর রহমান খোকা ও দুলাল। নাটকে ছিলেন প্রণব বকশী, মোহাম্মদ আনসার ও আব্দুল হাদী প্রমুখ। তারা ইহকাল ত্যাগ করেছেন। মোহাম্মদ আনসার ঢাকায় চলচ্চিত্রে নায়ক হতেন। গানে ছিলেন প্রয়াত অজিত রায় (রতু)। তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতে বাংলাদেশের একজন নামকরা শিল্পী ছিলেন। রাজশাহীর এক ছাত্র জিএল হোস্টেলে থেকে পড়ত, নাম ছিল মতিন খান । ব্যায়ামে পারদর্শী ছিলেন। আমাদের ক্লাসে খুব ভাল ছাত্রী ছিলেন যিনি পরীক্ষায় প্রথম হতেন- রংপুর মুন্সীপাড়ার ফাতেমা ইসলাম ডাকনাম আনা। পরে ঢাকার কোন কলেজের দর্শনের অধ্যাপিকা ছিলেন। আমাদের পরের ব্যাচের আর একজন ভাল ছাত্রী ছিলেন- সৈয়দা শামসে আরা বেগম। ডাক নাম ইরানী। পরে ঢাকা সিদ্ধেশ্বরী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। কলেজে বিএ পড়ার সময় রংপুর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ’উত্তর বাংলা’ নামে পত্রিকা বেরোত। রংপুর শহরের সেন্ট্রাল রোডে ‘উত্তর বাংলা’র ছোট অফিস ছিল। সেন্ট্রাল রোডের সুলেখা প্রেসে কাগজ ছাপা হতো। আমি ছিলাম এর সম্পাদক, সহযোগী ছিল কারমাইকেল কলেজের ছাত্র প্রয়াত আমিনুল ইসলাম (ঢাকার সাংবাদিক), নাজাতুল আলম জেবীন, আব্দুল হাদি (পরে অধ্যাপক), গোলাম মোস্তফা (ঢাকায় সাংবাদিক শহীদ) প্রমুখ। আমরা কলেজ করে রাতে উত্তর বাংলার কাজ করতাম। বেসরকারী কলেজ হিসেবে সে সময়ে কলেজের গবর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন ড্রিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্র্রেট (এখন ডেপুটি কমিশনার), সদস্য ছিলেন রংপুরের নাম করা আইনজীবী প্রয়াত শীতল কুমার রায় চৌধুরী, মরহুম মোহাম্মদ হোসেন অধ্যক্ষ ছিলেন সম্পাদক। তখন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিছেন মরহুম এস এ খায়ের, সিএসপি। ১৯৫৮ সালের শেষের দিক পাকিস্তানে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করেন। সব রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করে দেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সব কলেজের নির্বাচিত ছাত্র পরিষদগুলো কাজ করছিল। এদের ওপর কোন বিধিনিষেধ ছিল না। শুনেছি আমাদের পরের কয়েক বছর ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্ররা কলেজের ’কাফেলা’ নামধারী নির্বাচনী দল নামে নির্বাচন করেছে। কারমাইকেল কলেজের ছাত্র পরিষদের ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমি সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠি। বিএ পাস করে গাইবান্ধায় যাই। বিরোধী দলের রাজনীতি করতে থাকি। ১৯৬২ গাইবান্ধা পৌরসভার কমিশনার (এখন কাউন্সিলর) নির্বাচিত হই। গাইবান্ধা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও রংপুর জেলা সাংবাদিক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হই। ১৯৭০ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে গাইবান্ধা সদর এলাকা থেকে এমপি নির্বাচিত হই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে চলে যাই। মুক্তিযুদ্ধের ৬ নং সেক্টরের সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে কাজ করি। বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে সহযোগিতা ও সংবিধান প্রণয়নকারী হিসেবে আমি স্বাক্ষর দেই। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে গাইবান্ধায় সাঘাটা, ফুলছড়ি এলাকা হতে বাংলাদেশের প্রথম পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হই। অনেক বয়স হয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির অন্যতম সদস্য। আমার সম্পর্কে এত কথা লেখার কারণ হচ্ছে, ১৯৫৮ সালে কারমাইকেল কলেজের ছাত্র ও কলেজ ছাত্র পরিষদের ভিপি নির্বাচন আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এই দেশের সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি মরহুম সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, গণপরিষদের প্রথম স্পিকার মরহুম শাহ আব্দুল হামিদ। দুজন রাষ্ট্রপ্রধান মরহুম সাদত হোসেন সায়েম ও এইচ এম এরশাদ এবং দুজন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ ও জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। একথা ভাবলে কারমাইকেলের জন্য আমার গর্বে বুক ভরে যায়। এই কলেজের অনেক প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে সাহিত্য, ক্রীড়া, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ প্রভৃতিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। ১৯৫৮ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি পরীক্ষার ফলে আমাদের কলেজের ছাত্রদের কৃতিত্বের কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। সেবার বিএসসি পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর দেখা যায় সব প্রার্থী পাস করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ বাদে প্রথম থেকে দশম স্থান অধিকার করেছে রংপুর কারমাইকেল কলেজের পরীক্ষার্থীরা। জীতেন্দ্রনাথ নামে কুড়িগ্রামের একজন দরিদ্র ছাত্র হয়েছিলেন প্রথম। ৭৮ বছর বয়সে আমি আজও কারমাইকেল কলেজের ঋণভার বয়ে বেড়াচ্ছি। ৫৮ বছর আগের দিনগুলোর কথা চিন্তা করলে আনন্দ পাই। কলেজের অধ্যাপক, ছাত্রদের মুখ খুব মনে পড়ে। যারা চলে গেছেন, তাদের জন্য করুনাময়ের কাছে রহমত কামনা করি। লেখক : প্রাক্তন সদস্য, বাংলাদেশ গণপরিষদ ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
×