ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অরুণ কুমার বিশ্বাস

রম্য কথন ॥ বিবাহবিষয়ক ঝুট ঝামেলা

প্রকাশিত: ০৩:১৪, ২১ নভেম্বর ২০১৭

রম্য কথন ॥ বিবাহবিষয়ক ঝুট ঝামেলা

শুরুটা তবে তুরস্কের বিজ্ঞ রসজ্ঞ মোল্লা নাসির উদ্দীনকে দিয়েই হোক। একবার তার এক বন্ধু চিরকুমার থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। কিছুতেই তার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ছে না। মানে তিনি কোনমতে বিয়ে করে উঠতে পারছেন না। নাসির উদ্দীন তাকে ডেকে নিয়ে চুপিচুপি বললেন, কি হে বন্ধুবর, বিয়ে করছ না কেন! মেশিন বেশি দিন ফেলে রাখলে যন্ত্রাংশে জং ধরে যাবে যে! বন্ধুটি আরেক কাঠি সরেস। তিনি বললেন, কী করি বল হে মোল্লা, জুত মতো মেয়েই জোটাতে পারছি না। মেয়ে পছন্দ হয় তো বংশ ভাল না। বনেদী পরিবার পেলে মেয়ে সুশ্রী নয়। আবার মেয়ে এবং বংশ- দুটোই যদি পছন্দ হয় তো, পাড়াপড়শী ভাংচি দেয়। বলে কিনা মেয়ের দাদির খেপামির ধাত ছিল! মোল্লা সাহেব সহাস্যে বললেন, তার মানে তুমি একজন নিখুঁত মানে পারফেক্ট মেয়ে চাও, তাই তো! বন্ধু সায় দিলেন, তুমি একদম ঠিক ধরেছ হে মোল্লা। পারফেক্ট কোন মেয়ের দেখা পেলে বিয়েটা আজই সেরে ফেলতুম। বয়স গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে, সে কি আর আমি বুঝি না! আমার হাতে আছে একজন। সবদিক থেকে ভাল। আমি হলফ করে বলতে পারি, এই মেয়েকে তোমার পছন্দ হবেই। মোল্লা নাসির উদ্দিন হাসলেন। কিন্তু মুশকিল কী জানো, সেও একজন পারফেক্ট ছেলেই খুঁজছে। তোমাকে তো সে বিয়ে করবে না। কারণ তুমি বড্ড খুঁতখুঁতে। একটু ভেবে দেখুন, অতীতের তুলনায় এখন বিয়ে নামক বস্তুটি খানিক দুর্লভ হয়ে উঠেছে। ক্যারিয়ার কিংবা রোজগারের ধান্ধা করতে করতে এ অতি প্রয়োজনীয় কাজটি অবজ্ঞাভরে অনেকেই ফেলে রাখছেন। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে সে ঠিক আছে। তাই হয়ত অনেকেই ভাবছেন, হোক না দেরি তাতে কী! নটি-ফরটিতেই না হয় ওসব করা যাবে। পাশ্চাত্যে শোনা যায় লাইফ শুরু হয় সেভেনটিতে। আমরা না হয় ফরটিতে শুরু করলাম। কিন্তু ভায়া, কর্তব্যকর্মে দেরি করে ফেললে কিন্তু আখেরে লস। কথায় বলে, কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস! শুনতে পুরুষতান্ত্রিক শোনালেও আমি বলি কি, সময়ে কাজ শুরু করলেই ভাল। অভিজ্ঞতারও একটা দাম আছে, নাকি! আমার এক বড় ভাই বিয়ে করে বাজেভাবে ফেঁসেছেন আর এখন রাগে-দুঃখে ফুঁসছেন। না না, বউ মন্দ নয়। গৃহকর্মে নিপুণা, সহবত জানে। সব ঠিক আছে, কিন্তু বড্ড অলস। নৈপুণ্য আছে বটে, তবে সংসারের কুটোটি নাড়তে অনাগ্রহ তার। বেচারা ভাইকে অফিস শেষ করে এসে রসুই ঘরে ঢুকতে হয়। মানে তিনি বউ পুষছেন। সঙ্গে উপরি পাওনা শ্যালক-শ্যালিকার অত্যাচার তো আছেই। এখানেই থামলে ভাল ছিল, বউয়ের আবার খুব হাতটানের স্বভাব। দুটো টাকা রোজগার করে ঘরে রাখার উপায় নেই। উপটান না কী যেন মাখতে মাখতে হাতটানের কামাই উসুল করে নেয়। ভাইজান তাই বেতন পেয়েই উর্ধশ^াসে ব্যাংকে ছোটেন। নইলে পোশাকের (প্যান্ট,শার্ট ও অন্তর্বাস) পকেট হাতড়ে বউ সব নিয়ে নেবে যে! শেষে আমি তাকে এক জবরদস্ত পরামর্শ দিলাম। বলি, ভাইজান, ভাবীকে আপনি জুয়া খেলা শেখান। দেখবেন, আপনার টাকা আবার আপনার হাতে ফিরে আসবে। বুদ্ধিটা মন্দ নয়। ভাবী টাকা এখনও মারে বটে, তবে ভাইয়ের সঙ্গে জুয়া খেলায় পেরে ওঠে না। তাই হাত সাফাইয়ের টাকা সব স্বেচ্ছায় ফেরত দিতে বাধ্য হয়। কী করে পারবে! পুরুষ মানেই পাক্কা খেলুড়ে! বলা হয় খুনসুটি বা কলহ-বিবাদ দাম্পত্যের নুন। বেশ ভাল কথা। কিন্তু এই নুন যখন বেশি হয়, মানে খুনসুটি খুনোখুনিতে গড়ায়, তখন কিন্তু আর তা মুখে রোচে না। রবিঠাকুর অবশ্য বলেছেন, দাম্পত্য প্রেম সর্বোত্তম। এর দ্বিবিধ মানে হতে পারে। দাম্পত্য জীবনে সেই মার মার কাটকাট প্রেম খুব একটা হয় না বলেই তা উত্তম। কোন কিছুর যোগান বেড়ে গেলে তার কোয়ালিটি, চাহিদা বা মূল্য অর্থনীতির নিয়মেই কমতে থাকে। আবার একথাও সত্যি যে, দাম্পত্য সম্পর্কে প্রেমের চেয়ে বেশি চাই চওড়া কাঁধ অর্থাৎ পারস্পরিক নির্ভরযোগ্যতা। নইলে সম্পর্ক টিকে না, ছেড়ে যায় নয়ত মারা পড়ে। মহামতি গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের স্ত্রীর নাম জ্যানথিপি। তিনি ঝগড়ায় বিশেষ পটু ছিলেন। বউয়ের ভালবাসার ঠেলায় প্রায়শ তাকে রাস্তায় রাত কাটাতে হতো বলে শুনেছি। রোমান্টিক কবি জন কিটস- আহা! তার দু’জন বন্ধুনী ইসাবেলা জোনস এবং ফ্যানি ব্রাউনি, কেউ কি তাকে খুব সুখী করতে পেরেছিল? আমরা অবশ্য তার বিনিময়ে পেয়েছি হাইপেরিয়ন, লামিয়া কিংবা ওড অন মেলান্কলির মতো উচ্চমার্গীয় কাব্য। প্রসঙ্গত নরনিপীড়নের কথা এসে গেল। দজ্জাল বউয়েরা নাকি শ^শুর-শাশুড়িকে রুটিবেলা বেলুনের নিচে চেপে রাখে! নারী নিগ্রহও তাই বলে কম নেই। আমি এমন ললনার কথাও শুনেছি, যারা কিনা বেহেড মাতালের গুঁতোর ভয়ে বিয়েই করতে চায় না। নারী তো নয় যেন খাঁচায় পোষা পাখি। তার স্বাধীনতা হরণ করে ভালবাসার বুলি শোনানো হয়! আবার কেউ কেউ বউয়ের কামাই খাবে, কিন্তু বউকে কারও সঙ্গে বাতচিৎ করতে দেবে না। বউয়ের অফিসে ছদ্মবেশে হানা দেবে বা স্পাই নিয়োগ করবে! এমন ছ্যাঁচড়ামো ধম্মে সয় বলুন! তবে কথা কী জানেন তো, হাঁড়িকুড়ি একখানে থাকলে ঝকমারি একটু হবেই। ওসব মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েই তবে সংসার করতে হয়। খুব বেশি রিএ্যাকশনারি হয়ে লাভ নেই, দিনশেষ ফিরতে হবে তো সেই বিয়ে করা বউয়ের কাছেই। প্রেয়সী একবেলা হয়ত লাস্যময় হেসে আইসক্রিম বা কোল্ড কফি বানিয়ে দেবে, নিত্য দুবেলা খাবার কিন্তু মুখে তুলে দেবে না। তাই সাধু সাবধান! যা করবেন বুঝেশুনে করুন। পানিতে নামলে ভিজবেন, আগুনের কাছে গেলে টুকটাক ছ্যাঁকা খাবেন- তাই বলে লড়াকু পুরুষ কি বিয়ে না করে পারে! ইদানীং অবশ্য আমার যুবক বন্ধুদের প্রায়ই বলতে শুনি, কী দরকার ভাই শখ করে বুকে একখানা বিবাহিতের তক্মা আঁটার! এই বেশ ভাল আছি। টুকটাক প্রেম করি, অফিস-কলিগ সহচরী। তাছাড়া বিয়েতে সুখ নেই। ‘বিপদ বাড়ানো হলো’ মানে বিবাহ। দ্বন্দ্ব সমাস। বা বলা যায় (নারীটিকে), বিশেষভাবে বহন। মানে কলুর বলদ। তাই আপাতত যদি কেউ চিরলাউ থুক্কু চিরকুমার থাকার সদয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তবে তাকে নিছক নির্বোধ বলা যায় না। লেখক : রম্যলেখক
×