ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের সত্য ও জাতীয় ঐক্য

প্রকাশিত: ০৩:১৩, ২১ নভেম্বর ২০১৭

ইতিহাসের সত্য ও জাতীয় ঐক্য

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যে’ স্থান পাওয়া উপলক্ষে শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত নাগরিক কমিটির সুবিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তা সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ইতিহাস সত্যকে তুলে ধরে, ইতিহাস প্রতিশোধ নেয়, ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এটি অস্বীকার করার আদৌ কোন উপায় নেই যে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলাসহ যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান। এমনকি পরবর্তীকালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পুনর্গঠনেরও যথাযথ দিকনির্দেশনা হচ্ছে এটি। অথচ দুঃখজনক হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মম-নৃশংসভাবে হত্যার পর তৎকালীন সরকার মেতে ওঠে ইতিহাস বিকৃতির হীন প্রচেষ্টায়। তারা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে। রেডিও-টেলিভিশনসহ প্রায় সর্বত্র সবখান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে ফেলার ঘৃণ্য অপপ্রয়াস চালায়। জিয়া-এরশাদ আমল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর ধরে এই প্রচেষ্টা চলে। দীর্ঘ সংগ্রাম, আন্দোলন ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে হলেও সত্য উন্মোচিত হতে থাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে। যদি তা না হতো তাহলে হয়ত চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতে পারত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস। তবে এও সত্যি যে, দেশ ও জাতির ঐতিহাসিক এবং অনিবার্য প্রয়োজনে ইতিহাস তার অমোঘ ও অমিত শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর পর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশের ব্যাপ্তি ও বিশালতা ইতিহাসের সেই পুনরুত্থানকেই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। অতঃপর সেই ইতিহাসকে অবিকৃত ও চিরস্থায়ী সত্য হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালী জাতিকে সদা জাগ্রত ও সচেতন থাকার আহ্বানটি অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ এবং গুরুত্ববহ বৈকি। অবশ্য চক্রান্তকারীদের সেই হীন প্রচেষ্টা যে থেমে গেছে এমন বলা যাবে না। গত বছর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নিজদলীয় এক মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে মন্তব্য করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। হঠাৎ করে কেন তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তা বোধগম্য হয়নি অনেকেরই। ফলে স্বভাবতই এর জের ধরে তীব্র বিতর্ক ও বাদানুবাদ শুরু হয় রাজনৈতিক মহলে এবং সারাদেশে। গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সর্বোপরি সরকারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ নিয়ে জানায় তীব্র প্রতিবাদ। জনসভা, মিছিল-মিটিংও হয়েছিল রাজধানীসহ সারাদেশে। একাধিক মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির চিরদিনের অহঙ্কার ও গৌরবের। সবাই জানেন অন্ততপক্ষে ত্রিশ লাখ শহীদান ও তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সর্বজনীন সত্য। জাতীয় সংবিধানেও ৪টি মূলনীতিসহ বিষয়টি লিপিবদ্ধ আছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে যে বা যারা বিতর্ক সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালায় তারা সংবিধানবিরোধী। প্রকারান্তরে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করতে চায় না। উপরন্তু মহল বিশেষের পক্ষে কাজ করে পানি ঘোলা করে মাছ শিকার করতে চায়। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক রায়ে বলেছে, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষের শহীদ হওয়া ও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জন প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস। এই ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র আবেগ ও গৌরবের মধ্যে মিশে আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু একটি মীমাংসিত বিষয় এবং ত্রিশ লাখ শহীদানসহ তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানিও, সেহেতু তা নিয়ে কারও কোন বিতর্ক বা বক্তব্য রাখার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে যথাসম্ভব আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। তাহলেই দেশ অসুস্থ বা রুগ্ন রাজনীতি থেকে মুক্ত হবে।
×