ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের অতিথি

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২০ নভেম্বর ২০১৭

শীতের অতিথি

প্রকৃতিতে আসছে শীত। শীতের শোভাময় দৃশ্য আরও বাড়িয়ে তুলবে অতিথি পাখি। আমরা সবাই অতিথি পাখির কথা কম বেশি জানি। প্রতিবছর শীতের আগাম বার্তা প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ঠিক আমাদের দেশে এসে পৌঁছে। আমাদের আশপাশের জলাশয়, দীঘি, বিল, হাওড় কিংবা পুকুর ভরে যায় ছোটবড় নানা ঢঙের আর রং-বেরঙের জানা-অজানা পাখিতে। এসব পাখি শীতের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য এই ভ্রমণের ব্যবস্থা করে। শীত প্রধান সুদূরের সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন ইত্যাদি দেশে যখন শীত মৌসুম আসে তখন ওইসব দেশে তীব্র শীতের প্রকোপ। তাছাড়া শীত মৌসুমে দেখা দেয় তীব্র খাদ্য সঙ্কট। এমন অবস্থায় পাখিদের জীবনে বড়ই দুঃসময় হয়। জীবন বাঁচানোর তাগিদে শত শত হাজার হাজার মাইল দূরের কম শীতের আবহাওয়ার দেশে পাড়ি দেয় অতিথি পাখিরা। অতিথি পাখিতে মুখরিত হয়ে উঠে আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতি। শীতের ভোরে কল-কাকলিতে সোনালী বৃহৎ এই বদ্বীপ পুঞ্জী দেশে ঘটে অতিথি পাখির আগমন। শীতে দক্ষিণের বাতাস বয়ে বেড়ায় সুদূর থেকে আসা অতিথি পাখির পাখনা ঝাপটানোর নান্দনিক ছন্দে। বাহারি রঙে রূপসী বাংলা যেমন অপরূপ সাজে ভরে, ঠিক তেমনই অতিথি পাখির আগমনে জলাশয়গুলোও সৌন্দর্যের আরও গহীন সীমান্তে হারিয়ে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে ভিনদেশী বাহারি রঙের অতিথি পাখিরা যখন এক সঙ্গে বিচিত্র স্বরে ডাকতে ডাকতে আকাশে খেলা করে তখন অসাধারণ এক মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। বিষণœতায় ভরপুর মনটা অতিথি পাখির কলকাকলি আর সৌন্দর্যের জাদুবলে প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। অতিথিদের এই অনাবিল সৌন্দর্য দেখতে ভিড় করে শত শত পাখি প্রেমীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জলাশয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জলাশয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জলাশয়, হাকালুকি হাওড়, চলনবিল, টাঙ্গুয়ার হাওড় কিংবা বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার ইত্যাদি জায়গায় পাখি পেমীদের সমাগমে সরগরম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়। তবে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহারে সারা বছরই অতিথি পাখি থাকে। অতিথিপাখির স্থায়ী আবাসস্থল দেখে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এলাকাকে ‘পাখি রাজ্য’ নামে চিহ্নিতকরণ করেছেন। ফলে ভাসুবিহারের প্রতি পর্যটকদের যেমন আগ্রহ বাড়ছে ঠিক তেমনই এই সব এলাকার মানুষের আয়ও সেই সময়টাতে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায় পর্যটকদের কল্যাণে। অতিথি পাখি শুধু প্রকৃতির শোভা বর্ধনশীল পাখিই নয় এটি পাখি প্রেমীদের মনের তৃষ্ণা মেটানোর এক অপরাপর মাধ্যম। এগুলো আমাদের দেশের সৌন্দর্য আর জীব বৈচিত্র্যের শোভাবর্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফুল ও শস্যেরক্ষেতে পোকা মাকড় এবং ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনে এরা। পোকামাকড় খেয়ে খেয়ে যেমন তাদের ক্ষুধা নিবারণ হয় ঠিক তেমনই আমাদের ক্ষেত খামারের জন্যও তা বেশ উপকার। অতিথি পাখিরা আমাদের দেশে এসে যেমন জলজ উদ্ভিদ খেয়ে ফেলে ঠিক তেমনি এতে আমাদের জলজ পরিবেশেরও ভারসাম্য রক্ষা হয়। অতিথি পাখির মল জলাশয়ে মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শীতকালের অতিথি পাখিরা শীতের সময়টুকু বিভিন্ন জলাভূমিতে কাটিয়ে বসন্তের শুরুতে আমাদের দেশ ত্যাগ করে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে যখন বরফ গলতে শুরু করে ঠিক তখন ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি নিজেদের দেশে ফিরে যায়। তবে শীতে এই দেশের জলাশয়গুলো অতিথি পাখিদের আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত হলেও দিন দিন অতিথি পাখিদের আত্মীয়তা গ্রহণের চাহিদা কমে যাচ্ছে যার ফলে পর্যায়ক্রমে প্রতি শীতে অতিথি পাখিদের আগমনও কমে যাচ্ছে। এর মুখ্য কারণ পাখি শিকার। জলাশয় অঞ্চলের কিছু অসাধু মানুষ শীতে একটা পরিকল্পনা নিয়ে থাকে যে এবার শীতে তাকে গত বছরের চেয়ে বেশি পাখি শিকার করতে হবে। এই অসাধু মানুষগুলো নির্বিচারে অতিথি পাখি শিকার করে বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে। এরা জাল কিংবা সুতার ফাঁদ পেতে কিংবা ছররা গুলি দিয়ে পাখিদের নির্মমভাবে শিকার এবং হত্যা করে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুসারে অতিথি পাখি শিকার ও বিক্রি করার প্রতি এক নীতিমালায় দন্ডনীয় অপরাধ বলে উল্লেখ রয়েছে। তারপরও দেশের এই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অতিথি পাখি শিকারের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে মানব নামের হিংসুটে পাখি শিকারী প্রাণীরা। শুধু শিকারীর অত্যাচার হলে কিছুটা নিস্তার পেত তাদের হ্রাস পাওয়া থেকে। আরো বেশ কিছু কারণে অতিথি পাখিরা সংখ্যায় কমে যাচ্ছে। অতিথি পাখিদের আহারের বিচরণ ভূমি (নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, বন-জঙ্গল) কমে যাচ্ছে। বন জঙ্গল উজাড় করে ফসলি জমি কিংবা বসত বাড়ি করায় পাখিরা অতিষ্ঠ হচ্ছে তাদের নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেতে। অপর দিকে কৃষক ফসলের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত পাওয়ার লক্ষ্যে ফসলী জমিতে কৃত্রিম সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করছে। যার কারণে অতিথি পাখিরা বিষে আক্রান্ত কীট পতঙ্গ খেয়ে মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবহাওয়ার ভিত্তিতে শীতকালে ইট ভাটা চালু করায় এর মাত্রাতিরিক্ত শব্দ এবং বায়ু দূষণের ফলে অসংখ্য অতিথি পাখি এ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, এই সবুজের সমারহে ঘেরা সোনালী বাংলাদেশের জলবায়ুর ন্যায় অন্য এক দেশে। অথচ আমরা আজ বুঝি না এই অতিথি পাখির প্রতি কৃতজ্ঞতা। আসলে আমাদের দেশে সোনালী আভাস মাখা ফসল যখন ঘরে উঠে ঠিক তখনই দেশের রূপ ঐশ্বর্য পূর্ণ রাখতে অতিথি পাখি এসে হাজির হয়। কারণ শীতের সৌন্দর্যের অন্যতম প্রতীক অতিথি পাখি।
×