ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপে ইতিবাচক ফল আসবে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৮ নভেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপে ইতিবাচক ফল আসবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশ রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উভয়সঙ্কটে পড়লেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেয়া পদক্ষেপে ইতিবাচক ফল আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, এই সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ওপর আরও বেশি করে জোর দিতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে যেমন দ্বিপাক্ষিক চেষ্টা চালাতে হবে, পাশাপাশি বহুপাক্ষিক এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগও অব্যাহত রাখতে হবে। তারা বলেন, বাংলাদেশ চায় এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান। রোহিঙ্গাদের জোর করে দেশে ফেরত পাঠালেই সমস্যার সমাধান হবে না। তাই এই সমস্যার এমন সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আর কখনও এই পরিস্থিতির সম্মুখীন না হয়। শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে আমরা অনেকদূর এগিয়েছি বলে উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফল হলো মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের উন্মুক্ত ভোট। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অনেকটাই সফল। এতে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। শুক্রবার রাজধানীর পরীবাগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে একটি জাতীয় সংলাপে সাবেক রাষ্ট্রদূত, বিশিষ্ট কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদরা এই অভিমত ব্যক্ত করেন। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে এই জাতীয় সংলাপ যৌথভাবে আয়োজন করে বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি এ্যান্ড কাউন্টার টেররিজম। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মোজাফফর হোসেন পল্টু বলেন, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আমরা বেকায়দায় রয়েছি। এর সমাধানে প্রধানমন্ত্রী কূটনৈতিক এবং দ্বিপাক্ষিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এই সমস্যা সমাধানের এর চেয়ে ভাল কোন পথ খোলা নেই। মিয়ানমার মাটি চায়। মানুষ চায় না। রোহিঙ্গারা যাতে সেখানে বসবাস করতে না পারে এবং নাগরিকত্ব না পায় সেই পন্থা বেছে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বল প্রয়োগের পরিবর্তে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারকে বোঝাতে চাইছে, বোঝাতে হবে। তিনি বলেন, বিপন্ন অবস্থানের কারণে রোহিঙ্গাদের দেশে আশ্রয় দিতে হচ্ছে। তাদের আশ্রয় দেয়ায় দেশে আইএস এবং আল কায়েদা জঙ্গীগোষ্ঠীর হুমকির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, এই অসহায় মানুষকে এসব জঙ্গীগোষ্ঠী ব্যবহার করতে পারে। একবার তারা এই জঙ্গীগোষ্ঠীর কবলে পড়লে, জঙ্গীপন্থা বেছে নিলে মিয়ানমার নতুন অজুহাত খুঁজে বের করবে; তখন রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়বে। এ কারণেই বাস্তবতার নিরিখে কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়াও ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা এবং বাঙালী সংঘাতের আশঙ্কাও রয়েছে। তাই নিরাপদে তারা কিভাবে দেশে ফিরে যেতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি এ্যান্ড কাউন্টার টেররিজমের চেয়ারম্যান ড. ওয়ালিউর রহমান বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলার চেষ্টা করছি। এই প্রচেষ্টায় সমস্যা সমাধানে অনেকদূর এগিয়ে গেছি। প্রধানমন্ত্রী এখন পর্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি দ্বিপাক্ষিক পদক্ষেপের পাশাপাশি কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও চালাচ্ছেন। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর যে জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, হত্যার মতো বর্বর কাজ চালাচ্ছে দ্বিপাক্ষিক প্রচেষ্টার কারণে তিনি এসব বিষয় উল্লেখ করছেন না। তিনি চাচ্ছেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই কথাগুলো বলুক। আমরা চাচ্ছি রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে যাক। মিয়ানমার সরকারকে তাদের ফেরত নিতে হবে। কারণ, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। আমরা সমাধানের পথে এগোচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে এগোচ্ছেন তাতে চীন, রাশিয়াকেও আমরা আগামীতে পাশে পাব। ভারত আমাদের পক্ষে ভোট দেবে উল্লেখ করেন তিনি। আমরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফল পাচ্ছি। এ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলে দ্রুত রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান হবে। অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে এবং নাগরিকত্ব প্রদানে ওআইসির উদ্যোগে যে প্রস্তাব পাস করা হয়েছে সে বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। চীনের বিপক্ষে ভোট দান এবং রাশিয়ার ভোটদানে বিরত থাকার বিষয়টিও উঠে আসে। চীন-রাশিয়া আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র হলেও পররাষ্ট্রনীতিতে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই। এক্ষেত্রে তারা নিজ নিজ স্বার্থ দেখবে। এটাই স্বাভাবিক। সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. রাশেদ আহমেদ বলেন, স্থায়ী বন্ধু, স্থায়ী শত্রু বিষয়টি পররাষ্ট্রনীতিতে নেই। এখানে কাজ করে জাতীয় স্বার্থ। রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে অধিকাংশ দেশ অদের পক্ষে। ভারত ভোটদানে বিরত থেকেছে, এটাও বড় ধরনের সাফল্য। চীন-রাশিয়াকে ভোটদানে বিরত রাখতে পারলে নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের অবস্থান সুবিধাজনক হবে। মোট কথা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। তবে তিনি উল্লেখ করেন, চীন-রাশিয়া নিজেদের স্বার্থে মিয়ানমানের পক্ষে ভোট দিয়েছে। কারণ সেদেশে তাদের বিনিয়োগ রয়েছে সেখানকার নিরাপত্তার পরিস্থিতি ভাবতে হবে। সেখানে যদি কোন শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ না করে বা শান্তি না থাকে তাদের বিনিয়োগ কিভাবে হবে। শুধু মাখন, রুটি নিয়ে থাকলে তা হবে দুঃখজনক। নিরাপত্তা পরিষদে এই দুটি দেশকে পাশে পেতে হবে উল্লেখ করেন। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হারুনর রশিদ বলেন, র্দীঘমেয়াদী রোহিঙ্গা সঙ্কট দেশে সার্বিক পরিস্থিতি হুমকির মুখে ফেলে দেবে। রোহিঙ্গাদের কারণে নিরাপত্তা হুমকিসহ বাংলাদেশ সামাজিক এবং পরিবেশগত সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছে। ইতোমধ্যে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখন এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। ’৭৮ এবং ’৯২ সালে যারা এসেছিল তারা ফেরত যায়নি। নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট দেশে আইএসসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হতে পারে। ফলে বাংলাদেশসহ এই এলাকার নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়ে যবে। তিনি রোহিঙ্গা সমাধানে সব ধরনের উদ্যোগ কাজে লাগানোর আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডিয়ান হাইকমিশনার বেনয়েট প্রিফন্টেইন বলেন, মিয়ানমারে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দু’মাস যাবত বাংলাদেশ এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। বর্তমানে অনেক দেশ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ভাবছে। পরিস্থিতি আগের থেকে উন্নত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো বিষয়ে কানাডা বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত রয়েছে। তিনি বলেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উচিত সুসম্পর্ক বজায় রেখে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করা। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে নাগরিক সমাজকেও সরকারকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান তিনি। সংলাপে বক্তারা বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে তা জোরদার করেতে হবে। মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী সেই অর্থে জানে না তাদের দেশে গণহত্যা বা জাতিগত নিধন চালানো হচ্ছে। এই বার্তা তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। রোহিঙ্গারা যে সে দেশের নাগরিক এই জনসমর্থনও নিতে হবে। সবকিছুর ওপর মিয়ানমার প্রতিবেশী দেশ; বিষয়টি মনে রেখে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধান করতে হবে। সংলাপে বক্তব্য রাখেন মরক্কো দূতাবাসের কর্মকর্তা হামিদ মাশরই, কানাডিয়ান দূতাবাসের কর্মকর্তা জুলিয়া ফ্রান্সিস প্রমুখ।
×