ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইনের গ্রামে ফের আগুন, সহিংসতা ॥ অনুপ্রবেশের প্রস্তুতি বাকিদেরও

রোহিঙ্গাবিরোধী ক্ষোভ জিইয়ে রাখার কৌশল বর্মী সেনাদের

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৮ নভেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গাবিরোধী ক্ষোভ জিইয়ে রাখার কৌশল বর্মী সেনাদের

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আশা জাগতেই তা আবার মিলিয়ে যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কর্মকা-ে। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার চাপের মুখে সে দেশের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচির নমনীয় বক্তব্যের পরই আসে সেনাপ্রধানের কড়া বক্তব্য। আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সুচি এক কদম এগুলে তা ফের পিছিয়ে যায় সে দেশের সেনা অবস্থান বিবেচনায়। সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং সর্বশেষ বলেছেন, মিয়ানমারের জনগণ রোহিঙ্গাদের মেনে নিলে তবেই তাদের ফিরিয়ে আনা হবে। পাশাপাশি সেখানকার অধিবাসীর মধ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী ক্ষোভ জিইয়ে রাখার চেষ্টাও হয়েছে। সর্বশেষ রাখাইনের একটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ফলে সেখানে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই এখন অবস্থান করছে বাংলাদেশে। রাখাইন রাজ্যে এখন ২ লাখের কিছু বেশি রোহিঙ্গা থাকতে পারে বলে ধারণা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএমও)। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার যে অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন হয়েছে তাতে এরাও বিভিন্ন পয়েন্টে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টায় রয়েছে। তবে সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবি আগের তুলনায় কড়া অবস্থানে থাকায় অনুপ্রবেশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। নাফ নদী এবং সন্নিহিত সমুদ্রসীমায় নৌযান চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ থাকায় রোহিঙ্গারা ছোট ছোট গ্রুপে এপারে আসছে ভেলা ভাসিয়ে কিংবা বিশেষ কৌশলে সাঁতরে। ওপারে অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের বিপরীতে এপারের মানবিক আচরণ তাদের যেন হাতছানি দিচ্ছে। আইএমও’র কাছ থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সহিংসতা শুরুর পর থেকে আড়াই মাসে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা এসেছে ৮ লাখের কিছু বেশি। রাখাইনে অপেক্ষমাণ আরও অন্তত দু’লাখ। ফের দমনপীড়ন শুরু হওয়ায় দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যেই তারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে এমনই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে সংস্থাটি। এ অবস্থায় উদ্বিগ্ন কক্সবাজার জেলার টেকনাফ এবং উখিয়ার অধিবাসী। কেননা, এরই মধ্যে তারা এই অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর কারণে সাংঘাতিক চাপের মুখে পড়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কর্মক্ষেত্রেও। বিশেষ করে দিনমজুর হিসেবে যাদের জীবনযাপন তাদের জীবিকা হুমকির মুখে। কারণ, রেশনসহ বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া রোহিঙ্গারা স্বল্প মজুরিতে কাজ করতে পারলেও স্থানীয়দের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এ অবস্থা বিবেচনায় স্থানীয়দেরও চালসহ কয়েক ধরনের নিত্যপণ্য প্রদানের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। ফের আগুন ও সহিংসতা রাখাইনে ॥ মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান একপ্রকার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে আশার আলো সৃষ্টি হলেও তা আবার অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে নতুন করে সৃষ্ট সহিংসতায়। নির্যাতন বন্ধ হওয়ার পরও অবশ্য রোহিঙ্গারা আসছিল। তবে সে অনুপ্রবেশ ছিল নিরাপদ জীবন এবং কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের আশায়। কিন্তু বৃহস্পতিবার চলে আবারও অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনের ঘটনা। রাখাইন রাজ্যের অনেক এলাকায় নির্যাতন হলেও মংডুর মাঙ্গালা নামের গ্রামটি ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। ফলে সেখানে অনেক রোহিঙ্গা রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার ওই গ্রামের ঘরবাড়িতেও আগুন দেয়া হয়। এপার থেকেও দেখা যায় ধোঁয়ার কু-লী। ফলে তারা পালাবার পথ খুঁজছে। সঙ্গত কারণেই পলায়নপর বাকি রোহিঙ্গার গন্তব্যও বাংলাদেশ। এখনও প্রতিদিন আসছে রোহিঙ্গা ॥ মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ এখনও অব্যাহত। প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে। শুক্রবার ভোরেও শাহপরীর দ্বীপ এবং শামলাপুর পয়েন্টে অনুপ্রবেশ করেছে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতন আগের মতো না থাকলেও তাদের আচরণে তারা ধেয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন আগত রোহিঙ্গারা। গত চারদিনে কমপক্ষে সাড়ে ৬ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলাদেশে। নাফ নদীর মোহনা ও সাগরপথে এরা এসেছে ভেলা ও ট্রলারে চড়ে। বাংলাদেশে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহল চেষ্টা চালিয়ে গেলেও মিয়ানমারের কার্যকলাপ বস্তুত কালক্ষেপণ বলেই প্রতীয়মান। ১৯৭৮ সালে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৩২ হাজার রয়ে গেছে প্রায় তিনযুগ ধরে। এরপরও এসেছে রোহিঙ্গা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চুক্তি হলেও হঠাৎ কোন না কোন কারণ দেখিয়ে মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। আবার অনেক রোহিঙ্গা সেখানে ফিরতেও চায় না। নতুন করে আসা ৮লাখ ও পুরনোসহ ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়ার কাজ দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে ধারণা করছে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কেননা, রাখাইনে বসবাসরত ‘আসল মিয়ানমারের নাগরিকরা’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা মেনে না নিলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া হবে না বলে ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন দেশটির সেনাপ্রধান। তার এমন বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের অঙ্গীকারের বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার সেনাপ্রধানের দেয়া এ বক্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ার ইঙ্গিতই দিচ্ছে। এনজিও কর্মীর সাজা ॥ কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁওতে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নোমান হোসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে ১৪ নারী-পুরুষ ও শিশু আটক এবং এক এনজিও কর্মীকে কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর অভিযান শুরু হয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে। ঈদগাঁও বাজারের নিকটে জালালাবাদ ইউনিয়নের তেলীপাড়া, বাজারপাড়া, হাদেইম্যার চরে ৩টি টিম এ অভিযান চালায়। অভিযান চলাকালে নতুন-পুরাতন মিলিয়ে ৬ নারী, ৬ শিশু এবং ২ পুরুষসহ ১৪ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। আটক রোহিঙ্গারা স্বীকার করে, তারা দীর্ঘদিন ধরে ঈদগাঁওয়ে অবৈধভাবে বসবাসসহ ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে আসছে। অভিযান পরিচালনাকালে রোহিঙ্গাদের ঋণ প্রদানের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এহেছান মুরাদ এনজিও সংস্থা এসডিআই কর্মী জাহেদুল ইসলামকে ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদ- প্রদান করেন। শুক্রবার তাদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নোমান হোসেন প্রিন্স জানান, যেসব স্থানীয় লোকজন রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং পুনর্বাসনে সহযোগিতা করবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ নেবে প্রশাসন। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের অর্থায়নের অভিযোগে ‘ব্যুরো বাংলাদেশ’ এবং ‘এসডিআই’ নামের দুটি এনজিওর কার্যক্রম ঈদগাঁও এলাকায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইউএনও জানান, কোন ইউনিয়নে যাতে কোন রোহিঙ্গা আশ্রয় এবং সহযোগিতা না পেতে পারে সেজন্য সদরের সকল ইউপি চেয়ারম্যানকে এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এলাকাবাসী ওই অভিযানকে সাধুবাদ জানিয়েছে এবং অভিযান অব্যাহত রাখারও দাবি জানিয়েছে। ত্রাণ বিক্রি করছে রোহিঙ্গারা ॥ কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন অনেকটা প্রতিযোগিতামূলকভাবে ত্রাণ বিতরণ করছে। এতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভোগ্যপণ্যের সঙ্কট এখন নেই। বরং উদ্ধৃত পণ্য তারা বিক্রি করছে অন্যত্র। ত্রাণ হিসেবে রোহিঙ্গারা পাচ্ছে টাকা, চাল, ডাল, বোম্বে আলু, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, সাবান, টুথপেস্টসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্য। যে পরিমাণ পাওয়া যাচ্ছে তার সবই তাদের প্রয়োজন নেই। ফলে অতিরিক্ত পণ্য তারা বেচে দিচ্ছে বিভিন্ন দোকানে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে।
×