ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তাহেরা বেগম জলি

আলোকবর্তিকা অবলা বসু

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

আলোকবর্তিকা অবলা বসু

(পূর্ব প্রকাশের পর) তিনি ১৮৮১ সালে ২০ টাকা বৃত্তি প্রাপ্ত হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে এন্ট্রান্স পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বাবা দুর্গামোহন দাশের ইচ্ছা, কন্যা অবলা ডাক্তার হবে। তৎকালীন সময়ে কলকাতায় নারীদের ডাক্তারি শিক্ষার সুযোগ না থাকায়, অবলা বসু ১৮৮২ সালে মাদ্রাজে যান ডাক্তারি পড়তে। অসুস্থতাজনিত কারণে শেষ পর্যন্ত ডাক্তারি পড়া তার আর হয়ে ওঠে না। ডাক্তারি পাঠ অসমাপ্ত রেখেই ফিরে আসতে হয় তাকে। তবে সেখানে তিনি ডাক্তারি বিদ্যার ওপর দুই বছরের একটি নির্দিষ্ট কোর্স শেষ করেছিলেন। এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজের পক্ষ থেকে তাকে একটি ‘সার্টিফিকেট অফ অনার’ দেয়া হয়েছিল। অতঃপর ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞানাচার্জ জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে অবলা বসু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯১০ সালে লেডি অবলা বসু ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি স্কুলটি পরিচালনা করেন। নতুন করে সাজিয়ে সেই স্কুলটিকে তিনি করে তুলেছিলেন আরও গতিশীল। একই সঙ্গে দিদি সরলা রায়ের পাশে দাঁড়িয়ে, গোখলে মেমোরিয়াল স্কুলটি প্রতিষ্ঠার কাজে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে তিনি নিজেকে যুক্ত করেন । লেডি অবলা বসু ১৯১৯ সালে ‘নারী শিক্ষা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই সংগঠনের মাধ্যমে মুরলীধর মহাবিদ্যালয় এবং গ্রাম এলাকার বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় দু’শ’ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে এই সকল দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, তার সম্বন্ধ শুধু মসির সঙ্গেই নয়, অসি ধরার দুঃসাহসিক কাজেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তার সমসাময়িক কালে বিধবাদের দুর্বিষহ জীবন বড় ভাবিয়ে তুলেছিল মহীয়সী এই বঙ্গকন্যাকে। তাই শিক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি বিধবাদের স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘বিদ্যাসাগর বাণীভবন’ ‘মহিলা শিল্পভবন’ ও ‘ বাণীভবন ট্রেনিং স্কুল নামের প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলেন তিনি। যেখানে বিধবাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলে, তার তৈরি বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষিত বিধবাদের নিয়োগ দেয়া হতো। তাছাড়া ‘নারী শিক্ষা সমিতি’র মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও তিনি পরিচালনা করতেন। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, লেডি অবলা বসু স্বামীর মৃত্যুর পর, তার সঞ্চিত এক লাখ টাকা দিয়ে ‘অ্যাডালটস প্রাইমারি এডুকেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ভগিনী নিবেদিতার নাম। তৎকালীন বাংলার নারী মুক্তি এবং নারী শিক্ষা আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে অবলা বসু ছিলেন একটি পরিচিত দুরন্ত মুখ। অথচ আজ তিনি আমাদের সমাজে প্রায় অচেনা হিসেবেই পড়ে আছেন! সে সময়কার জনপ্রিয় ইংরেজী পত্রিকা ‘মডার্ন রিভিউ’-এ নারী শিক্ষা এবং নারী স্বাধীনতার ওপর তার বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। বিভিন্ন বাংলা সাময়িক পত্রিকায় বেরিয়েছিল তার কিছু প্রবন্ধ ও ভ্রমণ কাহিনী। অবলা বসুর বিভিন্ন সময়ে লেখা কিছু প্রবন্ধ একটি সঙ্কলনেই পাওয়া যায়- শকুন্তলা শাস্ত্রি প্রকাশিত ‘বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র ও লেডি বসুর প্রবন্ধাবলী’ নামে। ১৩০২ থেকে ১৩৩২ এই সময়কালের মধ্যে ‘মুকুল এবং প্রবাসী পত্রিকায় নিজের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখে তিনি দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন, নারী যদি মানুষ হওয়ার সংগ্রাম করে, তবে সে কত উঁচুতে উঠতে পারে এবং জীবনকেও দেখতে পারে কতভাবে। ঠিক এইখানটাতেই তিনি প্রকৃতই নারী সমাজের অগ্রদূত। বাংলা ১৩০২ অগ্রহায়ণ ও পৌষ সংখ্যার মুকুল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তার কাশ্মীর ভ্রমণ কাহিনী। এই কাহিনী লিখতে গিয়ে, শুরুতে অবলা শিশুদের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘ইংলন্ড প্রভৃতি সুসভ্য দেশের বালক বালিকাগণ বাল্যকাল হইতেই ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়িতে ভালবাসে, তাহার সুফল হয় এই যে, বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া তাহারা নূতন দেশ আবিষ্কারের জন্য প্রাণ পর্যন্ত ত্যাগ করিতে প্রস্তুত হয়। .... আমাদের এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত পাঠ করিয়া এতটা না হইলেও আশা করি তোমাদের মধ্যে অনেকের মনে নানা স্থান ভ্রমণ করিয়া প্রকৃতির শোভা দেখিবার আগ্রহ জন্মিবে।’ এখান থেকে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, অবলার চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করত আমাদের শিশুরা। কিভাবে শিশুদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তা ছিল অবলার জীবনের ধ্যানজ্ঞান। ভ্রমণকেও জীবন গড়ে তোলার উপায় হিসেবে দেখতে পাওয়া, অবলার এই বিচক্ষণতার পরিচয়, তাকে চিনতে আমাদের সাহায্য করে। ভ্রমণ, ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছিল তার জীবনের কর্মশক্তির অন্যতম উৎস। পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরেছেন অবলা। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু যখন তার বিজ্ঞানের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য ছুটছেন বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে। প্রায় সব জায়গাতেই তার সঙ্গী ছিলেন অবলা এবং অবলার এই ভ্রমণ যে শুধুই স্বামীসঙ্গ ছিল না, তিনি জীবনভর তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন তার প্রতিটি পদক্ষেপে। তার ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, তিনি ১৯৩২ সালের প্রবাসীতে লিখিত আকারে প্রকাশ করেছিলেন ‘বাঙ্গালী মহিলার পৃথিবী ভ্রমণ’ নামে। তার এই লেখায় তাদের ইউরোপ ভ্রমণের কারণ এবং বিজ্ঞানী সমাজে তাদের গুরুত্ব পাওয়ার বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘বহুদেশ ভ্রমণে দেশ সেবার নানা উপাদান সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি। সে কথা বলিতে গেলে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ হইতে আরম্ভ করিতে হয়। সেই বৎসর আচার্য বসু মহাশয় অদৃশ্য আলোক সম্বন্ধে তাহার নূতন আবিষ্ক্রিয়া বৈজ্ঞানিক সমাজে প্রদর্শন করিবার জন্য ব্রিটিশ এসোসিয়েশনে আহূত হন। তাহার সহিত আমিও যাই। এই আমার প্রথম ইউরোপ যাত্রা। ইহার পর ৫/৬ বার তাহার সহিত পৃথিবীব্যাপী ভ্রমণে বাহির হইয়াছি। আমার ভ্রমণকালের মধ্যে পৃথিবীর ইতিহাস নানাভাবে ভাঙ্গিয়াছে ও গড়িয়াছে, এক আমার বয়সেই ইউরোপে কত কত পরিবর্তন দেখিলাম।’ ভারতীয় বিজ্ঞানের আধুনিক ধারাকে, অক্লান্ত পরিশ্রমে পশ্চিমি দুনিয়ায় পরিচিত করে তুলেছিলেন বাঙালী বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। এই উপলক্ষেই তাদের ইউরোপ ভ্রমণ এবং অবশ্যই এই ভ্রমণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনাÑ তবে এই ভ্রমণ আজও চেতনার গভীর থেকে আমরা দেখতে পেরেছি বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। অবলা বসুর বয়ানে সেই দুঃখবোধ ফুটে ওঠার চিহ্ন আমরা দেখতে পাই। ‘এতকাল তো ভারতবাসী বিজ্ঞানে অক্ষম এই অপবাদ বহুকণ্ঠে বিঘোষিত হইয়াছে, আজ বাঙ্গালী এই প্রথম বিজ্ঞান সমরে বিশ্বের সম্মুখে যুঝিতে দণ্ডায়মান। ফল কী হইবে ভাবিয়া আশংকায় আমার হৃদয় কাঁপিতেছিল, হাত-পা ঠাণ্ডা হইয়া আসিতেছিল। তারপর যে কী হইল সে সম্বন্ধে আমার মনে স্পষ্ট কোন ছবি আজ আর নাই। তবে ঘন ঘন করতালি শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম যে, পরাভব স্বীকার করিতে হয় নাই। বরং জয়ই হইয়াছে।’ এই ভ্রমণের এই সময় কালেই কলকাতায় ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা তাদের মনে ঠাঁই করে নিয়েছিল। বিদেশের কথা লিখতে গিয়ে প্রকৃতির নানা বর্ণনার পাশাপাশি ঘুরে ফিরে ছোটদের কথাই লিখেছেন অবলা। ‘ইতালির লুপ্তনগরী।’ তার সেরা বিদেশ ভ্রমণ কাহিনী। জগদীশচন্দ্র এবং অবলার একমাত্র সন্তান জন্মের পরেই মারা যায়। পরবর্তী জীবনে আর কোন সন্তান তাদের জীবনে আসেনি। সমাজের হাজারো শিশুদের মধ্যে অবলা খুঁজে নিয়েছিলেন সন্তানের অপূর্ণতা। আমরা যে নৈর্ব্যক্তিক মাতৃত্ব-পিতৃত্বের কথা বইয়ে পড়েছি, সেই নৈর্ব্যক্তিক পিতৃত্ব-মাতৃত্বের মহান সৌন্দর্য ধরা দিয়েছিল বসু দম্পতির উচ্চতর মানবিক জীবনে। ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহর, পম্পেই নগরী অবলা বসুর মনে বলতে গেলে ঝড় তুলেছিল। একবার-সারাদিন সেই মৃত নগরী ঘুরে, সন্ধ্যায় শেষ বারের মতো শহরটার দিকে তাকিয়ে তার কল্পনায় ভেসে উঠলোÑ ‘একটি গৃহ ক্রমে ক্রমে ভস্মে ঢাকিয়া যাইতেছিল। সেই গৃহে একটি নারী দু’হাতে তার শিশুটিকে উচ্চে ধরিয়া রহিয়াছিল। ভস্মস্তূপ ক্রমে ক্রমে উচ্চ হইয়া দুঃখিনী মাতাকে নিমজ্জিত করিতেছিল। কিন্তু সেই অগ্নির প্রসার হইতে শিশুকে রক্ষা করিতে হইবে। জ্বলন্ত ভস্মস্তূপ তিল তিল করিয়া দগ্ধ করিয়াও জননীকে একেবারে অবসন্ন করিতে পারে নাই। কী যেন এক মহাশক্তি, দুঃসহ যন্ত্রণা দমন করিয়া রাখিয়াছিল! মাতার হস্ত দুইটি মৃত্যু যন্ত্রণাতেও অবশ হইয়া পড়ে নাই। দুই সহ¯্র বৎসর পরে সেই ঊর্ধ্বত্থিত করপুটে সন্তানটি পাওয়া গিয়াছে। সেই মাতার স্নেহস্পর্শে যেন অতীত বর্তমানের সহিত মিলিয়া গেলো। একই দুঃখে, একই স্নেহে, একই মমতায় সেকাল ও একাল, পূর্ব ও পশ্চিম যেন বান্ধা পড়িলো! তখন পম্পেইর মৃত রাজ্য সঞ্জীবিত হইয়া উঠিলো এবং রাজপথ আমার চক্ষে অকস্মাৎ লোকজন পূর্ণ হইলো!’ অবলা বসুর সৃষ্টিশীল জীবন আমাদের চেতনায় এই বলে প্রতিধ্বনি তোলে, ‘শ্রীমতী অবলা বসু হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃতই বাংলার পরমাত্মীয়। একাধারে আমরা তাকে পেয়েছি নারী সমাজের যুধ্যমান পথিকৃৎ হিসেবে। অন্যদিকে তিনি ছিলেন শিশু জীবনের কাণ্ডারি। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছি, বাঙ্গালী বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে তিনি ক্লান্তিহীন ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর পথে পথে। আবার আমরা দেখি কি পরম মমতায় তার জীবনের পরতে পরতে মিশে ছিলো আমাদের সন্তানেরা। এ কথা না বললেই নয়, বাংলার নারী সমাজের বেদনা দূর করতে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন প্রকৃত সৈনিকরূপেই। আজ এই ঘোর অন্ধকারে, আমাদের অবলা বসুর দিকে ফিরে তাকাতেই হবে। যে দেশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, লেডি অবলা বসু, মহীয়সী বেগম রোকেয়ার আবির্ভাব ঘটে, সেই দেশের নারী বা শিশুদের জীবনে অন্ধকার কিছুতেই স্থায়ীরূপ পেতে পারে না। আমাদের নারী এবং শিশুসমাজের জীবন, মানবিক অধিকারে উন্নীত করার লড়াইয়ে, শক্তিমান অবলা বসু আজ হয়ে উঠুন আমাদের আঁধারের আলো।
×