ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ জাহিদ হাসান

অনুসরণীয় এক নারী নীলুফার খানম

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

অনুসরণীয় এক নারী নীলুফার খানম

কর্মজীবনে তিনি সরকারের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একাধারে মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের মহাপরিচালক, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও সচিব, ঢাকার সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি)-এর প্রথম মহিলা এমডিএস নীলুফার বেগম। বয়স ৭৫ হলেও চলাফেরায় কোন রকম অসুবিধা বোধ করেন না। নিজের জীবন-সংসার, দায়-দায়িত্ব আর অন্যান্য কাজের জায়গায় আজও পূর্ণ সচেতন। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে আসা এই মানুষটির কাজ আর দায়িত্বের অবিচলতা দেখে অনেকেই হয়ত বয়সের কথা ভুলেই যাবেন। বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে, এই বয়সের একজন মানুষ কিভাবে তার নিষ্ঠা, সামাজিক দায়বদ্ধতা আর দায়িত্ববোধের খাতিরে সমাজের কল্যাণকর চিন্তার বাস্তব রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন। যার কথা বলছিলাম, সে মানুষটি চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামের মরহুম আশেক আলী খানের (চঁাঁদপুর জেলার প্রথম মুসলিম গ্রাজুয়েট, বাংলা একাডেমি চরিতা বিধান, পৃঃ সংখ্যা-৭৬) কনিষ্ঠ কন্যা, চট্টগ্রাম বিভাগের প্রথম মহিলা যুগ্ম সচিব এবং বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি)-এর প্রথম মহিলা এমডিএস নীলুফার বেগম নামেই সকলের কাছে সুপরিচিত। নিজ প্রজ্ঞা, মেধা আর কর্মময় বর্ণিল জীবনের গুণে বর্তমান নারী সমাজের কাছে নীলুফার বেগম সত্যি একটি গর্বিত নাম। যার শিক্ষা, কর্মজীবন এবং অবসরের প্রতিটি দিকই এ প্রজন্মের নারীদের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ। ছোট বেলা থেকে মেধাবী, পরোপকারী, সৎ চিন্তাশীল এই মানুষটি কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করেছেন নারী সম্পর্কিত কার্যক্রম সম্পাদনের মধ্য দিয়ে। যিনি জীবনের প্রতিটি কর্মের মাধ্যমে দেখিয়েছেন নারী শুধু ঘরমুখো জীবনের জন্য নয়। নারী তার প্রবল ইচ্ছা শক্তি, উপযুক্ত শিক্ষার গুণে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। নীলুফার বেগম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে বিএ (অনার্স) ও এমএ পাস করে সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন। কর্মজীবনে তিনি সরকারের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একাধারে মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের মহাপরিচালক, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও সচিব, ঢাকার সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি)-এর প্রথম মহিলা এমডিএস, এপিডি ঢাকার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল, কোটা ও নিপা শীর্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে সাফল্য এবং গৌরবের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। এসব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকালে তিনি যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারের ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসনের ওপর উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, পূর্ব জার্মানি ও ইতালিতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ফিলিফিন্স, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে অভিজ্ঞতা বিনিময় ও জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে সফর করেন। উল্লেখ্য, তিনি চট্টগ্রাম বিভাগের প্রথম মহিলা যুগ্ম সচিব ও বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি)-এর প্রথম মহিলা এমডিএস হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছেন। এখন তিনি অবসরে। কিন্তু থেমে নেই তার কল্যাণকর কাজের চেষ্টা। তাই তো তাকে দেখা যায় নানামুখী সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে। তিনি বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ প্রশিক্ষণ উন্নয়ন সমিতি, লেখিকা সংঘ, কমনওয়েলথ বৃত্তিধারী সমিতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি, বাংলাদেশ প্রশিক্ষণ উন্নয়ন সমিতি, বাংলাদেশ প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ এক্সটেনশন সার্ভিসেস (বিজ), নন্দিনী সাহিত্য গোষ্ঠীসহ বহু সংগঠনের সভাপতি, উপদেষ্টা, সদস্য ও আজীবন সদস্যের দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়াও তিনি তিন মেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্যের দায়িত্ব পালন এবং বহু সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ, গবেষক, প্রশিক্ষক এবং পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট বেলা থেকে লেখালেখির প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। বলা বাহুল্য যে, তার পরিবারের প্রায় সকল সদস্যেরই লেখক এবং কলামিস্টের পরিচয় রয়েছে। লেখার প্রতি প্রবল আগ্রহের ছাপ আজও তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তাই তো দেশের মুক্তিযুদ্ধ, গ্রামীণ জীবন চিত্র, কৃষ্টি-কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে তিনি লিখেছেন ২২টি গ্রন্থ। তার লেখা ২৩তম গ্রন্থ ‘স্মৃতিতে অম্লান’ সাম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি তিনি দেশের বেশ কয়েকটি জার্নাল ও সাময়িকীর সম্পাদনাও করে যাচ্ছেন। নীলুফার বেগম তার আলোকিত জীবনে অর্জিত সব সাফল্যের স্বীকৃতিও পেয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে। তার বীরত্বগাথা কর্মজীবন ও লেখনীর জন্য অর্জন করেছেন স্থানীয় ও জাতীয় পুরস্কার এবং সম্মাননা। তিনি ১৯৯৫ সালে ছোট গল্পের জন্য নন্দিনী সাহিত্য পুরস্কার, মানবসম্পদ উন্নয়ন উৎকর্ষতা আনয়নের অবদান হিসেবে ২০০১ সালে র‌্যাপটা বাংলাদেশ কর্তৃক সম্মাননা, গ্রামীণ নারী উন্নয়নে গবেষণার জন্য ২০০৪ সালে আশরাফ সাইদা সিদ্দিকী ফাউন্ডেশন হতে স্বর্ণপদক প্রাপ্তি, নন্দিনী সাহিত্য পুরস্কার ২০০৬, শেরে বাংলা পদক ২০০৮, লেখিকা সংঘ সম্মাননা ২০১০, রতœগর্ভা এ্যাওয়ার্ডসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। নীলুফার বেগম তাঁ দৃঢ় মানসিকতা, বুদ্ধিদীপ্ত কাজকর্ম দিয়ে নারী সমাজের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। একটি অবহেলিত পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে সম্মুখে তুলে আনতে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। তার নেতৃত্বে ৯৯-২০০০ সালে নেপাল ও মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত নারী ও শিশু বিষয়ক সার্ক মিটিংয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করে এবং ২০০০ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত পঞ্চম বিশ্ব নারী সম্মেলনেও তিনি যোগদান করেন। শিক্ষা এবং কর্ম জীবনে নারীদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তিনি আজও সমাজে উজাড় করে দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান নারী সমাজ পূর্বের যে কোন সময়ের চাইতে অনেক বেশি অগ্রগামী। সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে এ সময়ের অগ্রগামী নারী সমাজের কাছে নীলুফার বেগম একটি অনুসরণীয় নাম হিসেবে জাগ্রত থাকবে। আমরা নীলুফার বেগমের দীর্ঘায়ু কামনা করছি। তিনি যেন তার প্রজ্ঞা দিয়ে এ সমাজের আরও বেশি কল্যাণ সাধন করতে পারেন।
×