ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. চিত্তরঞ্জন দাশ

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন ॥ বিস্মিত হলাম ইমারল্ড (Emerald) লেক দেখে

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন ॥ বিস্মিত হলাম ইমারল্ড (Emerald) লেক দেখে

(পূর্ব প্রকাশের পর) যে গল্প বার বার চোখের সামনে ভেসে আসে, যে গল্পের কোন শেষ নেই। সেই গল্প আবার বলি, ঘুরে ফিরে বলি তবুও বলতে ইচ্ছা করে। তারপরও বলা শেষ হয় না। একই মহাকাব্য কতভাবে যে রচনা করা যায় তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। সেই মহাকাব্যের নাম রকি মাউনন্টেন। যাকে আমি চোখে দেখিনি যার বাঁশি শুনেছিলাম। বাঁশি শুনে যাকে আমি ভালবেসেছিলাম। সেই বাঁশির নাম রকি মাউনন্টেন। মাথায় আর কোন সাহিত্য আসছে না। গাড়ি চলছে সেই সঙ্গে অবিরাম দুরন্ত গতিতে চলছে আমার চোখ। কোনটা যেন হারিয়ে না ফেলি। একটার পর একটা রুক্ষ শুষ্ক নিরেট পাথরের স্তূপাকৃতির প্রকান্ড- শীলাখন্ড- নানা দানবের চেহারা নিয়ে হাজির হচ্ছে। খোল খোল অবগুণ্ঠন, না অবগুণ্ঠন খোলার প্রয়োজন নেই তারা অবগুণ্ঠন খুলেই সামনে হাজির হচ্ছে। তুমি চোখ মেলে, মন খুলে প্রাণ ভরে তাকে দেখ, যত খুশি, যতবার, যতভাবে দেখ আপত্তি নেই। কিন্তু কোলে উঠতে চেও না, কাছে এসো, ভালবাস, আদর করও কিন্তু আলিঙ্গন করতে যেও না। এমনি করে কাছের ধনকে কাছে নিয়ে দূরে ফেলে সামনে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ চলার গতি গেল কমে, সামনে বিশাল কার পার্ক, বুঝতে আর বাকি রইল না যে আমরা ইমারল্ড লেক চলে এসেছি। অনেকটা খোঁজাখুঁজির পর একটা খালি পাকিং অবশেষে পাওয়া গেল। এখানেও তিল ধরনের ঠাঁই নেই। অগ্রবর্তী দলের কয়েকজন নেমে গিয়ে একটা খালি টেবিল বেঞ্চ দখল করে চলে গেল। লেকের পাশ দিয়ে এমনি সব টেবিল বেঞ্চ সেট করা আছে যেখানে বসে দর্শনার্থীরা মনোরম দৃশ্যাবলী দেখা এবং খাবার দাবার রেখে ডাইনিং টেবিলের কাজটাও করতে পারেন। সবাই যখন ব্যস্ত গাড়ি থেকে খাবার দাবার এনে টেবিল সাজাতে আমি তখন ব্যস্ত হয়ে গেলাম ইমারল্ড লেকের অপূর্ব সুন্দর জলের রঙ দেখতে। জলের এমন রঙ হতে পারে, বিশ্বাসই করতে পারছি না। সামনেই দেখলাম দুইজন এদেশীয় তরুণী ছোট একটা টেবিলের উপর কিছু কাগজপত্র ও ছোট দুই একটা বিলুপ্ত প্রাণীর জীবাষ্ম নিয়ে দুই একজন অতি আগ্রহী পর্যটকদের কি যেন বোঝানোর চেষ্টা করছে। কৌতূহল মেটাতে আমিও এগিয়ে গেলাম। মেয়েটির বুকে লাগানো ছোট্ট একটি নাম ফলক থেকে তার নামটি জানতে পারলাম অহহধরপশ ইঁৎমবংং ঝযধষব ই. সে এখানে এসেছে রয়েল অন্টারিও জাদুঘর থেকে কিছু দুর্লভ ক্ষুদ্র আকৃতির প্রাণীদের সঙ্গে পর্যটকদের পরিচয় ঘটাতে। মূলত এই সকল ক্ষুদ্র প্রাণীরা বিলুপ্তির পথে। মূল্যহীন অথচ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই সকল প্রাণীদের রক্ষা করার জন্য এবং তাদের ছবি, ফশিল ও টেলিসকোপে এদের দেখে চিনে রাখতে এই ব্যবস্থা। ইউনেসকো ওয়ার্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে কানাডার কিছু কিছু পার্ককে ঘোষণা করেছে যেখানে মানুষের চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যার মধ্যে ইঁৎমবংং ঝযধষব অন্তর্ভুক্ত। প্রাণীদের মধ্যে আছে অহড়সধষড়পধৎরং, গধৎৎবষষধ, চরশধরধ, ঐধষষঁপরমবহরধ, ঙঃঃড়রধ. অহহধরপশ নামের যে মেয়েটি লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে ঈধসঢ়ধরহ করছিল তার কাছে থাকা লিফ্ট লেটের ছবিটা পাঠকদের অবগতির জন্য এখানে সংযুক্ত করলাম। গল্পে গল্পে অনেক কথাই ওর কাছ থেকে জানার আগ্রহ ছিল কিন্তু খাবার নিয়ে অনেক বেশি হাঁক-ডাক শুরু হয়ে গেছে কেউ কেউ আবার একটু বাঁকা কথাও বলতে ছাড়ছে না। এ্যানায়িককে বললাম চল আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবে। ধন্যবাদ জানিয়ে বলল তার লাঞ্চ করা হয়ে গেছে। টেবিলে সাজানো খাবার দেখে মনে করার কোন উপায় নেই যে, বনে জঙ্গলে পিকনিক করে বেড়াচ্ছি। মনে হচ্ছে যেন বসত বাড়ির রান্নাঘরে অতিথি আপ্যায়ন করা হচ্ছে অর্ধশতাধিক ভিন্ন ভিন্ন রকমারি বাহারি রান্নার আয়োজনে। ডাল, ভাজি, শাকসবজি, মাছ মাংস, দই মিষ্টি কোন কিছুতে ক্রটি নেই। এই হলো মহান শংকর বণিকের নেত্রীত্বের গুণাবলী। মধ্যাহ্ন ভোজন ভালমতোই হলো। এবার ইমারল্ড লেক দেখার পালা। লেক আর নতুন করে কি দেখব। লেকের ধারে এসে এর জলের রঙ দেখে চোখ ফেরাতে পারছি না। জানার চেষ্টা করছি এত গাড় নীল সবুজের সংমিশ্রণে এক অনন্য সুন্দর জলের রঙ হলো কেমন করে। এ্যানায়িককে জিজ্ঞাসা করতে ভুল করিনি যে, কি প্রকারে এই সবুজাভ-নীল জলের আকার ধারণ করল। একমাত্র বৈজ্ঞানিক কারণ হলো লাইম স্টোনের পাওডার মিশ্রিত জল। এর সঙ্গে সূক্ষ্ম তুষারের সেডিমেন্ট বা তুষার কণারও অবদান কম নয় এই লেকের রূপ লাবণ্য ফুটিয়ে তুলতে। এই অসাধারণ রঙ আরও অসাধারণ লাগে জুলাই মাসে, যখন লেকের চারিধারের উঁচু সব পর্বত মালা থেকে বরফ গলা জলের স্রোত নেমে আসে লেকের গভীরতা বাড়াতে। জলের গভীরতা যত বৃদ্ধি পায়, রঙের বাহারও তখন চোখে পড়ার মতো। এখনও তো বাহারের কোন কমতি আছে বলে মনে হয় না। তবে যেহেতু জুলাই মাসে এর রূপ বৈচিত্র্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাই বেশি বড়াই করে কিছু বলার সুযোগ নেই। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার উহু ন্যাশানাল পার্কের মধ্যে অবস্থিত ইমারল্ড লেক পর্যটক আকর্ষণের দিক থেকে চূড়ান্ত তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। দুর্গম এই সব পাহাড়ী এলাকায় তেমন একটা লোক সমাগম দেখা যায় না কিন্তু আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থানসমূহে লোকজনের কোন কমতি নেই। লেকের চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পর্যটকদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। এখানে শুধু চোখের দেখা ছাড়াও অনেক কার্যক্রমে অংশ নিয়ে ভ্রমণটাকে চিরস্মরণীয় করে রাখো যায়। হাইকিং, বাইকিং, ওয়াকিং, সাইক্লিং, সুইমিং, বোটিং কত কিছুই করা যায়। একমাত্র আমাদের দলের সদস্যরা এসব কার্যক্রম থেকে বিরত। অবশ্য এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হলে হাতে বাড়তি সময়ের প্রয়োজন। আমাদের রাত কম তামাশা অনেক বেশি। এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, পর্যটকদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় চাইনিজদের উপস্থিতি। এই একই চিত্র চোখে পড়েছিল আমেরিকাতেও। তারা বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হওয়ার পাশাপাশি পর্যটক হিসেবেও তাদের খ্যাতি সর্বত্র। ইউরোপিয়ানদের মধ্যেও এই প্রবণতা আরও অনেক বেশি। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে প্রথম যিনি এই লেকের অপরূপ সৌন্দর্যের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে থমকে গিয়েছিলেন তিনি টম উয়িলসন ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে। দুর্ঘটনা বশত রকি মাউনন্টেন অভিযানে তার বাহক ঘোড়াটির গলার রশি ছিঁড়ে গিয়ে লেকের প্রেমে পড়ে যান। তার নিজের ভাষায় যে বর্ণনা তিনি দেন তা হলো- For a few moments I sat [on] my horse and enjoyed the rare, peaceful beauty of the scene. এবং তিনি নাইট উপাধিতে ভূষিত করে এর নাম দেন ‘Emerald’. অর্থাৎ পান্নার রূপ। যদিও এই লেক তার আবিষ্কার করা প্রথম কোন অপসরি ছিল না এর পূর্বে আর একজনের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে তাকে উপাধি দেন ’লেক লুইস’। চলবে...
×