ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা চান পোল্ট্রিশিল্পের খামারিরা

বীমাও নেই, নীতিমালাও নেই

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

বীমাও নেই, নীতিমালাও নেই

রহিম শেখ ॥ বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পোল্ট্রিশিল্পের সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে, পোল্ট্রিশিল্পে বর্তমানে বিনিয়োগ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ২ শতাংশ। বর্তমানে ডিমের দৈনিক উৎপাদন ২ কোটি ২০ লাখ আর মুরগির মাংসের উৎপাদন দৈনিক প্রায় সাড়ে ১৮শ’ টন। মহামারী বার্ড ফ্লুর ধকল সামলে পোল্ট্রিশিল্পের অগ্রগতিকে স্বস্তিদায়ক বলছেন অনেকে। কিন্তু এ স্বস্তির আড়ালে কিছু অস্বস্তিও রয়েছে। রয়েছে পুঁজি হারিয়ে খামার গুটিয়ে নেয়ার উদাহরণও। খামারি এবং উদ্যোক্তাদের সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক বছরে ঝরে পড়েছে প্রায় অর্ধলক্ষ খামার। নিয়ন্ত্রণহীন একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দাম, পোল্ট্রি ফিড এবং ওষুধের দাম বৃদ্ধি, কর অবকাশ সুবিধা বাতিল, অগ্রিম আয়কর, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক সব মিলিয়ে খামারি ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে কাজ করছে এক ধরনের অস্থিরতা। আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়ও হিমশিম অবস্থায় পড়ছে এ শিল্প। এসব সমস্যা সমাধানে পোল্ট্রি বীমা চালুর পাশাপাশি এ শিল্পে নীতিমালা প্রণয়ন জরুরী। পাশাপাশি সহজশর্তে ঋণ বিতরণের দাবি জানিয়েছেন এ খাতের দেশীয় উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) হিসাবমতে, দেশের পোল্ট্রিশিল্পে বর্তমানে ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। পরোক্ষভাবে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। ২০৩০ সালে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে প্রায় এক কোটি মানুষ। তথ্যমতে, বর্তমানে সারাদেশে ছোট-বড় খামার রয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার। এদিকে পোল্ট্রিশিল্পে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছেন নতুন উদ্যোক্তা। তারা প্রথমে গড়ে তুলছেন ছোট খামার। সময়ের পরিক্রমায় তা হচ্ছে বড়। নতুন উদ্যোক্তা ও নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে এ শিল্পে একই সঙ্গে বাড়ছে বিনিয়োগও। আশির দশকে এ খাতে বিনিয়োগ মাত্র ১৫শ’ কোটি টাকা হলেও বতর্মানে তা ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স এ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে দেশের পোল্ট্রিশিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে ৩০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে বিনোয়োগ বেড়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। আর ২০২১ সালে সাধারণ মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে এ খাতে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার বিনোয়োগের প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রতিটি মানুষের সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে পোল্ট্রিশিল্পকে এগিয়ে যেতে হবে আরও বহুদূর। দেশে প্রতিনিয়তই বাড়বে ডিম ও মাংসের চাহিদা। এর ওপর ভর করে সৃষ্টি হবে আরও বড় বাজার। আকাশচুম্বী সাফল্যের এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলতে হবে পুষ্টিসম্পন্ন মেধাবী জাতি। তবে খামারিরা বলছেন, প্রতিনিয়তই নানা উপকরণের দাম বাড়ছে। মুরগির বাচ্চা, খাবার ও ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা লাভের মুখ দেখছেন না। ২০১০ সালে যে মুরগির বাচ্চার দাম ছিল ১০ থেকে ১৫ টাকা তা এখন ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় তাদের কিনতে হচ্ছে। বেড়েছে মুরগির খাবার ও ওষুধের দাম। তাদের ভাষ্য, বিপরীতে কেজিপ্রতি মুরগি ও ডিমের দাম বাড়েনি তেমন। ফলে পোল্ট্রি খামারিদের উৎপাদনে তেমন লাভ হচ্ছে না। ২০১০ সালে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিায়ায় পোল্ট্রি খামার গড়ে তোলেন মোঃ আসাদুল হক। এক প্রশ্নের উত্তরে ওই ব্যবসায়ী বলেন, বর্তমানে পোল্ট্রি ব্যবসায় দুর্দিন যাচ্ছে। মুরগির বাচ্চা ও খাবারের দাম অনেক বেশি। বিপরীতে ডিম ও মুরগির মাংসের দাম কম। দেশের মানুষের জন্য আমিষ সরবরাহ করেও আমরা তেমনভাবে লাভবান হচ্ছি না। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পোল্ট্রি ব্যবসায়ী সোহেল মিয়া। তিনিও ২০১০ সাল থেকে এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তার ভাষ্য, আগে মুরগির বাচ্চার দাম ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা আর এখন ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সম্পাদক ও বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-মহাসচিব খন্দকার মহসিন বলেন, বাচ্চার দাম নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই। খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, সেদিকে সরকারের নজর নেই। আমাদের সেক্টরটিকে অভিভাবকহীন মনে হয়। মুরগির বাচ্চার পাশাপাশি খাবারের দামও বেড়েছে। কিন্তু মুরগির দাম ১০০ থেকে ১৩০ টাকাই। ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স এ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) সাধারণ সম্পাদক মোঃ সিরাজুল হক বলেন, দেশের পোল্ট্রিশিল্প বর্তমানে সাম্যাবস্থায় রয়েছে। অনেকটা ভাল ও মন্দের মাঝামাঝি। যতটুকু যোগান দেয়া দরকার আমরা ততটাই দিচ্ছি। এ খাতের পুরো উন্নয়ন হয়েছে বেসরকারীভাবে। তিনি বলেন, কৃষিক্ষেত্রে ঋণ প্রদান করা হলেও পোল্ট্রিশিল্পের ছোট ছোট খামারির জন্য আলাদা করে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে না। পোল্ট্রিশিল্পের বিকাশে ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। এছাড়া খামারিদের মুরগি বার্ডফ্লুর মতো রোগে আক্রান্ত হলে ছোট ছোট ব্যবসায়ী যেন পথে বসে না যায়, সে লক্ষ্যে পোল্ট্রি বীমা করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, এছাড়া করসংক্রান্ত কিছু ঝামেলা রয়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত পোল্ট্রিপণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকলেও হঠাৎ করে ২০১৫ সালে এসে তা বন্ধ করে নতুন করে করারোপ করা হয়। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের (বিপিআইএ) তথ্যমতে, এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা। কিন্তু এখানে এখনও কোন বীমা ব্যবস্থা চালু হয়নি। এতে বিভিন্ন রোগবালাইয়ের কারণে কোন ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ পান না খামারিরা। এতে বাধ্য হয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা খামার ছেড়ে দেন। এমন পরিস্থিতিতে ছোট ছোট খামরীর স্বার্থরক্ষায় কৃষির মতো পোল্ট্রি খাতেও স্বল্পসুদে ঋণ ও ‘পোল্ট্রি বীমা’ চালু করার দাবি জানান বাংলাদেশ পোল্ট্রিশিল্প সমন্বয় কমিটির (বিপিআইসিসি) শীর্ষ এক নেতা। এদিকে, পোল্ট্রি খাতের উন্নয়নে ২০০৮ সালে করা হয়েছিল জাতীয় পোল্ট্রি উন্নয়ন নীতিমালা। যেখানে পোল্ট্রিকে প্রাণিজ কৃষি খাত ঘোষণা করে শস্য খাতের সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে পোল্ট্রির জন্য। কিন্তু কাগুজে নীতিমালাতেই আটকে আছে এর উন্নয়ন। আর এক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতাকেই দায়ী করছে পোল্ট্রিশিল্পের অভিভাবক সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল।
×