ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্তের পঞ্চম প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৬ নভেম্বর ২০১৭

কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্তের পঞ্চম প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাজু আহমেদ ॥ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যুগান্ত সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব সুভাষ দত্তের পঞ্চম প্রয়াণ দিবস আজ। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রকার ২০১২ সালের আজকের দিনে ৮২ বছর বয়সে পরলোকে যাত্রা করেন। কৃতী এই চলচ্চিত্রকারের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি। সুভাষ দত্তের জন্ম ১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের মুনশিপাড়ায় মামার বাড়িতে। পৈত্রিক বাড়ি বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার চকরতি গ্রামে। তার বাবার নাম প্রভাষ চন্দ্র দত্ত ও মায়ের নাম প্রফুল্ল নলিনী দত্ত। ২ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার ২ ছেলে শিবাজী দত্ত ও রানাজী দত্ত এবং ২ মেয়ে শিল্পী দাস ও শতাব্দী মজুমদার। স্ত্রী সীমা দত্ত ২০০১ সালের অক্টোবরে প্রয়াত হন। শেষ দিন পর্যন্ত ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন। সুভাষ দত্ত ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র চিত্রশিল্পী, চিত্রনাট্যকার ও শিল্প নির্দেশক। তার হাত ধরে এ দেশের চলচ্চিত্র বিষয়বস্তু নির্মাণ আঙ্গিকে বৈচিত্র্যতা এসেছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সুনাম ও স্বীকৃতিও এসেছিল এই এই কৃতী চলচ্চিত্রকারের মাধ্যমে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে সুভাষ দত্তের পরিবারের ইচ্ছা ছিল সে বড় হয়ে ডাক্তার হবেন। ডাক্তার হওয়ার ভয়ে ১৯৫০ সালে আইএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর বাড়ি থেকে পালিয়ে বোম্বে চলে যান। সেখানে একটি চলচ্চিত্র পাবলিসিটির স্টুডিওতে মাত্র ত্রিশ টাকা মাসিক বেতনে কাজ শুরু করেন। তবে সেখানেও মন না বসায় ১৯৫৩ সালে ভারত থেকে ঢাকায় ফিরে প্রচার সংস্থা এভারগ্রিনে যোগ দেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় ১৯৫৭ সালে ভারতের হাই কমিশনের উদ্যোগে ওয়ারিতে একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেখানে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ দেখে চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুপ্রাণিত হন। পোস্টার আঁকার মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে সুভাষ দত্তের কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল। দেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ এর পোস্টার ডিজাইনার ছিলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় মাটির ‘পাহাড়’ চলচ্চিত্রের আর্ট ডিরেকশনের মাধ্যমে তার পরিচালনা জীবন শুরু হয়। এরপর তিনি এহতেশাম পরিচালিত ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। আর পরিচালক হিসেবে অভিষিক্ত হন ১৯৬৪ সালে ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্র দিয়ে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের নির্মাতাদের মতো ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে কাজ করাটা এত সহজ ছিল না। এ কারণে সুভাষ দত্তকে অনেক কষ্ট করেই নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে হয়েছে। প্রধান অভিনেতা হিসেবে তিনি সেই সময়ের নবাগতা অভিনেত্রী কবরীর (মিনা পাল) বিপরীতে অভিনয় করেন। এটি বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সম্মাননা লাভ করেছিল। ১৯৬৫ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সুতরাং’ দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়। এছাড়া ১৯৬৭, ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব এবং ১৯৬৮ সালে নমপেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয় সুভাষ দত্তের চলচ্চিত্র। সুভাষ দত্তের প্রযোজনা ও পরিচালনার ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রটির জন্য ১৯৭৭ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা পরিচালক ও প্রযোজকসহ মোট পাঁচটি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। প্রয়াত হলেও সুভাষ দত্তের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও তার নানা মাত্রিক সৃষ্টি রয়ে গেছে। চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে সুভাষ দত্ত একজন শিল্পী গড়ার কারিগর হিসেবে দেশীয় চলচ্চিত্রে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার হাত ধরেই কবরী, সুচন্দা, উজ্জ্বল, শর্মিলী আহমেদ, ইলিয়াস কাঞ্চন, আহমেদ শরীফ ও মন্দিরার চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সময় তিনি নির্মাণ করেছেন অসংখ্য দর্শকনন্দিত চলচ্চিত্র। তার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ ও ১৯৭৭ সালে আলাউদ্দিন আল আজাদের বিখ্যাত উপন্যাস ২৩ নম্বর তৈলচিত্র অবলম্বনে ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্র দুটি আজও চলচ্চিত্র সমালোচকদের আলোচনার বিষয়। সত্তর দশকের শেষের দিকে ড. আশরাফ সিদ্দিকীর লেখা ‘গলির ধারের ছেলেটি’ গল্প অবলম্বনে তিনি নির্মাণ করছিলেন ‘ডুমুরের ফুল’ চলচ্চিত্র। সুভাষ দত্ত অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘রাজধানীর বুকে’, ‘সূর্যস্নান’, ‘তালাশ’, ‘রূপবান’, ‘মিলন’, ‘নদী ও নারী’, ‘ভাইয়া’, ‘ক্যায়সে কাহু’, ‘আখেরি স্টেশন’, ‘সোনার কাজল’, ‘দুই দিগন্ত’, ‘সমাধান’ প্রভৃতি। তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘কাগজের নৌকা’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’, ‘আবির্ভাব’, ‘বলাকা মন’, ‘সবুজ সাথী’, ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘ডুমুরের ফুল’, ‘নাজমা’, ‘স্বামী স্ত্রী’, ‘আবদার’, ‘আগমন’, ‘শর্ত’, ‘সহধর্মিণী’, ‘সোহাগ মিলন’, ‘পালাবদল’, ‘আলিঙ্গন’, ‘বিনিময়’, ‘আকাক্সক্ষা’ প্রভৃতি। অভিনয়, শিল্প নির্দেশনা পরিচালনাসহ কৃতিমান চলচ্চিত্রকর্মী হিসেবে সুভাষ দত্তের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এদিকে সুভাষ দত্তর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সন্ধ্যায় বিশেষ স্মরণ সভার আয়োজন করেছে নাটক ও চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মৌলিক কমিউনিকেশন। প্রতিষ্ঠানের শান্তিনগরের নিজস্ব কার্যালয়ে এ উপলক্ষে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে দেশের বিশিষ্ট সংস্কৃতিকর্মীরা উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।
×