ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোল বোমায় লণ্ড ভণ্ড পরিবার

ওদের বিচার দেখার অপেক্ষায় ভোলার ওয়াহিদের স্বজনরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৫ নভেম্বর ২০১৭

ওদের বিচার দেখার অপেক্ষায় ভোলার ওয়াহিদের স্বজনরা

গাফ্ফার খান চৌধুরী ॥ বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের পেট্রোলবোমায় নিহত আব্দুল ওয়াহিদের জন্য কাঁদতে কাঁদতেই এক চোখ অন্ধ হয়ে গেছে স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের। একদিকে স্বামী হারানোর শোক, আরেক দিকে চোখ হারানোর যন্ত্রণায় একেবারে পাথর হয়ে গেছেন তিনি। নিদারুণ কষ্টে তার দিন কাটে চরম অশান্তিতে। তারমধ্যে সংসারে অভাব যেন পিছু ছাড়ছে না। এমন পৈশাচিক নির্যাতনের বিচারের আশায় আজও পথ চেয়ে আছেন তিনি। তার ইচ্ছে হত্যাকারীদের বিচার দেখে যাওয়া। তার আগে আল্লাহ যেন তাকে কবরে না নেন। কাঁদছিলেন আর কথাগুলো বলছিলেন নিহতের ছেলে কামাল হোসেন। বলছিলেন, আমাদের বাড়ি ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন থানাধীন বড়মানিকা গ্রামে। আমরা চার বোন তিন ভাই। অভাবের সংসারে বোনদের বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। আমরা তিন ভাই। নয়ন, আমি আর আমার ছোট মান্নান পিতা-মাতার সঙ্গে একত্রে বসবাস করছিলাম। সংসারের অভাব ঘোচাতে অনেক আগেই আমি আর আমার ছোট ভাই ঢাকায় আসি। আমরা দুই ভাই ব্যক্তি মালিকাধীন প্রাইভেটকার চালাই। আমরা প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বাড়িতে পাঠাই। বাড়ি ভিটা ছাড়া তেমন জমি নেই। বড় ভাই নয়ন অন্যের জমি বর্গা চাষ করে। আমাদের পাঠানো টাকা আর কৃষি কাজ থেকে পাওয়া সামান্য আয়ে কোনমতে পিতা-মাতাকে নিয়ে সংসার চলে। অভাব থাকলেও মাথার উপর ভরসা করার মতো বাবা ছিল। তিনি নানা বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। কোন ঝামেলায় পড়তে হতো না। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর নানা ঝামেলা যেন আর পিছু ছাড়ছে না। ঘটনার দিনটি ছিল ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। পারিবারিক প্রয়োজনে বাবা একটি ইজিবাইকে চড়ে পাশের ভোলারই দৌলতখান থানা এলাকায় অবস্থিত ফরিদা খালার বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পিতার বরাত দিয়ে তিনি বলছিলেন, ওই সময় বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের মিছিল হচ্ছিল। সেখান থেকেই আচমকা ইজিবাইকে পেট্রোলবোমা হামলা হয়। কাঁচের বোতলে বানানো পেট্রোলবোমাটি পড়েই ফেঁটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পুরো ইজিবাইকে আগুন ধরে যায়। বাবা ছিলেন ইজিবাইকের ভেতরের দিকে। সবার গায়ে আগুন ধরে যায়। মারাত্মক দগ্ধ হন তিনি। খবর পেয়ে দ্রুত তাকে উদ্ধার করে ভোলা জেলা সদর হাসপাতালে নেই। সেখান থেকে ওইদিনই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠিয়ে দেয়। পরদিন ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করি। সরকারী খরচে চিকিৎসা চলতে থাকে। চিকিৎসকরা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে বাবাকে বঁচাানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিধি বাম। তা আর হলো না। টানা তিন দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে তার চিকিৎসা চলে। দগ্ধ পিতা মারাত্মক যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে থাকেন। তার গগন বিদারী আর্তনাদে কারও পক্ষেই চোখের পানি ধরে রাখা সম্ভব না। পঁচাত্তর বছর বয়সী পিতা আমাদের চোখের সামনে তিন দিন তিন রাত মরণ যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে মারা গেলেন। সে দৃশ্য ভুলার নয়। পিতা দগ্ধ হওয়ার পর থেকেই মা খুবই কান্নাকাটি করতে থাকেন। এমন কান্না মায়ের পাশাপাশি আমাদের জন্যই বয়ে আনল আরেক যন্ত্রণা। প্রায় ৫৭ বছর বয়সী মায়ের দুই চোখেই ছানি পড়েছিল। আগারগাঁও লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালে অনেক আগেই ডান চোখের অপারেশন হয়েছিল। বাম চোখের অপারেশন হয় বাবার মৃত্যুর কিছু দিন আগে। চিকিৎসকরা মাকে কোন কারণেই অতিরিক্ত কান্নাকাটি করা, চোখে পানির ঝাপটা দেয়া, উপুড় হয়ে সব ধরনের কাজ না করা, আগুনের কাছে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন। পিতার দগ্ধ হওয়ার পর মার সেসব নিয়ম কানুন চুলোয় উঠল। মা দিনরাত বাবার জন্য নামাজ পড়তেন আর মোনাজাত ধরে অঝোরে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। এমন ঘটনায় তার বাম চোখে আস্তে আস্তে সমস্যা দেখা দিল। চোখে ইনফেকশন হলো। মা আস্তে আস্তে দৃষ্টিহীন হতে লাগলেন। দেখতে দেখতে মাস খানেকের মধ্যে মা পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেলেন। চোখের যন্ত্রণা আর সইতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত আবার লায়ন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। চিকিৎসকরা নিরুপায় হয়ে ডান চোখটি ভাল রাখার জন্য মায়ের বাম চোখ তুলে ফেলার কথা জানালেন। শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না দেখে তাই করতে হলো। বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের পেট্রোলবোমায়। পিতার সঙ্গে মায়ের একটি চোখ চিরতরে হারাতে হলো। সেই যন্ত্রণা আজও মা ভুলতে পারেননি। তিনি দিন রাত কান্নাকাটি করে পিতার হত্যাকারীদের বিচার চান। মা বলেছেন, তার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার না দেখে আল্লাহ যেন তাকে কবরে না নেন। তিনি যেন বাবার হত্যাকারীদের বিচার দেখে মরতে পারেন, এটিই মায়ের শেষ ইচ্ছা। মায়ের ইচ্ছা আমাদেরও। আমরাও পিতার হত্যাকারীদের বিচার দেখতে চাই। একপর্যায়ে কান্না থামিয়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যান কামাল হোসেন। তার মুখ থেকে আর কোন কথা বের হলো না।
×