ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাত পর্যবেক্ষণসহ হাইকোর্টের রুল নিষ্পত্তি, পূর্ণাঙ্গ রায় পরে দেয়া হবে

জয়নুল বিষয়ে চিঠি দিয়ে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৫ নভেম্বর ২০১৭

জয়নুল বিষয়ে চিঠি দিয়ে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান বন্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আপীল বিভাগ প্রশাসনের দেয়া চিঠি সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। ওই চিঠি আপীল বিভাগ প্রশাসনের, সুপ্রীমকোর্টের মতামত নয়। বিচারপতি জয়নুলের বিষয়ে দুদককে দেয়া সুপ্রীমকোর্টের চিঠি নিয়ে জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে মঙ্গলবার দেয়া রায়ের পর্যবেক্ষনে এসব কথা বলেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সাত দফা পর্যবেক্ষণসহ রুল নিষ্পত্তি করে এ রায় দেন। গত মার্চে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছিল, বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনরকম ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন হবে না। পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নির্দেশে ওই চিঠি পাঠানো হয়েছিল বলে অরুনাভ চক্রবর্তী দুদককে জানিয়েছেন। পরে বিষয়টি নিয়ে গত চলতি বছর ৫ ও ১৭ জুন ‘সাবেক বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের বাধা!’ এবং ‘সাবেক এক বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে থেমে নেই দুদক’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক জনকণ্ঠে। এর পরই আলোচনায় আসে এই চিঠি। দুর্নীতি বন্ধে সুপ্রীমকোর্টের এমন চিঠি নিয়ে উত্তপ্ত হয় সংসদও। বিষয়টি নজরে আনা হলে এই ধরনের চিঠি কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে গত ৯ অক্টোবর রুল জারি করে হাইকোর্ট। এই রুল নিষ্পত্তি করে মঙ্গলবার দেয়া রায়ে আদালত বলেন, কেবল দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রপতি ছাড়া যে কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগের তদন্ত চলতে পারে। সুতরাং বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের চিঠিতে ভুল বার্তা দেয়া হয়েছে। তবে সাত বছরেও দুদকের ওই অনুসন্ধান শেষ না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে রায়ে বলা হয়েছে, সুপ্রীমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের বিরুদ্ধে তদন্তের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে, যাতে তাদের মর্যাদাহানী না হয় বা অকারণে হয়রানির শিকার হতে না হয়। এই আবেদনের শুনানিতে আদালত জানতে চেয়েছিল- সুপ্রীমকোর্টের এই চিঠির বিচার করার এখতিয়ার হাইকোর্টের আছে কি না। রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছে, ওই রুল যথার্থ (ম্যানটেইনেবল)। রায় ঘোষণার সময় আদালতে তিন এ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে সহায়তাকারী) সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, সিনিয়ল আইনজীবী এএম আমিন উদ্দিন ও প্রবীর নিয়োগী উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের পক্ষে ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন এবং দুদকের পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। রায়ের পর খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায়ের সাতটি পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়, চিঠিটা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। এ চিঠি দেয়া ঠিক হয়নি। এটাকে কোন ক্রমেই সুপ্রীমকোর্টের চিঠি বলা যাবে না। আমরা বলতে পারি চিঠিটি অবৈধ।’ অন্যদিকে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের আইনজীবী ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন বলেন, ‘হাইকোর্টের এ রায় ইতিবাচক।’ সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী মোঃ বদিউজ্জামান তফাদার সুপ্রীমকোর্টের এই চিঠির বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে এনেছিলেন। পরে আদালত স্বত:প্রনোদিত হয়ে এই ধরনের চিঠি কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন। সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার, দুদকের চেয়ারম্যান ও বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে ১০ দিনের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। রুল শুনানির জন্য এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে আদালত সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন, সিনিয়র আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন ও প্রবীর নিয়োগীতে নিয়োগ দেন। এরপর ১৯ অক্টোবর থেকে শুরু হয় শুনানি, যা শেষ হয় ৩১ অক্টোবর। বিচারপতি এস সিনহা প্রধান বিচারপতি থাকার সময় এই চিঠিটি দেয়া হয়েছিল। ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে পদত্যাগী বিচারপতি সিনহা এই চিঠি নিয়েও সমালোচনায় পড়েছিলেন। এই আবেদনের শুনানিতে আদালত জানতে চেয়েছিল- সুপ্রীমকোর্টের এই চিঠির বিচার করার এখতিয়ার হাইকোর্টের আছে কি না? জবাবে প্রবীর নিয়োগী বলেছিলেন, এটা প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক আদেশ। সুতরাং কোন প্রশাসনিক আদেশের বিচার করার এখতিয়ার হাইকোর্টের রয়েছে। গত চলতি বছর ৫ ও ১৭ জুন ‘সাবেক বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের বাধা!’ এবং ‘সাবেক এক বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে থেমে নেই দুদক’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক জনকণ্ঠে। এর পরই আলোচনায় আসে এই চিঠি। দুর্নীতি বন্ধে সুপ্রীমকোর্টের এমন চিঠি নিয়ে উত্তপ হয় সংসদও। সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি বলেন সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের এই নির্দেশনা মানতে বাধ্য নয় দুদক। বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে দুদকের চাহিদা অনুযায়ী বিচারপতি জয়নুলের কর্মজীবন সংক্রান্ত নথিপত্র দুদকে পাঠায় সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন। আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে জনকণ্ঠে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিনও নেন বিচারপতি জয়নুল আবেদীন। পরে সুপ্রীমকোর্টেও তা বহাল থাকে। দুদককে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের দেয়া ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দেয়া রায় সবার ওপর বাধ্যকর। এমন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আদালতের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তার দেয়া রায়সমূহ প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং জনমনে বিভ্রান্তির উদ্রেক ঘটবে। সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোন রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমীচীন হবে না, মর্মে সুপ্রীমকোর্ট মনে করে। এদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রীমকোর্টের দেয়া রায় নিয়ে গত ৯ জুলাই সংসদে ক্ষোভ প্রকাশের মধ্যে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের প্রসঙ্গটিও আসে। জনকণ্ঠের ওই প্রতিবেদনগুলো উদ্ধৃত করে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করতে গিয়ে এ বিষয়টি তুলে ধরে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘ওই চিঠি দেয়ার মাধ্যমে বিচারপতি এস কে সিনহা ন্যায়বিচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন, যা দ-বিধির অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি সুপ্রীমকোর্টের নাম শুধু ব্যবহারই করেননি, তিনি সুপ্রীমকোর্টের প্যাডও ব্যবহার করেছেন, যদিও এটা ছিল তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত।’ উল্লেখ্য, মোঃ জয়নুল আবেদীন ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে ২০০৯ সালে আপীল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসরে যান তিনি। আলোচিত এ বিচারপতি ২০০৪ সালে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টাও করেছিলেন বলে জানা গেছে। আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেয় দুদক। দুদকের দেয়া নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ২০১০ সালের ২৫ জুলাই হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও করেছিলেন। রিটের ওপর শুনানি গ্রহণের পর বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রেজাউল হক সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দেয়।
×