ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্যাতন জয় করে স্বকর্মসংস্থানে স্বাবলম্বী নারী

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৫ নভেম্বর ২০১৭

নির্যাতন জয় করে স্বকর্মসংস্থানে স্বাবলম্বী নারী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘আমি অনেক বছর ঘরে বদ্ধ জীবনযাপন করেছি। বাইরের জগত সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। শুধু ভাবতাম স্বামীর সেবা ও সন্তান পালন করার জন্য বোধ হয় জন্ম হয়েছে। ‘সখি’ প্রকল্পের মাধ্যমে ৬ মাসের ড্রাইভিং কোর্স সম্পন্ন করে আমি এখন ড্রাইভিং পেশাতে আত্মনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার স্বামীর কাছ থেকে কখনও নিজ পায়ে দাঁড়ানোর উৎসাহ পাইনি। ড্রাইভিং লাইসেন্সের টাকা যোগাড় করতে নিজ উদ্যোগে ফুটপাথে একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেছি। উপার্জনের টাকা দেখে স্বামীও এখন আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি নারীর প্রতি নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিরোধী। আগে নিজের পরিবারে নির্যাতন বন্ধ করেছি। এখন আমি অন্য নারীদের চেঞ্জমেকার হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছি।’ কথাগুলো বলছিলেন মোহাম্মদপুর বস্তিতে বসবাসকারী সালমা আক্তার। তিনি গত দু’বছর ধরে চেঞ্জমেকার হিসেবে নিজের অবস্থানের পরিবর্তনের পাশাপাশি অন্যান্য নারীদেরও চেঞ্জমেকার হয়ে উঠতে সাহায্য করছেন। শুধু সালমা নন তার মতো দিনা, রিমিসহ আরও অনেক নারী ‘আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন জোট’-এর আওতাধীন ‘সখি’ প্রকল্পের মাধ্যমে ৬ মাসের বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। আমরাই পারি জোটে যুক্ত প্রায় লাখের বেশি চেঞ্জমেকার হিসেবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে নারী নির্যাতন বন্ধে নিজের মধ্যে পরিবর্তন এনেছেন ও অন্যদের অনুপ্রাণিত করেছেন। আমরাই পারি সংগঠনের উদ্যোগে ঢাকা শহরের বস্তিতে বসবাসরত সুবিধাবঞ্চিত ও নির্যাতনের শিকার নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে আয়বর্ধনমূলক কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। যাদের অধিকাংশই সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন। অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানো এসব নারীর সাফল্য, সম্ভাবনা ও বাধার নানাদিক তুলে ধরার মাধ্যমে মঙ্গলবার রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘আমরাই পারি’ জোটের ‘আয়োজনে নির্যাতনকে করেছি জয়’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে আয়বর্ধনমূলক কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। আয়োজনটি ‘সখি’ প্রকল্পের আওতায় এ্যাম্বেসি অব দ্যা কিংডম অব দ্যা নেদারল্যান্ডসের আর্থিক সহায়তায় অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এ্যাম্বেসি অব দ্যা কিংডম অব দ্যা নেদারল্যান্ডসের এসআরএইচআর এ্যান্ড জেন্ডারের ফার্স্ট সেক্রেটারি ডঃ এ্যানি ভেসটজেনস। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন জোটের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী মোঃ মশিউর রহমান রাঙ্গা (এমপি) প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্ম যেভাবে নারীদের রাখতে চায় সেভাবে যদি নারীরা থাকে তাহলে নারীদের জীবনে যেমন কোন পরিবর্তন আসবে না তেমনি সমাজেও কোন প্রভাব পড়বে না। যুগে যুগে নারীদের ঘরে বন্দী করে রাখার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সুফিয়া কামাল, বেগম রোকেয়াদের মতো নারীদের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী ও স্পীকার সবাই নারীর অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট। ‘এ সরকার নারীর অধিকার রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। নারীদের বিভিন্ন কারিগরিসহ আয়বর্ধনমূলক কাজে যুক্ত হতে হবে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে নারীদের বিশেষ প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে, স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা আছে, গৃহকর্মী, স্কুলের শিক্ষক, স্কুটার ড্রাইভার পেশার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া নারীদের জন্য বিশেষ সমবায় সমিতির ব্যবস্থা আছে। রাজধানী ঢাকার বারিধারায় ৪০ হাজার নারীর সমন্বয়ে সমবায় সমিতি রয়েছে যারা নিজেরা নিজেদের পরিবর্তন করছেন তেমনি দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। প্রতিমন্ত্রী প্রসঙ্গত বলেন, তিনি পরিবহন সেবার সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে যারা ড্রাইভিং শিখেছেন কিন্তু লাইসেন্স করতে পারেননি, তাদের বিনামূল্যে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দেবেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. এ্যানি ভেস্টজেন্স বলেন, ‘আমরাই পারি জোট ঢাকা শহরের ১৫টি বস্তির সুবিধাবঞ্চিত নারীদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে তাতে আমি খুবই উৎসাহ বোধ করছি। নারীর উন্নয়ন সংক্রান্ত এ ধরনের কাজে নেদারল্যান্ডস সরকার সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে। চেঞ্জমেকাররা যখন সকল বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ শেষ করে কাজে যুক্ত হয়েছে এই বিষয়টি আমাকে অনেক স্বস্তি দিয়েছে। আমি আপনাদের আহ্বান জানাই, আপনারা ঘরে বসে থাকবেন না, নিজের সক্ষমতাকে কাজে লাগান, অন্য নারীদের সামনে নিজেকে রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরুন। যাতে আপনাদের সাফল্য দেখে নির্যাতনের শিকার নারীরা নির্যাতনকে জয় করতে পারে, তারাও ক্ষমতায়িত হতে পারে।’ আমরাই পারি জোটের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল সভা প্রধানের বক্তব্যে বলেন, ‘ধর্ম বর্ণ নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল স্বাধীনতাকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে যে দেশ পেয়েছে, তার মূল আকাক্সক্ষা ছিল এদেশে কোন বৈষম্য থাকবে না, নির্যাতন থাকবে না। বাংলাদেশের সংবিধানে যেভাবে নারীর অধিকার ও মর্যাদাকে সমুন্নত করা হয়েছে তা অনেক দেশের সংবিধানেই নেই। তাই সম্মানিত অতিথি সেলিনা আহমেদ বলেন, ‘ঘরে বাইরে সমাজ রাষ্ট্রীয় পরিম-ল কোথাও আসলে নারীর অবস্থান দৃঢ় নয়। সব স্থানেই নারীকে মুখোমুখি হতে হয় নানা রকম নির্যাতনের। কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। আর পরিবর্তনটা আসতে হবে নিজ থেকে। নিজে যখন পরিবর্তন হব তখন আর কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতনসহ সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, বদলাতে হবে সমাজকে। সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে আমরা পারি জোটের উদ্যোগে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১০০০ নারীকে অভিনন্দনপত্র প্রদান করা হয় ও তাদের সম্মাননা জানানো হয়। অনুষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চেঞ্জমেকারদের সাফল্য, সুযোগ ও বাধাবিপত্তির কথা উঠে আসে। নারী বলেই যে শুধুমাত্র সেলাই ব্লক বাটিকের কাজ করতে হবে এমন ধারণা থেকে বের হওয়ার কথা উঠে আসে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের অধিকাংশই ইলেক্ট্রনিক্স, উড ওয়ার্ক, ড্রাইভিংসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণে সাফল্যের সঙ্গে অংশ নিয়ে এখন উপার্জন করছেন।
×