ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শেখ শাহ্রিন আক্তার চাঁদনী

ময়মনসিংহের গর্ব রোজিনা

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৫ নভেম্বর ২০১৭

ময়মনসিংহের গর্ব রোজিনা

বাবা পিকআপ চালক। স্বল্প আয়। অভাবের সংসার। পরিবারে সদস্যসংখ্যা পাঁচজন। পাঁচজনের একজন বিশেষ কিছু। তার নাম রোজিনা আক্তার। তাকে ঘিরেই পরিবারটি এখন স্বপ্ন দেখছে ঘুরে দাঁড়ানোর। সেটা কিভাবে? ফুটবলের মাধ্যমে। জেএফএ অ-১৪ জাতীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ শেষ হয় শুক্রবার। এতে ফাইনালে ঠাকুরগাঁওকে ৩-০ গোলে হারিয়ে অপরাজিত এবং হ্যাটট্রিক শিরোপা জিতে নেয় ময়মনসিংহ। চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে তারা পায় ৫০ হাজার টাকা। আর রানার্সআপ ঠাকুরগাঁও পায় ২৫ হাজার টাকা। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতাকে ৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। এছাড়া পাওয়ার স্পন্সর ওয়ালটন গ্রুপের পক্ষ থেকে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়, ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়, সর্বোচ্চ গোলদাতা, সেরা গোলরক্ষক, সেরা রক্ষণভাগ, সেরা মিডফিল্ড ও সেরা আক্রমণভাগের খেলোয়াড়কে হোম এ্যাপ্লায়েন্স দিয়ে উৎসাহিত করা হয়। ফাইনাল শেষে প্রধান অতিথি হিসেবে পুরস্কার বিতরণ করেন ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ওয়ালটন গ্রুপের অপারেটিভ ডিরেক্টর (হেড অব স্পোর্টস এ্যান্ড ওয়েলফেয়ার) এফএম ইকবাল বিন আনোয়ার (ডন), বাফুফের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও মহিলা উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ, সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ প্রমুখ। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার পায় চ্যাম্পিয়ন দলের ফরোয়ার্ড রোজিনা আক্তার। চূড়ান্তপর্বে সে করে ১৪ গোল। এর ২টিই ফাইনালে। কলসিন্দুরের মেয়ে রোজিনা। পড়ে অষ্টম শ্রেণীতে। বাবা হামিদুর রহমান পিকআপ চালক। ২ বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় রোজিনা এর আগে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টে একবার সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং একবার সেরা খেলোয়াড় হয়েছিল। শিরোপাজয়ের পর বোজিনার প্রতিক্রিয়া, ‘গোল করা সহজ নয়। হয়ে যায়। আমি ভাল শট করতে পারি। মাঠে পরিস্থিতি অনুযায়ী বল নিয়ে কাটাতে পারি। মেসিও ৩ ম্যাচে ১৪ গোল করেনি। মেসি আমার প্রিয় খেলোয়াড়। তার খেলা আমি দেখি। তবে আমাকে কেউ মেসি বলে ডাকে না। বরং শামসুন্নাহারকে সবাই মেসি বলে ডাকে। কারণ মিডফিল্ডে ও অনেক ভাল খেলে।’ জাতীয় দলে খেলা সানজিদা আক্তার রোজিনার গ্রামেরই মেয়ে। তার কাছ কাছ থেকে কোন পরামর্শ? ‘ওরা তো এখন জাতীয় দলের ক্যাম্পে থাকে, তেমন বেশি সময় কাটানো হয় না। তবে যখন বাড়ি যায় তখন অনেক কিছু ওর কাছ থেকে শিখতে পারি। কারণ ওরা তো অনেক কিছু জানে। আমরা আসলে খেলা শিখেছি মফিজ স্যারের কাছ থেকে। কিন্তু স্যার আজকে আসতে পারেননি পরীক্ষার জন্য।’ ক্লাস ফোর থেকে ফুটবল খেলা শুরু করা রোজিনার ময়মনসিংহ দলে সুযোগ পাওয়ার গল্পটা এমন, ‘মফিজ স্যার একবার বললেন আসো, বলে শট মারো। আমরা সবাই শট মারলাম এবং আমার শট ভাল হওয়ায় স্যার আমাকে ফুটবল দলে নিয়ে নিলেন।’ রোজিনার স্বপ্ন জাতীয় দলে খেলার, ‘আমি স্বপ্ন দেখি জাতীয় দলের সিনিয়র স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুনের চেয়ে বেশি গোল করার এবং তারচেয়েও বড় খেলোয়াড় হওয়ার।’ রানার্সআপ ঠাকুরগাঁও দলের কোচ সুগা মুরমু বলেন, ‘মেয়েরা প্রথমবারের মতো ফাইনাল খেলতে নেমেছে। প্রথমার্ধে একটু নার্ভাস ছিল। সেটা দ্বিতীয়ার্ধে কাটিয়ে উঠেছে। যাদের সঙ্গে খেলেছি তারা দু’বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সুতরাং এই ফলে আমরা খুশি। আমাদের দলে আট সাঁওতাল খেলোয়াড় আছে। চ্যাম্পিয়ন দলের কোচ সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জেএসসি পরীক্ষার জন্য আমাদের সাত খেলোয়াড় দুটি করে ম্যাচ খেলতে পারেনি সেমিফাইনালসহ। আমরা বাফুফের কাছে লিখিত আবেদন করেছি এই সময়টা এড়ানোর জন্য। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ওই সাতজনের তিনজন ফাইনাল ম্যাচে খেলতে পারায় দলের শক্তি বেড়েছে। তবে আমাদের ৫-০ গোলে জেতা উচিত ছিল। খেলোয়াড়রা জার্নি করে এসে কিছুটা ক্লান্ত ছিল। যে কারণে দ্বিতীয়ার্ধে আর গোল হয়নি।’ জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস নিয়ে আঁটঘাঁট বেঁধেই মাঠে নেমেছিল ময়মনসিংহ জেলা দল। ফাইনালের আগেরদিনই তারা প্রত্যয় নিয়ে জানিয়েছিল অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হতে চায় তারা। ফাইনালে কথা আর ভাবনাকে সার্থকভাবেই বাস্তবে রূপ দেয় তারা। তারা ৩-০ গোলে হারায় প্রতিপক্ষ ঠাকুরগাঁও জেলা দলকে। বিজয়ী দল খেলার প্রথমার্ধেই সবগুলো গোল করে। এই জয়ে হ্যাটট্রিক শিরোপার স্বাদ পেল ময়মনসিংহ দল। পক্ষান্তরে হেরে যাওয়ায় প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারল না ঠাকুরগাঁও দল। মজার ব্যাপারÑ ম্যাচে হারলেও গ্যালারিতে কিন্তু ময়মনসিংহের চেয়ে বেশি সমর্থক ছিলেন ঠাকুগাঁওয়েরই! রীতিমতো বিশাল ব্যানার নিয়ে খেলা দেখতে ঢাকা এসেছে ঠাকুরগাঁও জেলা সমিতির শ’ খানেক সাপোর্টার। খেলা চলাকালীন পুরো সময়টাতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে নিজ দলের খেলোয়াড়দের দিক-নির্দেশনা দিয়ে যেন ভূমিকা পালন করেছিলেন ‘অঘোষিত’ কোচ হিসেবে! কিন্তু তাতে যে কোন কাজ হয়নি, ৭০ মিনিটের ম্যাচ (৩৫+৩৫) শেষে স্কোরলাইনেই তা স্পষ্ট। তবে হেরে গেলেও আনন্দের কোন ঘাটতি হয়নি তাদের। প্রতিবার গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়লেও ব্যান্ডের বাজনা আরও বেশি করে এবং জোরে জোরেই বেজেছে। সেমিফাইনালে ময়মনসিংহ ৪-০ গোলে রাজশাহী জেলাকে এবং ঠাকুরগাঁও টাইব্রেকারে টাঙ্গাইল জেলাকে ৩-১ (১-১) গোলে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে। শুক্রবারের ফাইনাল ম্যাচটি দেখতে ভিআইপি গ্যালারিতে এসেছিল বাফুফের আবাসিক ক্যাম্পে অবস্থানকারী সাফ অনুর্ধ-১৫ জাতীয় মহিলা দলের ফুটবলাররা। তাদের বেশিরভাগই ময়মনসিংহের। কাজেই জেলা নিজ দলের ছোট বোনদের উৎসাহ দেয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করেনি তারা। তাদের সঙ্গে এসেছিলেন দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন এবং সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান লিটুও। দেখা গেছে বাফুফের স্ট্র্যাটেজিক এ্যান্ড টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলিকেও। যদিও খেলা দেখার চেয়ে তাকে গ্যালারিতে অহেতুক হাঁটাহাঁটি করতে এবং দফায় দফায় কফি পান করতেই দেখা গেছে বেশি। ছোটন শুধু খেলাই দেখেননি, দুই দলের প্রতিভাবান-সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের নাম-ঠিকানাও টুকে নিয়েছেন নোটবুকে। কে জানে, হয়তো আগামীতে জাতীয় দলের ক্যাম্পে তাদের ডাকতেও পারেন ছোটন। ব্যাপারটা আন্দাজ করেই হয়তো দুই দল তাদের সেরা খেলাটা খেলার চেষ্টা করেছে আপ্রাণভাবে। যাতে জয়ী হয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে শেষ পর্যন্ত ময়মনসিংহই। তবে খেলায় হারলেও বেশ ভালই খেলে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিকা ফুটবলাররা। প্রতিপক্ষের সঙ্গে সমানতালেই খেলেছে তারা। বেশ কটি বিপজ্জনক আক্রমণও করেছে। কিন্তু ফরোয়ার্ডদের ফিনিশিংয়ের ব্যর্থতায় এবং ভাগ্য সহায় না হওয়াতে একবারও লক্ষ্যভেদ করে গোল উৎসবে মাততে পারেনি। ম্যাচের ৭ মিনিটেই গোল করে এগিয়ে যায় ময়মনসিংহ দল। বাঁপ্রান্ত দিয়ে বল নিয়ে বিপক্ষের ডি-বক্সে ঢুকে পড়ে সালমা খাতুন। চমৎকারভাবে গড়ানো ক্রস করে আগুয়ান সতীর্থ-ফরোয়ার্ড রোজিনা আক্তারের উদ্দেশে। গোল করতে কোন ভুল করেনি রোজিনা। বল ফেরানোর কোন সুযোগই পায়নি ঠাকুরগাঁওয়ের গোলরক্ষক সাগরিকা (১-০)। ১৫ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করে ফাইনালের আগে দলীয়ভাবে সবচেয়ে বেশি গোল করা ময়মনসিংহ। এক সতীর্থের কাছ থেকে থ্রু পাস পেয়ে রোজিনা আক্তার ডি-বক্সে ঢুকে একক প্রচেষ্টায় গোল করে দলকে আনন্দের উপলক্ষ এনে দেয় (২-০)। ১৪ মিনিটে ডানপ্রান্ত দিয়ে বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে পড়ে ময়মনসিংহের রাইট উইঙ্গার আমেনা খাতুন। গড়ানো ক্রস করে। সেই চলতি বল থেকে ডান পায়ে জালে বল পাঠায় ফরোয়ার্ড শামসুন্নাহার (৩-০)। প্রথমার্ধের খেলা শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগে (৩৫ মিনিটে) আবারও গোল করে ময়মনসিংহ। এবারের গোলটি হয় ডানপ্রান্ত দিয়ে। বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে পড়ে আমেনা খাতুন গড়ানো ক্রস করে। তা থেকে দুর্দান্ত ফিনিশ করে শামসুন্নাহার (৩-০)। আগেরদিন প্রি-ম্যাচ কনফারেন্সে ময়মনসিংহের অধিনায়ক ইয়াসমিন আক্তার জানিয়েছিল তাদের তিনটি ইচ্ছের কথা। ফাইনাল ম্যাচ শুরুর আগে নিজেদের গ্রামের প্রয়াত ফুটবলার-সহপাঠী সাবিনা ইয়াসমিনের স্মৃতির উদ্দেশে এক মিনিট নীরবতা পালন করা (গত ২৬ সেপ্টেম্বর সাবিনা ইয়াসমিন ১৪ বছর বয়সে তিনদিনের জ¦রে ভুগে মারা গিয়েছিল। আগামী ডিসেম্বরে সাফ অ-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার কথা ছিল ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের এই কিশোরী ফুটবলারের)। আরেকটি ছিল শিরোপা জিততে পারলে সাবিনাকে সেটা উৎসর্গ করা এবং তার কবর জিয়ারত করা। প্রথম ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। হয়তো দু’একদিনের মধ্যে বাকি দু’টিও পূরণ করবে চ্যাম্পিয়ন ময়মনসিংহ দল। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রাম ও ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশৈংকলের রাঙাটুঙ্গী গ্রাম। এই দুই গ্রামের মেয়েরা বাছাইপর্ব, মূলপর্ব, সেমিফাইনাল পেরিয়ে ফাইনালে উঠে এসেছে জেএফএ অ-১৪ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ আসরে। ঠাকুরগাঁওয়ের সোহাগী এবং আদুরী নামের দুই খেলোয়াড় জায়গা পেয়েছে মেয়েদের সাফের ক্যাম্পে। ময়মনসিংহ জেলা দলে ১৮ জনের মধ্যে ফুটবলে সফল গ্রাম কলসিন্দুরের ১৫ জন আছে। দলীয় অধিনায়ক বাফুফে আগেই জানিয়েছিল, ফাইনালিস্ট দুই দলের অনেক খেলোয়াড় ইতোমধ্যে তাদের নজর কেড়েছে। তাদের বাছাই করে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এখন দেখা যাক, আগামীতে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে এই দুই দলের কোন খেলোয়াড় খেলার সুযোগ পায় কিনা।
×