ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিদেশীদের ভিড়ে উপেক্ষিত দেশী ক্রিকেটাররা!

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ১৫ নভেম্বর ২০১৭

বিদেশীদের ভিড়ে উপেক্ষিত দেশী ক্রিকেটাররা!

ফরমেটেই গলদ! আগের চারটি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) টি২০ আসরে প্রতি ম্যাচে একটি দলের হয়ে খেলতে পারতেন চার বিদেশী ক্রিকেটার। আর প্রতিবারই দেখা গেছে স্থানীয় ক্রিকেটাররা ব্যাট-বলের নৈপুণ্যে এগিয়ে থাকতেন। কিন্তু এবার চিত্রটা ভিন্ন। ৫ বিদেশী খেলানোর নিয়ম প্রবর্তনের কারণে দেশী ক্রিকেটাররা প্রায় আড়ালে চলে গেছেন। চলমান পঞ্চম বিপিএলে তাই পারফর্মেন্সে উজ্জ্বলতা বিদেশী ক্রিকেটারদের আর প্রায় নিষ্প্রভ দেশের ক্রিকেটাররা। অথচ দেশের একমাত্র এই টি২০ ফরমেটের ক্রিকেট আসর ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিতে করাই হয়েছিল উদীয়মান ক্রিকেটার খুঁজে বের করার লক্ষ্যে। কিন্তু সেই লক্ষ্যটা এবার চাপাই পড়ে গেছে। কারণ প্রতি দলে ৫ বিদেশী খেলছেন- গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে ব্যাটিং-বোলিং করছেন। সেখানে দেশের স্বীকৃত ব্যাটসম্যান-বোলারদেরই সংগ্রাম করতে হচ্ছে পরস্পসের সঙ্গে একাদশে ঠাঁই করে নিতে। তরুন, উদীয়মান ও সম্ভাবনাময় তরুণদের জন্য তো আরও কঠিন হয়ে পড়েছে ম্যাচ খেলা। এ কারণে অনেক ক্রিকেটারই ৫ বিদেশী খেলানোর নীতিটাকে মেনে নিতে পারছেন না। তবে কি এবার বিপিএলে উপেক্ষিতই দেশের ক্রিকেটাররা? এখন এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। এখন পর্যন্ত বিপিএলে অধিকাংশ দলই খেলেছে ৩টি করে ম্যাচ। নবাগত সিলেট সিক্সার্স ৫টি এবং রাজশাহী কিংস ৪টি ম্যাচ খেলেছে। এই ম্যাচগুলো শেষে ব্যাটিং-বোলিং পারফর্মেন্সের পরিসংখ্যান বলছে দেশি ক্রিকেটাররা কোনভাবেই তাল মেলাতে পারছেন না বিদেশী তারকাদের সঙ্গে। বোলিংয়ের শীর্ষ ৬ পারফর্মারের তালিকায় তিন বাংলাদেশীর নাম থাকলেও ব্যাটিংয়ে সেরা ছয়ে নেই কোন স্থানীয় ব্যাটসম্যানের নাম। ব্যাটিংয়ে শীর্ষ ছয়ে আছেন উপুল থারাঙ্গা (৫ ম্যাচে ১৯৭), আন্দ্রে ফ্লেচার (৪ ম্যাচে ১৫১), এভিন লুইস (৩ ম্যাচে ১৩৬), রবি বোপারা (৩ ম্যাচে ১৩১), লুক রনকি (৩ ম্যাচে ১২০) ও জস বাটলার (৩ ম্যাচে ১০০)। সাত নম্বরে গিয়ে স্বল্প পরিসরের ক্রিকেটে জাতীয় দলে উপেক্ষিত মুমিনুল হকের নাম। তিনিই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শীর্ষে আছেন এখন পর্যন্ত। তবু মুমিনুল ৪ ম্যাচে করতে পেরেছেন মাত্র ৯৮ রান। এরপর দ্বিতীয় ইমরুল কায়েস সার্বিকভাবে আছেন ৯ নম্বরে (৩ ম্যাচে ৮৯ রান)। এই ব্যাটিং পরিসংখ্যানই বলে দেশের ব্যাটসম্যানরা এখন পর্যন্ত নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে সেই তালিকায় আছেন সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান, লিটন কুমার দাস, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহীম ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদরা। বোলিংয়ে অবশ্য বেশ কিছুটা আশার আলো ছড়িয়ে আছেন আবু জায়েদ রাহী, তাসকিন আহমেদ ও আবু হায়দার রনি। বোলিং পরিসংখ্যানে শীর্ষে লিয়াম প্লাঙ্কেট (৩ ম্যাচে ৬), দুইয়ে রাহী (৩ ম্যাচে ৬), তিনে তাসকিন (৩ ম্যাচে ৬), চারে সুনিল নারাইন (২ ম্যাচে ৫), পাঁচে মোহাম্মদ নবি (৩ ম্যাচে ৫) এবং ছয়ে ডোয়াইন ব্রাভো (৩ ম্যাচে ৫)। এছাড়াও ৫ উইকেট করে শিকার আছে তাইজুল ইসলাম (৩ ম্যাচে), ফরহাদ রেজা (৪ ম্যাচে), আবুল হাসান রাজুর (৫ ম্যাচে)। তাহলে কি এবার বিপিএল জাতীয় দলের পাইপলাইনে আসার মতো কোন তারকা খুঁজে পাওয়া যাবে না? প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু অবশ্য সন্ধানে আছেন ভাল কয়েকজন পারফর্মার পাওয়ার আশায়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সব দলের ফ্রন্টলাইনে বিদেশী খেলোয়াড়রা আধিপত্য করছে। এই জিনিসটা কমতো যদি আরেকটা দল থাকত। দল কম থাকায় চাপটা চলে আসছে। কিন্তু সুযোগ পেলে ভাল খেলাটা গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু সব দলেরই ফ্রন্টলাইনে বিদেশীরা খেলছে, সেহেতু দেশী খেলোয়াড়দের জন্য পারফর্ম করা কষ্টকর। তাদের খুব পরিশ্রম করতে হচ্ছে।’ আশাহত হতে নারাজ সাবেক এ ক্রিকেটার। কারণ, বিপিএল শেষ হতে এখনও অনেক দেরি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমরা যদি এই টুর্নামেন্ট থেকে দুই/তিনজন ভাল পারফর্মার পাই, সেটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া হবে। একেকটা দল ১২টা করে ম্যাচ পাবে। এখন পর্যন্ত তিনটা করে খেলা গেছে। আমার মনে হয় যে, অন্তত ৭০ ভাগ ম্যাচ শেষ না হলে পারফর্ম মূল্যায়ন করতে পারবেন না।’ গত বিপিএলে শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি ক্রিকেটার মাহেলা জয়াবর্ধনে খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়ন ঢাতা ডায়নামাইটসের তাঁবুতে ছিলেন। কিন্তু তিনি এবার খুলনা টাইটান্সের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি অবশ্য প্রতি দলে ৫ বিদেশী ক্রিকেটার খেলার এই অবস্থার ব্যাখ্যাটা ইতিবাচকভাবেই দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সমন্বয় অনুসারে এটা বাড়তি শক্তি যুগিয়েছে দলে। এটা স্থানীয় খেলোয়াড়দের জন্য ভাল চ্যালেঞ্জ নিজেদের প্রমাণ করার। শুধুমাত্র সেরা সেরা খেলোয়াড়রাই খেলতে পারবে। আর বাংলাদেশ দলের শুধুমাত্র ১১ জন খেলোয়াড় দরকার, ৩০ জন নয়।’ কিন্তু ক্রিকেটাররা এটাকে কোনভাবেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন না। ঘরোয়া আসরগুলোতে দারুণ ফর্মে থাকা শাহরিয়ারা নাফীস সাধারণত টপঅর্ডারেই ব্যাটিং করেন। এমনকি প্রথম বাংলাদেশী ক্রিকেটার হিসেবে বিপিএলে সেঞ্চুরি হাঁকানোরও রেকর্ড তার ওপেনার হিসেবে খেলে। কিন্তু সমন্বয়ের স্বার্থে তিনি এখন হয়ে গেছেন মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান। তিনি ৫ বিদেশী খেলার বিষয়ে বলেন,‘ আমরা টুর্নামেন্টের আগে আশাবাদী হয়ে বলেছিলাম যে, কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু দেখেন স্থানীয়দের পারফর্ম করার সুযোগ কিন্তু কম। ঢাকার দলটার কথাই বলি, মোসাদ্দেক যা বলেছে, ঠিক কথাই বলেছে। সাকিব চারটা ওভার হয়ত করছে, কিন্তু ব্যাটিংয়ে সুযোগ পাচ্ছে না। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের কথা বলে আপনি যদি, পাঁচ বিদেশিকে বেশি সুযোগ দেন আর ভাবেন যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নতি হচ্ছে, তাহলে আমি মনে করি এটা ভুল। ব্যাটিংয়ে টপ তিন জায়গায় খেলছে বিদেশি। প্রতিটি দলে ১০ থেকে ১২ ওভার বিদেশীরা করছে। আশা করছি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে।’ বিদেশী ক্রিকেটার বেশি খেলানো নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলেও এ বিষয়ে এবার বিপিএলের নীতিমালা গড়ার সময়ই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) জানিয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজিদের এমনটাই চাওয়া। কারণ, বিপিএলে বিপুল পরিমাণ অর্থলগ্নি করে ধনকুবেরা। তারা এখানে ক্রিকেটের চেয়ে হয়ত ব্যবসাটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এ কারণে বিদেশের খ্যাতিমান ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক অনেক বেশি হলেও তাদের নিয়ে আসেন তারা। তাদের দাবির কারণেই শেষ পর্যন্ত সর্বনি¤œ ৩ জন এবং সর্বোচ্চ ৫ বিদেশী খেলানোর ব্যাপারে সম্মতি দেয় বিসিবি। কিন্তু ওই সর্বোচ্চ ৫ বিদেশীকেই প্রতিটি ম্যাচে দেখা যাচ্ছে। বিপিএল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাকি তারকারাও চলে আসবেন। তখন আরও সুযোগ থাকবে না দেশের সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারদের গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে ব্যাটিং-বোলিংয়ের। এ কারণে এবার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে খেলা লেগস্পিন অলরাউন্ডার অলক কাপালি বলেন,‘পাঁচজন বিদেশীর সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে যেহেতু, এটার কথা বলে লাভ নেই। কর্তৃপক্ষ তো এটা দেখতেছে। আগামী বছর হয়ত তারা এটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’ কাপালির কথাতেই স্পষ্ট এবারের বিপিএলে দেশী ক্রিকেটারদের অবস্থানটা এমনই থাকবে। কারণ পাকিস্তানের জাতীয় দলে খেলা ক্রিকেটাররা এখনও আসেননি, আরও অনেক বড় তারকাই আসেননি। তারা দলে যোগ হওয়ার পর দেশী ক্রিকেটারদের শুধু একাদশ পূরণ করাতেই নেয়া হবে প্রতিটি দলে এটা নিশ্চিত। আর ব্যাটিংয়ের শীর্ষ জায়গাগুলো, বোলিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানগুলোয় থাকবেন বিদেশীরা। এবার বিপিএলে তাই উপেক্ষিতই থাকতে হবে দেশী ক্রিকেটারদের। এর মধ্যে থেকে নিজেদের সেরা নৈপুণ্য দেখানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ। শেষ পর্যন্ত হয়তো বিপিএলের সেরা পারফর্মারদের তালিকায় শীর্ষ দলে নামই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে এবার!
×