ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সম্ভাবনার পোল্ট্রি শিল্প (পর্ব-১)

নানা সমস্যায় লোকসান গুনছেন ক্ষুদ্র খামারিরা

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১৫ নভেম্বর ২০১৭

নানা সমস্যায় লোকসান গুনছেন ক্ষুদ্র খামারিরা

রহিম শেখ ॥ মুনাফা কম, খাদ্যপণ্য ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি, আড়তদারদের হাতে ডিমের বাজার জিম্মি হওয়া ও ব্যাংকঋণের অপ্রতুলতাসহ নানা কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সম্ভাবনাময় পোল্ট্রি শিল্প। বিশেষ করে ক্ষুদ্র খামারিদের এখন অস্তিত্ব নিয়ে টানাপোড়েন দশা। নতুন করে এ ব্যবসায় কেউ বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না। এ পেশায় জড়িত খামারিদের অনেকেই বর্তমানে বিকল্প ব্যবসার সন্ধান করছেন। যারা কোনমতে টিকে আছেন, তারাও কয়েক বছর ধরে লাভের মুখ দেখছেন না। আবার অনেকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ার ভয়ে হঠাৎ করে খামার বন্ধ করতেও পারছেন না। পোল্ট্রি খামারি, ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের নেতারা বলছেন, কোন নিয়মনীতি না থাকায় এ খাতের বড় কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র খামারিরা। মুনাফাতো দূরের কথা মুরগি বিক্রি করে লোকসান গুনছেন ক্ষুদ্র খামারিরা। খামার পরিচালনার খরচ বেড়েছে। কমেছে মুনাফা। বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে গড়ে ওঠা পোল্ট্রি শিল্প এক সময় ছিল আকর্ষণীয় লাভজনক ব্যবসা। ফলে স্বল্পপুঁজির এই শিল্পে উৎসাহী হয়ে ওঠে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবকেরা। কিন্তু সরকারী নজরদারির অভাবে গত কয়েক বছরে এ শিল্পের বাজার হয়ে পড়েছে পুরোপুরি অস্থিতিশীল। পোল্ট্রি খাদ্য, বাচ্চা ও ওষুধের মূল্য বেড়েছে দফায় দফায়। আর বাজার মনিটরিং না থাকায় ভেজাল ওষুধ আর নিম্নমানের খাদ্যে বাজার সয়লাব হয়েছে। এতে করে মড়ক আর অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে মুরগি। অন্যদিকে উৎপাদিত ডিম ও মুরগির দাম না বাড়ায় লোকসানের মুখে পড়েছেন প্রান্তিক খামারিরা। অনেকে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব ও বেকার হয়ে পড়েছেন। জানা গেছে, এক দশক আগেও দেশে পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। বর্তমানে তা নেমে এসেছে প্রায় ৬০ হাজারে। এছাড়াও আছে ব্রিডার ফার্ম, হ্যাচারি, মুরগির খাবার তৈরির কারখানা। পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লিংকেজ শিল্প, কাঁচামাল ও ওষুধ প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। সবগুলোরই দৈন্যদশা। বর্তমানে দেশের পোল্ট্রি শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ শিল্পে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। এর শতকরা ৪০ ভাগই নারী। দেশের প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষের ৪০ শতাংশ আসে পশু-পাখি থেকে। বাকি ৬০ শতাংশ আসে মাছ থেকে। পশু-পাখি থেকে আসা মোট প্রাণিজ আমিষের এক-তৃতীয়াংশ আসে পোল্ট্রি থেকে। পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে বেশি পোল্ট্রি খামার রয়েছে গাজীপুরে। ২০০৭ সালে এ জেলায় প্রায় ৮ হাজার পোল্ট্রি খামার ছিল। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫ হাজারে। এর মধ্যেও বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে অনেক খামার। বিশেষ করে ক্ষুদ্র খামারগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পোল্ট্রির রাজধানী খ্যাত গাজীপুরে এক সময় দেশের অর্ধেক ডিম ও মাংস উৎপাদন হতো। ক্রমাগত লোকসানের কারণে কয়েক হাজার পোল্ট্রি গুটিয়ে ফেলা হলেও এখনও দেশের এক-চতুর্থাংশ ডিম ও মাংস উৎপাদন হচ্ছে গাজীপুরে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মোঃ মোহসিন জানান, মুরগির খাদ্য তৈরির কাঁচামাল ভুট্টার দাম কমলেও ফিডের দাম কখনও কমে না। এছাড়া ডিমের দাম নির্ধারণ করে ঢাকার কাওরান বাজারের আড়তদাররা। সে অনুযায়ী তাদের ক্ষতি স্বীকার করে বিক্রি করতে হয়। ব্রিডার্স এ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী ভোক্তা একটি ডিম কিনছেন সাত টাকায় যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ছয় দশমিক ৫০ টাকা। খামারিরা প্রতিটি ডিম বিক্রি করছে মাত্র পাঁচ দশমিক ৫০ থেকে পাঁচ দশমিক ৭৫ টাকায়। এখানে তাদের মুনাফা মার খাচ্ছে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমানে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় এক শতাংশ আসে পোল্ট্রি শিল্প থেকে। গার্মেন্টসের পর এটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত। বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক মোঃ মসিউর রহমান জানান, ২০০৭ থেকে ’১১ সাল পর্যন্ত বার্ড ফ্লু’র ফলে এ খাতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ওই সময় বন্ধ হয়ে যায় ৫০ শতাংশের বেশি খামার। এতে পুঁজি হারিয়েছেন বহু ব্যবসায়ী। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানান, এক অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছে দেশের এ শিল্প। ইতোমধ্যেই পোল্ট্রি শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। বর্তমানে এখানে নিয়োজিত আছে ৭টি বিদেশী কোম্পানি। এর মধ্যে ৫টি ভারতের, ১টি থাইল্যান্ডের এবং ১টি চীনের। ভারতীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে ভিএইচ গ্রুপ, গোদরেজ, সগুনা, টাটা এবং অমৃত গ্রুপ। তাছাড়া আছে থাইল্যান্ডের সিপি এবং চীনের নিউহোপ। এগুলো দেশের পোল্ট্রি শিল্পের শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ পুঁজি নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের সঙ্গে এক অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছে দেশী খামারগুলো। বিদেশী অর্থপুষ্ট খামারগুলো ঋণ নিয়ে আসছে ৩ থেকে ৪ শতাংশ সুদে। আর দেশী খামারগুলোকে ঋণ সংগ্রহ করতে হচ্ছে ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদে। তাই বিদেশী খামারগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে স্থানীয় বড় খামারগুলোকেও অনেক হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঝরে পড়ছে ছোট খামারগুলো। খামারিরা আরও জানান, দীর্ঘদিন যাবত পোল্ট্রি শিল্পের আয় করমুক্ত ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে এ শিল্পের কর অব্যাহতি সুবিধা তুলে নিয়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়। চলতি অর্থবছরেও তা অব্যাহত আছে। তারা জানান, বর্তমানে তারা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছেন কিছু দেশী এবং বিদেশী বড় কোম্পানির মনোপলি ব্যবসার কারণে। এসব কোম্পানির কারণেই তারা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। মনোপলির সঙ্গে জড়িত এসব বড় কোম্পানির অধিকাংশই প্রথমে ওষুধ নিয়ে মাঠে নামলেও বর্তমানে তারা নিজেরাই বাচ্চা উৎপাদন, লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগির খামার, পোল্ট্রি ফিড উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ এবং পোল্ট্র্রি ফিডের কাঁচামাল ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে।
×