ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

জহিরুলের অনন্য অর্জন

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৪ নভেম্বর ২০১৭

জহিরুলের অনন্য অর্জন

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর বায়ো ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ন্যানোটেকনোলজির এ্যাসোসিয়েট গ্রুপ লিডার, মুহাম্মদ জহিরুল আলম সিদ্দিকী সম্প্রতি প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্তকরণের এক ডিভাইস আবিষ্কার করেছেন। নেচার পাবলিশিং গ্রুপের সায়েন্টিফিক রিপোর্ট, আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালসহ কয়েকটি বিখ্যাত জার্নালে তা প্রকাশিত হয়েছে এবং তিনি ইতোমধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের প্যাটেন্ট লাভ করেছেন। সিলেটের সুনামগঞ্জের হাওড় পাড়ের সন্তান ড. জহিরুল আলম। বাবার নাম আব্দুল হাকিম তালুকদার ও মা মজলিছুন নেছা তালুকদার। তারা ৫ ভাই, এক বোন। শিক্ষা জীবন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন নিজেকে উন্নত করে মানুষের কল্যাণে কাজ করার। নিজে হাওড় পাড়ের নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়ে প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করেছেন নিজেকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রাখতে। জহিরুল কখনও তার স্বপ্ন ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি বিশ্বাস করেন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করলে সব শিক্ষার্থীর জীবনেই একদিন না একদিন উন্নতি করা সম্ভব। যারা কষ্ট দেখলে কাজ না করে সরে আসতে চান বা অনুকূল পরিবেশ না পেলে কাজ করতে চান না, তাদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম জহিরুল আলম শামীম। কারণ তার জন্য এই অর্জনের পথটা ছিল দারুণ কঠিন। হাওড় অঞ্চলের ছোট্ট এক গ্রামে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম শামীমের। থাকা-খাওয়ার পর পড়ালেখাটা তখন বিলাসিতা। কিন্তু শামীম ছিলেন নাছোড়বান্দা। প্রাথমিক তো শেষ করলেনই, লজিং থেকে পড়ালেখা চালালেন মাধ্যমিকেও। এরপর লজিং থেকে থেকে সিলেট শহরতলির মোগলা বাজারের রেবতি রমন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৯৫ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। তারপর দক্ষিণ কোরিয়ার পুসান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমান পিএইচডি করার জন্য বিশ্লেষণী রসায়নে। তার পিএইচডি গবেষণাপত্র পৃথিবীর নামকরা সব জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটিতেও বেশ কিছুকাল গবেষণা করেন তিনি। ড. সিদ্দিকী গবেষক হিসেবে বড় স্বীকৃতি পান ২০০৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার পুসান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ব্রেইন কোরিয়া ২১’ নামের শ্রেষ্ঠ গবেষণা পদকটি পাওয়ার মাধ্যমে। সে বছর কোরিয়ার বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকীতে ড. সিদ্দিকীর যেসব গবেষণা নিবন্ধ ছাপা হয়, তার ওপর ভিত্তি করেই দেয়া হয় ওই পদক। ২০০৭-এ পিএইচডিতে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য হন পুসান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র। গবেষণায় নিবেদিত থাকার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১১ ও ২০১২ পর পর দু’বার অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার সংসদ ভবনে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান অনুদানপ্রাপ্ত কৃতী বিজ্ঞানীদের, সেখানে তিনিও ছিলেন। সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিবছরই অন্তত ১ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। ক্যান্সারের চিকিৎসায় প্রতিবছরই প্রায় ৩শ’ বিলিয়ন ডলার চিকিৎসা ব্যয় করতে হচ্ছে। বাংলাদেশেও অনেক রোগী কোটি টাকা খরচ করে আরোগ্য লাভ করতে পারেনি। আর এর মূল কারন শেষ সময়ে ক্যান্সার ধরা পড়া। এ সব রোগীর যদি আগেই ক্যান্সার নির্ণয় করা সম্ভব হয় তাহলে মৃত্যু হার অনেকাংশে কমে যাবে আর সঙ্গে কমবে খরচ। ‘বাংলাদেশের মতো নিম্ন আয়ের দেশের মানুষদের কাছে সহজলভ্য হবে এমন একটি যন্ত্রের মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্তকরণের স্বপ্ন নিয়ে আমাদের জহিরুল ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল থেকে ৩ লাখ ৭২ হাজার ডলারের অনুদান পান। সেই অর্থায়নে জহিরুল এবং তার গবেষক দল এমন একটি ডিভাইস বানান, যার মাধ্যমে মানব রক্তের অভ্যন্তরে অবস্থিত অতি বিরল এক ধরনের কোষ (সার্কুলেটিং টিউমার সেল বা সিটিসি) সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা যায়, যেটি প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যান্সারের সুনির্দিষ্ট তথ্য বহন করে। এই ডিভাইসের কার্যকারিতার লিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল থেকে সাড়ে তিন লাখ ডলার অনুদান পান। বর্তমানে তিনি ন্যানোশেয়ারিং এর ভৌত গুণাবলী নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে এই পদ্ধতির পরবর্তী প্রজন্মের উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করছেন। তার এই উদ্ভাবনকে সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী করার প্রয়াস হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল হেলথ এ্যান্ড মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল থেকে ৪ লাখ ১১ হাজার ডলার অনুদান পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট ফর বায়ো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সিনিয়র গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। বাংলাদেশকে নিয়ে জহিরুল অনেক স্বপ্ন দেখেন। মন থেকে অনুভব করেন কিছু করার তাগিদ। সুযোগ পেলে বাংলাদেশে গড়তে চান একটা স্বপ্নের ল্যাব, যেখানে শুধু বাংলাদেশী নিবেদিতপ্রাণ গবেষকেরা কাজ করবেন। অবদান রাখবেন বিজ্ঞানের মৌলিক ও প্রায়োগিক শাখায়। এই ল্যাব একদিন হবেই এই বিশ্বাস তার আছে।
×