ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতি সংবাদ

চার দেশের সুরে লোকসঙ্গীত উৎসবের সমাপ্তি

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১২ নভেম্বর ২০১৭

চার দেশের সুরে লোকসঙ্গীত উৎসবের সমাপ্তি

মনোয়ার হোসেন ॥ গোধূলিলগ্নে পালাগানে শুরু হয় উৎসব। শরিয়ত ও মারফতের আশ্রয়ে চলে কবিগানের লড়াই। নারী-পুরুষ শিল্পীর যুগলবন্দী পরিবেশনার পর ভেসে বেড়ায় বাউলসাধক লালন সাঁইয়ের মরমি বাণী। সন্ধ্যা পেরোনো রাতের নির্জনতা ভেঙ্গে আলোড়ন তুলেছে পারস্যের লোকজ সুর। মোহাবিষ্ট সেই শ্রোতাকুলের শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে প্রশান্তির পরশ ছড়িয়েছে আফ্রিকার দেশ মালির লোকগীতি। ভারতের শিল্পীর ঝুমুর আর বাউল গানে মজেছে অন্তর আত্মা। শনিবার ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের সমাপনী দিনটি ছিল এমনই রঙিন। উৎসব আঙিনা বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে এদিনের পরিবেশনায় অংশ নিয়েছে চার দেশের লোকসঙ্গীত শিল্পীবৃন্দ। স্বাগতিক বাংলাদেশের সঙ্গে নানা আঙ্গিকের লোকগীতি শুনিয়েছেন ভারত, মালি ও ইরানের শিল্পীরা। চার দেশের সুরসম্মিলনে শেষ হয়েছে উৎসব। মেরিল নিবেদিত সান কমিউনিকেশন্স আয়োজিত তিন দিনের বৈশ্বিক এ লোকসঙ্গীত আসরের সূচনা হয় বৃহস্পতিবার। সমাপনী রজনী ছিল শনিবার। তিন রাতের সঙ্গীত আসরটি উপভোগ করেছে লক্ষাধিক শ্রোতা-দর্শক। শোনা গেছে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান লোকসঙ্গীত শিল্পীর গান। শেকড়ের গানে গানে অনবদ্য হয়ে ধরা দিয়েছে তিনটি রাত। লোকগানের বাণীর মাঝে আবাহন করা হয়েছে আপন সংস্কৃতি ও দর্শনকে। সেই সঙ্গে জানা হলো ভিন দেশের লোকগীতির ধারাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি চলমান সঙ্গীতাসরটি এক আঙিনায় জড়ো করেছে রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তের মানুষকে। স্বমহিমায় উজ্জ্বল উৎসবটিতে কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত মিলিয়ে পরিবেশনায় অংশ নিয়েছে বাংলাদেশসহ দশ দেশের ১৪০ লোকসঙ্গীত শিল্পী। সমাপনী সন্ধ্যার শুরুতে পরিবেশিত হয় পালাগান। মঞ্চে আসেন দেশের দুই লোকসঙ্গীতশিল্পী শাহ আলম সরকার ও আলেয়া বেগম। পালাগানের লড়াইয়ে সাজানো পরিবেশনায় শাহ আলম সরকার শরিয়তের ভূমিকায় আর আলেয়া বেগম ছিলেন মারফতের ভূমিকায়। গানে গানে শিল্পীদ্বয় উত্থাপন করেন নানা প্রশ্ন ও তার জবাব। শাহ আলম সরকার প্রথমেই গেয়ে শোনায় ‘আকাশটা কাঁপছিল ক্যান/ জমিনটা নাচছিল ক্যান।’ এর জবাবে মারফতের ভূমিকায় থাকা আলেয়া বেগম পরিবেশন করেন ‘মানুষও রতন করো তারে যতন’। এরপর শাহ আলম সরকার পরিবেশন করেন ‘আমি করি নাই/করিতে পারি নাই’। গানের কথায় ও সুরের মায়াজালে শুরুতেই আবিষ্ট হয়ে পড়ে শ্রোতার হৃদয়। দ্বিতীয় পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন কুষ্টিয়ার লোকসঙ্গীতশিল্পী শাহনাজ বেলী। কণ্ঠে আশ্রয় করেন লালন ফকির, হাছন রাজা ও শাহ আবদুল করিমের বাণী। প্রথমেই গেয়ে শোনান লালনগীতি ‘চাতক যেমন মেঘের জলবিনে/ আসায় আসায় বসে থাকে মেঘ দিয়ানে’। দর্শকশ্রোতাও যেন চাতকের মতো চেয়েছিল সুরসুধায় নিমজ্জিত হওয়ার আশায়। সেই আশা পূরণ করে সুকণ্ঠী গায়িকা গেয়ে শোনান ‘আইলা না আইলা না রে বন্ধু’। প্রেমের আর্তি জানানো তার তৃতীয় গানের শিরোনাম ছিল ‘তুমি যাইয়ো না যাইয়ো না বন্ধুরে/দুখিনীরে কান্দাইয়া’। ততক্ষণে মরমী সুর ও বাণীর জাদুতে তন্ময় হয়েছে শ্রোতা। এরপর গেয়ে শোনান ‘আগুন লাগাইয়া দিল কনে/হাছন রাজার মনে’ । এরপর পরিবেশন করেন শাহ আবদুল করিমের গান ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইলো এমন দেখা যায়/ ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপক্সক্ষী নাও’। এছাড়াও গেয়েছেন লালনগীতি ‘করি মানা কাম ছাড়েনা মদনে/ প্রেম রসিকা হব কেমনে’। পরিবেশন করেন মাইজভা-ারি গান ‘গাউসুল আজম বাবা নূরে আলম/ তুমি ইছমে আজম জগত তরানে ওয়ালা’ । এ পরিবেশনার পর ছিল উৎসবের সমাপনী আনুষ্ঠানিকতা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। অতিথি হিসেবে কথা বলেন লোকসঙ্গীত শিল্পী নাশিদ কামাল। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সান কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান অঞ্জন চৌধুরী। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, গান শুনতে হবে, গান শোনার বিষয় আছে। সুরের যা আবেদন, তা সর্বজনীন। লোকগানের ভেতরে যে কথা রয়েছে, তা মনের গভীরে গিয়ে আঘাত করে। গ্রামের নিরক্ষর মানুষ কী যে অসাধারণ গান সৃষ্টি করছে, যা আমাদের ভীষণ গর্বের। গানগুলো নিয়ে আমরা বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই বারবার। নাশিদ কামাল বলেন, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, শাহ আবদুল করিম, বাউল, জারি-সারির সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে সঙ্গীতের সঙ্গে মিশে গেছে আমাদের প্রাণ। প্রাণের খেলায় আমরা অনন্য। অঞ্জন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও সারা বাংলার আনাচেকানাচে লোকগানের যে শিল্পী রয়েছেন, তারাই আমাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে এই আয়োজন করতে। আগামী বছরও দেশ-বিদেশের শিল্পীকে নিয়ে এ উৎসব আয়োজনের প্রত্যাশা করি। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফারসি ভাষার গানকে সঙ্গী করে মঞ্চে আসে ইরানের লোকগানের দল রাস্তাক। গানের সঙ্গে যন্ত্রসঙ্গীতের চমৎকার মেলবন্ধনে দলটির পরিবেশনা হয়ে ওঠে অনবদ্য। ভাষার দূরত্ব ছাপিয়ে পারস্যের সুরমুগ্ধতা ছড়ায় শ্রোতার অন্তরে। ব্যাঞ্জো, ম্যান্ডোলিন ও গিটারের সঙ্গে বিচিত্র ইরানী পারকাশান যন্ত্রের তালে নিজেরাও যেমন নেচেছেন তেমনি নাচিয়েছেন সুররসিকদের। ১৯৯৭ সালে তেহরানে যাত্রা শুরু করা এ দলটি বিশ্বব্যাপী সঙ্গীতের শ্রোতার কাছে ফারসি লোকসঙ্গীত, ভাষা, সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে কাজ করছে। মূল ধারার সঙ্গীতের সঙ্গে ফারসি লোকসঙ্গীতকে মিশিয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করে দলটি। ‘রাস্তাক’র দলনেতা সিয়ামক সেপেহরি বিশ্বাস করেন, সঙ্গীতই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করছে। তাদের প্রাথমিক ভাবনা ছিল ইরানের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতকে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ করা। এজন্যই তারা ইরানের বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গীতকে মিলিয়ে-মিশিয়ে উপস্থাপন করে। রাস্তাকের পর মঞ্চে আসে ভারতের বাসুদেব দাস বাউল। শান্তি নিকেতনের বাতাসে, গাছের পাতায় খেলা করা এ শিল্পীর সুর। পশ্চিমবঙ্গের এ শিল্পী বাউল এবং ঝুমুর গানের দারুণ সম্ভার নিয়ে হাজির হন লোকগানের এ উৎসবে। শ্রোতার মন রাঙিয়ে গেয়ে শোনান ‘তোমায় হৃদ-মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না’, ‘চল মিনি আসাম যাবো দেশে বড় দুখরে’, ‘লাল পাহাড়ের দেশে যা রাঙা মাটির দেশে যা’, ‘চলো না আপন অন্তরে’, ‘গোলেমালে গোলেমালে পিরিত করো না’সহ একগুচ্ছ গান। উৎসবের সর্বশেষ পরিবেশনায় ভেসে আসে সাহারা মালভূমির সুর। পরিবেশনায় আফ্রিকার দেশ মালির লোকগানের দল তিনারিওয়েন। বিশ্বসঙ্গীতের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ গ্র্যামি পুরস্কারজয়ী দলটি স্মরণীয় করে রাখে উৎসবের শেষ রাতটি। ঐতিহ্যবাহী যন্ত্রের সঙ্গে গিটারের ডেসটরশনে হালকা রক ধাঁচের গান ছিল হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। তিনারিওয়েনের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের তৃতীয় আসর। আপন আপন সংস্কৃতির শেকড়ের গানে সজ্জিত এ উৎসবে শামিল হয়েছে দশ দেশের লোকগানের একঝাঁক শিল্পী। স্বাগতিক বাংলাদেশসহ বৈচিত্র্যময় পরিবেশনায় অংশ নিয়েছে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, তিব্বত, মালি, ইরান ও ব্রাজিলের শিল্পী। এ আট দেশের শিল্পীর সঙ্গে যন্ত্রসঙ্গীতে সহায়তায় করেছে জাপান ও ফ্রান্সের বাদ্যযন্ত্র শিল্পীরা।
×