ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দশমাসে প্রতিজন রোহিঙ্গার পেছনে ব্যয় হবে প্রায় ৬ হাজার টাকা: সিপিডি

প্রকাশিত: ০১:৩৩, ১১ নভেম্বর ২০১৭

দশমাসে প্রতিজন রোহিঙ্গার পেছনে ব্যয় হবে প্রায় ৬ হাজার টাকা: সিপিডি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ চলতি অর্থবছরের দশমাসে গড়ে প্রতিজন রোহিঙ্গার জন্য ব্যয় হবে প্রায় ৬ হাজার টাকা। ওই হিসেবে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ৭ হাজার ১২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, নিজ আবাসভূমি হারিয়ে রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশকে বহুমুখী সমস্যায় ফেলেছে। দ্রুত তাদের নিজভূমি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো না হলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শনিবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে সিপিডির গবেষণার এ তথ্য তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানটির আয়োজনও করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সেমিনারে অংশ নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে শিগগির দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হবে। তিনি বলেছেন, চুক্তির খসড়া তৈরি হয়ে গেছে। খুব শিগগির এ চুক্তি হয়ে যাবে। সংগঠনটির গবেষণা পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বলেন, সিপিডি ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) গবেষণা কওে দেখেছে, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ৭ হাজার ১২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ লাগবে। ওই হিসেবে প্রতিজন রোহিঙ্গার জন্য ব্যয় হবে ৫ হাজার ৯৩৯ টাকা যা আমাদের মোট বাজেটের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। আর মোট রাজস্বের ২ দশমিক ৫ শতাংশ। ওই সময় তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক সমস্যায় পড়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কটের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশের ওপর। এই তিন খাতে বাংলাদেশ নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ায় জীবন যাপনের ব্যয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সঙ্কট তৈরি করবে। সিপিডির পক্ষ থেকে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক, সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন, ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার ডেবিট এসলে, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার শাখাওয়াত হোসেন, বিশ্ব বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি ড. সুকমল বড়ুয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহাম্মেদ প্রমুখ আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমুখী সমস্যার সম্মুখিন হবে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তৃতীয় কোনো দেশ বা পক্ষ কাজ করার আগ্রহ দেখায় নি। দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। চীনকে রাজি করানো না গেলে সমাধান পরাভূত হবে। ড. রেহমান সোবহান বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যায় দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ সমস্যা বেশি দিন জিইয়ে রাখা যাবে না। এজন্য আন্তর্জাতিক মহলকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ নিতে হবে। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের সমস্যা। মানবতা বিরোধী গণগত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। ড. দেবপ্রিয় বলেন, বিশ্বব্যাপী ৬৫ মিলিয়ন মানুষ এখন উদ্বাস্তু। একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশ ৪র্থ সর্বোচ্চ আশ্রয় দাতা। এ সমস্যা সমাধানে এখনই স্বল্প ও মধ্য মেয়াদী উদ্যোগ নিতে হবে। সুকমল বড়ুয়া বলেন, এটি একটি মানব জাতির সমস্যা। মানবতার সমস্যা। মুসলিম বা বুদ্ধ বলে তাদের আখ্যায়িত না করে মানুষ হিসাবে সমস্যার সমাধান করতে হবে। অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহাম্মেদ বলেন, রোহিঙ্গাদের নিধনকে মিয়ানমার জেনোসাইড চালচ্ছে। এটাকে গণহত্যা বললে ভালো হবে। কারণ জেনোসাইড ও গণহত্যার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। সরকারকে আন্তর্জাতিক সহায়তা নিতে তৎপরতা বাড়াতে হবে। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আমরা সবধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। এরপরও শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চলছে। মিয়ানমার সফরে গিয়ে ২৩ নবেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী নেপিদো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ সংক্রান্ত চুক্তির যে খসড়া, তা তৈরি হয়ে গেছে। খুব শিগগির চুক্তিটা হবে। সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান শুরুর পর সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার সীমান্তে এ সঙ্কট তৈরি হয়। এদিক থেকে চলতি অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত মাসগুলোকে এই গবেষণায় হিসাব করা হয়। গবেষণায় বলা হয়েছে এ সঙ্কটে ইতোমধ্যে সেখারকার পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় সামাজিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। জনসংখ্য বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সমস্যা, স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটে পরিবেশের ওপর প্রভাব তুলে ধরে ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, কক্সবাজারে মোট বনভূমির পরিমাণ ২০ লাখ ৯২ হাজার ১৬ একর। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে এরইমধ্যে ৩ হাজার ৫০০ একর বনভূমি ক্ষতি হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী অধ্যুষিত এলাকায় বায়ু দূষণ, ভূমিধসের মতো ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনুদান বা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের মতো দাতা সংস্থাগুলো অন্য সেক্টরের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে হবে না। আরও নমনীয় হয়ে অনুদান প্রদান করতে হবে। এছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প বা এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ওমাদক চোরাচালান বন্ধে জোরদার পদক্ষেপ নিতে হবে।
×