ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকের নামে একটি অনলাইন পোর্টালের ডোমেইন কেনা হয় এর মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী নানা অপপ্রচার চলে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার পর গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে গেছেন কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে

সিজার নিখোঁজ রহস্য আরও ঘনীভূত ॥ কেঁচো খুঁড়তে সাপ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১১ নভেম্বর ২০১৭

সিজার নিখোঁজ রহস্য আরও ঘনীভূত ॥ কেঁচো খুঁড়তে সাপ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের হাসান সিজার নিখোঁজ রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার যোগাড় হয়েছে। নিজের নিরাপত্তার জন্য নিজেই বাসায় সিসি ক্যামেরা লাগালেও নিরাপত্তা চেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন না হওয়ার ঘটনা রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। এই শিক্ষকের নামে বিডি পলিটিকো নামের একটি অনলাইন পোর্টালের ডোমেইন কেনা রয়েছে। ওই অনলাইনের মাধ্যমে সম্প্রতি রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী নানা অপপ্রচার চালানো হয়েছে। ওই শিক্ষক নিজেই, নাকি কোন গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে তার অনলাইন পোর্টাল হ্যাক করে অপপ্রচার চালিয়েছে সে বিষয়ে গভীর তদন্ত চলছে। জঙ্গীবাদ নিয়ে কাজ করতে করতে নিজেই জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার পর গ্রেফতার এড়াতে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে চলে গেছেন কিনা সে প্রশ্নও সামনে চলে এসেছে। গত ৭ নবেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও থানায় পুত্রের নিখোঁজের বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মোতাহের হোসেন (৬৫) একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। জিডিতে বলা হয়, ওইদিন সকাল সাতটার দিকে রাজধানীর খিলগাঁও থানাধীন দক্ষিণ বনশ্রীর ২৫ নম্বর সড়কের ১২/৩ নম্বর বাড়ি থেকে কর্মস্থল বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় গুলশানের বারিধারা ক্যাম্পাসের উদ্দেশে বের হয় সিজার। এর পর থেকেই সে নিখোঁজ। নিখোঁজ সিজারের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত করছে। সিজারের বোন তামান্না তাসমিন জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি ফেনীর দাগনভূঁইয়া থানায়। সিজার মতিঝিল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি ও ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে অনার্স করেন। যুক্তরাজ্যে মাস্টার্স করেন। দেশে ফিরে আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফামে দেড়বছরের মতো কাজ করেন। এর পর অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামের প্রভাব কতটা ভূমিকা রাখছে, সেটিই ছিল সিজারের পিএইচডি থিসিসের বিষয়বস্তু। দেশে ফিরে সিজার ঢাকার বেসরকারী ইউল্যাব ইউনিভার্সিটিতে মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে শিক্ষকতা করেন। প্রায় দুই বছর সেখানে কাজ করার পর ৬/৭ মাস আগে তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ইসলাম, রাজনীতি এবং জঙ্গীবাদ বিষয়ে সম্প্রতি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও জার্নালে তার গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর দিল্লীভিত্তিক একটি জার্নালে বিশ্বায়নের ছায়ায় বাংলাদেশে কিভাবে রাজনৈতিক ইসলাম ও উগ্রবাদী সহিংসতা ছড়াচ্ছে সে সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রায় দুই বছর ধরে তিনি ফেসবুকে বিরক্তিকর বার্তা পেয়ে আসছিলেন। সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, নিখোঁজ হওয়ার পর সিজার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। সে মোতাবেক ব্যক্তি জীবনে সিজার খানিকটা উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী ছিল বলে তথ্য মিলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ায় পড়ার সময়ও তিনি সেই বিশ্বাস থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। পরবর্তীতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার পর সেই উগ্র মতবাদের বিশ্বাস তার মধ্যে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে। জঙ্গীবাদ নিয়ে কাজ করতে করতে তিনি এক সময় নিজেই জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী হন বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য মিলেছে। তারই প্রেক্ষিতে নিজের মতামতসহ অনেক কিছুই প্রকাশ করতে তিনি বিডি পলিটিকো নামের একটি অনলাইন পোর্টালের ডোমেইন কেনেন। পোর্টালটির মাধ্যমে সম্প্রতি রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী মারাত্মক অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তবে এর সঙ্গে সিজার সরাসরি জড়িত নাকি তার পোর্টাল হ্যাক করে কোন গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এমন অপপ্রচার চালিয়েছে, তা নিশ্চিত নয়। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে। সিজার নিখোঁজের সঙ্গে ওই গোষ্ঠীর কোন যোগসূত্র আছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। নিখোঁজ সিজারের চাচা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মঞ্জুর হোসেন জানান, গত ২৫ অক্টোবর ছাত্র পরিচয়ে একজন সিজারকে খুঁজতে বাসায় এসেছিল। সিজার ওই সময় বাসায় ছিল না। এরপর থেকেই সিজার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল। নিজের নিরাপত্তার জন্য বাসায় সিসি ক্যামেরাও স্থাপন করেছিল। সিজারের বোন তামান্না আরও জানান, ব্যক্তিগত জীবন, কর্ম ও গবেষণা সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের তেমন কিছুই জানাতেন না সিজার। এছাড়া প্রায় সব বিষয় নিয়েই পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতেন। তিনি সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন ইউএনডিপি পরিচালিত একটি প্রজেক্টে গবেষণার কাজ করতেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ওই সূত্রটি বলছে, ধারণা করা হচ্ছে আগ থেকেই উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী সিজার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন ইউএনডিপির সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিষয়ক একটি প্রকল্পে গবেষণার কাজে যোগ দেন; যাতে ওই প্রজেক্টের ভেতরে আসলে কি হচ্ছে, তা জানার চেষ্টা করছিল। সিজার আসলে কোন গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করতেই ওই প্রকল্পে পরিকল্পিতভাবে প্রবেশ করেছিল কিনা তা জানার চেষ্টা চলছে। সিজারও হয়ত এক সময় বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল। এজন্য নিজেকে আড়াল করতেই স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে চলে যেতে পারে। তবে সে ইতোমধ্যেই দেশের বাইরে চলে গেছে কিনা সে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। সে বিষয়ে বিমানবন্দর ও সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে ছবিসহ বিশেষ বার্তা দেয়া হয়েছে। কোন গোষ্ঠী দ্বারাও সিজার অপহৃত হতে পারে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সিজার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। ফেসবুকে নানা ধরনের আপত্তিকর ম্যাসেজ পাচ্ছিলেন। এরপর তিনি নিজেই নিজের নিরাপত্তার জন্য বাসায় একাধিক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেন। নিরাপত্তার জন্য স্বাভাবিক কারণেই বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা প্রয়োজন ছিল। সিজার তা করেননি। এটি নিজেকে আড়াল করার কৌশল বলে মনে হচ্ছে। কারণ, যারা উগ্র মতবাদ বা জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী হয় বা জঙ্গীবাদের হয়ে কাজ করে বা জঙ্গীবাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে তারা সাধারণত কোন প্রয়োজনেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যেতে চান না। কারণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করলে তার তদন্ত হয়। তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে। প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে প্রকৃত রহস্য। এজন্যই হয়ত সিজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যাওয়াটা নিরাপদ মনে করেননি। ধারণা করা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নিজের নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করতে গেলে প্রাথমিক তদন্তেই হয়ত আরও আগেই সিজার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নিজের নিরাপত্তা না চাওয়ার পেছনে বিশেষ রহস্য রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, হিযবুত তাহরীরের মাধ্যমে এদেশে আধুনিক জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তন হয়। আর এর কারিগর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা। লন্ডনে পড়াশোনাকালীন তিনি জঙ্গী সংগঠনটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। নিখোঁজ সিজারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করেছেন। সেক্ষেত্রে উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী এই শিক্ষকের জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়া বিচিত্র নয়। জঙ্গী সংগঠনটি গঠনের ক্ষেত্রে বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শেখ তৌফিক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। হিযবুত তাহরীরের ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির নীতি গবেষণা কেন্দ্রের ট্রাস্টি ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন ড. তৌফিক। এরপর থেকেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গীবাদের আস্তানা গড়ে ওঠে। ব্লগার রাজীব হত্যাকারীর পাঁচ জনই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। ব্লগার হত্যা থেকে শুরু করে সর্বশেষ হলি আটিজানে হামলা করে ১৭ বিদেশীসহ ২২ জনকে হত্যার সঙ্গেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্র ও শিক্ষকের নাম আলোচনা আসে। হামলার অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে ধরা হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমকে। হামলাকারীর একজন নিবরাজ ইসলাম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ছিলেন। এ ব্যাপারে পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক চাঁদপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেন গুম, অপহরণ ও নিখোঁজ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নিখোঁজ শিক্ষক সিজার ও সাংবাদিক উৎপলের সন্ধান চলছে। সিজারের সন্ধান চলছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
×