ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খুশির উপহার

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১১ নভেম্বর ২০১৭

খুশির উপহার

॥ এক ॥ ‘অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে, আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে।’ সুরেলা কণ্ঠে পড়ানো হচ্ছে বস্তিরই এক কোণে, একচিলতে ফাঁকা জায়গায়। বর্ণ পরিচয়ের এমন মধুর কণ্ঠ খুশির মনেও দোলা দেয়। আর দোলা দেয় বলেই পড়া শুরু হওয়া মাত্র খুশিও এসে হাজির হয়। সূর্যের আলো তখন ফিকে হয়ে এসেছে। শিক্ষকের উদ্দেশ্যে খুশি বলে, অজগরটা তেড়ে আসলে আমটা কেমনে খাবো স্যার? স্যার এবার দ্বিধায় পড়ে যান। খুশির উদ্দেশ্যে বলেন, ঠিক তো, সাপটা তেড়ে আসলে আম তো খাওয়া যাবে না, তখন পালাতে হবে তাই না? ছাত্র-ছাত্রীরা সমন্বরে বলে ওঠে জ্বি স্যার, জ্বি স্যার, জ্বি স্যার। পড়া শেষে ঘরে ফিরে মায়ের অপেক্ষার প্রহর গোনে খুশি। আজ মা তাকে কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন সেই আনন্দই ফিরে ফিরে মনে পড়ছে। জন্মদিনের মায়ের সাথে রাজিবদের বাসায় এসে খুশির মন আনন্দে ভরে ওঠে। যে রুমটা কেক কাটার জন্য সাজানো হয়েছে সেখানে শো-কেসে থরে থরে সাজানো রাজিবের খেলনা। অন্য শিশুদের যখন কেকমুখি মোম জ্বালানোর সময় ব্যস্ততায় আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছে, তখন খুশির দৃষ্টি শুধুই শো-কেসের দিকে। সে দৃষ্টি তীক্ষ্ন আর মনোযোগী। আর মনে মনে কী যেন বিড় বিড় করে বলতে থাকে। বলবেই না কেন? ওর বয়স মাত্র চার বছর। মোম জেলে হ্যাপি বার্থ ডে বলার সাথে সাথে যখন রুমের মধ্যে পার্টি-স্প্রে করা হয়, তখন তুষারপাতের মতো স্প্রে-র স্ফুরণগুলো বেলুনে পড়ছে আবার কারো কালো চুলের ওপর পড়ে বরফের কুচির মতো দেখাচ্ছে। কেক খাওয়া পর্বের মাঝেই শুরু হয় জরি মাখানো উল্লাস। এ-ওর গালে ছুয়ে দিলেই হয়ে যাচ্ছেÑসোনালি, আরেকজনের রুপালি। হরেক রকমের টুসটুসে গালগুলো জরিতে রঙিন হচ্ছে। উচ্ছ্বাসের মাঝেই বানুর হাতে উপহার সামগ্রী জমা হতে থাকে। খুশি ওর মায়ের আঁচল ধরিয়ে বলেÑমা, মারে, এত্তগুলা উপহার সব রাজিব ভাইয়ের? ওর মা বলেন, হ। আরো পাইবো, ওই শোকেসে দেখছোস, ওগুলা সবই জন্মদিনে পাইছে, বুচ্ছোস? খুশি কণ্ঠ ভারি করে বলে, মারে আমার জন্মদিন হয় না ক্যা? মা খুশির কথার উত্তর না দিয়ে উপহারগুলো থরে থারে সাজাতে থাকে। ॥ দুই ॥ খুশি বেশ কয়েকদিন ধরে কান্নাকাটি করতে করতে বানুকে ধৈর্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। মেয়ের ঘ্যানর ঘ্যানর আর ভাল্লাগে না। পাঁচ-ছয়টা বাড়িতে কাজ শেষ করে যখন বস্তির ঘরে ঢোকে তখন মায়াভরা চোখে খুশিকে কাঁদতে দ্যাখে। কাঁদতে কাঁদতে খুশি বলে, মারে আমার জন্মদিন কবে হইবে? খুশিকে বুকে জড়িয়ে বানু তখন বলতে থাকে হবে মা, আর কদিন পরেই হবে। মাসটা আগে যাইয়া লউক, তারপর তোর জন্মদিন করমু। খুশিকে ঘরে রেখে বানু বাসাবাড়িতে কাজের উদ্দেশ্যে বেরোলে, খুশি বস্তির অন্য একজনকে বলে, এ মাস শ্যাস হইতে আর কদিন আছে বিকাশ ভাই? বিকাশ খুশির থেকে ৩ বছরের বড়। বিকাশ বলে, এই জন্যই তো পড়াশোনা শিখতে হবে। এই তো আইজক্যা ২৯ তারিখ আর মাত্র ২ দিন। মাসের হিসাব দিয়া তুই কী করবি? খুশি তখন আবেগ আর উচ্ছাস মিশিয়ে বলে, আর জন্মদিন হইবে। আই তোরে দাওয়াত দিমু। জানিস সেদিন রাজিব ভাইয়ের জন্মদিনে মা আমারে ওদের বাসায় নিয়া গেছিল। জন্মদিনে কত্ত মজা, জানোস আমারে সবাই উপহার দিবে, বড় বড় খেলনা, সুইচ লাগানো গাড়ি, ব্যাটারিলাগানো মোয়াইল। বিকাশ ভাবতে থাকে এ বস্তিতে এর আগে তো কোনোদিন কারো জন্মদিনের আয়োজন করা হয় নি। সত্যি সত্যি কি খুশির জন্মদিন হইবে? ॥ তিন ॥ আজ খুশির জন্মদিন। বানু যে বাসাগুলোতে কাজ করে তাদের সবাইরে দাওয়াত করেছে। বস্তিরও আট-দশ ঘরে দাওয়াত করেছে। পাশের বেকারি থেকে ৫০০ টাকা দিয়া কেক বানিয়ে এনেছেন। কেকটা ছোট বলে খুশির মন ভরে নি। মাকে বলেছে, এত্তটুকুন কেক? মা তখন উত্তর দেন নি। কাক্সিক্ষত সেই ক্ষণের অপেক্ষা। সাতটায় কেক কাটা হবে। সাতটা বাজার আগেই বস্তির অনেকে এসেছে। বাসাবাড়িতে কাজ করা কোনো অতিথি এখন এখন পর্যন্ত না-আসাতে বানু পথের দিয়ে চেয়ে গাইগুঁই করছে। বস্তির এ ঘরে কেউ ঢুকলেই খুশি দৌড়ে গিয়ে আড়চোখে দেখতে চেষ্টা করে উপহারের প্যাকেকটা কেমন? না, ওর মন ভরে না। এ পর্যন্ত যারা এসেছে সবাই খুশির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর মুখটা মলিন, উচ্ছ্বাস নেই। খুশির আবেগহীন চাহনি। সেই চাহনিতে আনন্দের ছোঁয়া নেই। বিকাশ খুশির দিকে এগিয়ে এসে তাই বলেই ফেললো কিরে খুশি তুই এমন মনমরা হয়ে আছিস ক্যান? তুই কেক কাটবি, কত্ত মজা হবে। এরই মধ্যে বাসাবাড়িতে কাজ করা একজন এসে হাজির। ইয়া বড় একটা উপহার বাক্স নিয়ে। বাক্সটা দেখে খুশির মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। সবাই বলাবলি শুরু করে নিন শুরু করুন, সবাই এসে গেছে। বস্তির ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারে না কার জন্য এত অপেক্ষা। সময় চলে যায়, বাসাবাড়িতে কাজকরা অন্যরা না-আসায় বানুরও আনন্দের মাঝে শূন্যতা বিরাজ করে। অবশেষে শুরু হলো সেই গান হ্যাপি বার্থ ডে টু খুশি। একটা ঝিলিক মার্কা হাসি দিয়ে খুশি মোম নিভিয়ে ফেলার পরপরই কেক কাটে। সাথে সাথেই মুহুর্মুহু হাততালি। অনুষ্ঠান শেষে প্রতিবেশিরা সবাই চলে যায়। উপহারগুলোর সামনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে খুশি। খুশির চোখের দিকে তাকাতে পারেন না বানু। খুশিকে উদ্দেশ্য করে তার অনুরোধগুলো উথলে ওঠে ঠিক আছে মা তোরে আমি সামনের মাসেই সুইচঅলা গাড়ি, ব্যাটারিঅলা মোবাইল কিনে দেব।
×