ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারকে বিব্রত করতেই বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের ঘটনা তদন্ত কমিটির ধারণা

ঢাকায় সরকারী হাসপাতাল ক্যান্টিনে সিসি ক্যামেরা লাগানোর ধুম

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১১ নভেম্বর ২০১৭

ঢাকায় সরকারী হাসপাতাল ক্যান্টিনে সিসি ক্যামেরা লাগানোর ধুম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করে সরকারকে বিব্রত করতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনে মুরগি ও গরুর পচা মাংস ঢোকানো হয়েছিল বলে তদন্ত কমিটির ধারণা। এর সঙ্গে জড়িত একজন শনাক্ত হয়েছে। সন্দেহভাজন আরেকজনের বিষয়ে তদন্ত চলছে। এমন ঘটনার পর সরকারী হাসপাতালে খাবারের মান উন্নত রাখতে নিয়মিত মনিটরিং করার কড়া নির্দেশ জারি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এমন নির্দেশনার পর ঢাকার সরকারী হাসপাতালগুলোর রান্নাঘর ও ক্যান্টিনে অতিরিক্ত সিসি ক্যামেরা লাগানোর ধুম পড়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাপসাতাল ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের ক্যান্টিন ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। পর্যায়ক্রমে হাসপাতালের প্রতিটি জায়গা ও আশপাশের স্থানগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যৌথভাবে নিরাপত্তার বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিং করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৭ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ক্যান্টিনে পচা মাংসের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পরে ক্যান্টিন থেকে মুরগি ও গরুর পচা মাংস উদ্ধার হয়। ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখার পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশের প্রতিটি হাসপাতালের নিরাপত্তা জোরদার ও খাবারের মান উন্নত রাখতে কড়া নির্দেশনা জারি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে ঘটনাটি তদন্ত করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। কমিটির সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ডাঃ এটিএম খালেক জনকণ্ঠকে বলেন, নানা ধর্মের মানুষ থাকায় ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ঘটনার দিন মুরগি ও গরুর পচা মাংস ক্যান্টিন থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় বাবুর্চি জাহিদ মোল্লাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ম্যানেজার জাহিদ হোসেনের বিষয়ে তদন্ত চলছে। ভবিষ্যতে যাতে এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা আর না ঘটে এজন্য নিরাপত্তা জোরদার ও ক্যান্টিনের ওপর মনিটরিং করা হচ্ছে। ক্যান্টিনটি শর্তসাপেক্ষে টেন্ডারের মাধ্যমে কোন নামীদামী প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ বিষয়ে একটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। পরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে বা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ক্যান্টিনের সাবেক ম্যানেজার জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এটি পুরোপুরি ষড়যন্ত্র। বাবুর্চি নিজে লাভবান হতে বা পরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠানের দুর্নাম ছড়াতে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। এমন ঘটনার পেছনে তার কোন হাত নেই। ম্যানেজার জাহিদ হোসেনের এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বাবুর্চি জাহিদ মোল্লা জনকণ্ঠকে বলেন, চাকরি হারানোর ভয়ে ক্যান্টিন মালিক জাহিদ হোসেনের চাপের মুখে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে নিজে ফ্রিজ থেকে পচা মাংস এনেছেন বলে জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান জনকণ্ঠকে বলেন, বাবুর্চি বা অন্য কেউ ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে ঘৃণ্য ওই কাজটি করেছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তবে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তি এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি-না সেটিও ভাবনার বিষয়। তিনি আরও বলেন, জায়গাটি এক সময় খুবই নোংরা ছিল। পরিষ্কার করে সেখানে একটি বসার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র হিসেবে জায়গাটিকে আরও সুন্দর করে সাজানো হয়। সেখানে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে সস্তায় উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করতেই বসানো হয় পরিচ্ছন্ন ক্যান্টিন। প্রবেশমুখে নিরাপত্তার জন্য আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়। ছাত্র-শিক্ষকরা ব্যস্ততা শেষে সেখানে নিরিবিলি বসে আরাম করতে পারেন। পরিবেশের কারণেই জায়গাটি খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারই মধ্যে এমন ঘটনা বেশ রহস্যজনক। এমন ঘটনার পর ক্যান্টিনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সেখানে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সার্বক্ষণিক আনসার মোতায়েন রয়েছে। আমি নিজেও টিএসসি দেখভাল করতে যাই। সেখানকার খাবারের মান ঠিক আছে কি-না তা যাচাই করতে মাঝেমধ্যে নিজেও নানা খাবার খেয়ে পরীক্ষা করি। ভবিষ্যতে যাতে আর এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, এজন্য বাড়তি মনিটরিং চলছে। নিজেই মনিটরিং করি। তিনি জানান, ইতোমধ্যেই ক্যান্টিনে খাবার তৈরি, সরবরাহসহ অন্যান্য কাজের সঙ্গে জড়িতদের হ্যান্ডগ্লাভস পরিধান বাধ্যতামূলক, গলায় পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে রাখাসহ নানা নিয়মকানুন চালু করা হয়েছে। দেশের এমন একটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যাতে নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি না হয়, এজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ক্যান্টিনের এমন ঘটনায় শঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক লাউঞ্জ ক্যান্টিনের ম্যানেজার আলী হোসেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে ক্যান্টিনটি সুনামের সঙ্গে চলছিল। আচমকা এমন ঘটনা বেশ রহস্যের জন্ম দিয়েছে। এর পেছনে ষড়যন্ত্র থাকা বিচিত্র নয়। আমি নিজেও শিক্ষক লাউঞ্জের ক্যান্টিনের নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি নজরদারি বাড়িয়েছি। আপদকালীন সময়ে টিএসসি ক্যান্টিনটি চালাচ্ছি। তবে অজানা আশঙ্কায় এবং ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে দীর্ঘদিনের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে আমার আর ক্যান্টিনটি চালানোর ইচ্ছা নেই। বিষয়টি আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর সরেজমিন বুধবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসাপাতালের ক্যান্টিনের সামনে এবং আশপাশে বাড়তি সিসি ক্যামেরা লাগাতে দেখা গেছে। হাসপাতালটির ক্যান্টিনের ম্যানেজার বাবুল জনকণ্ঠকে বলেন, ক্যান্টিনের সিসি ক্যামেরা আগে হাসপাতালের অন্য একটি কক্ষ থেকে মনিটরিং করা হতো। এখন হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া নিজেই মনিটরিং করেন। রুমে বসেই সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ক্যান্টিনের চিত্র দেখেন। মাঝেমধ্যেই আচমকা রান্নাঘরে ঢুকে হাঁড়িপাতিল খুলে খাবারের মান দেখেন। কোন প্রকার নিম্নমানের খাবার দেয়ার সুযোগ নেই। পুলিশও মাঝেমধ্যে এসে তদারকি করে। সরেজমিন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের নিচে থাকা আনিতা রেস্টুরেন্ট ও ক্যান্টিনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে পাঁচটি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। ক্যান্টিনের ম্যানেজার মোহাম্মদ ইউসুফ জনকণ্ঠকে বলেন, সকালে মুরগির পাইকারদের খবর দিয়ে ক্যান্টিনের সামনে আনা হয়। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লোকের উপস্থিতিতে মুরগি কিনে তা জবাই করা হয়। কোন প্রকার পচা-বাসি খাবার দেয়ার সুযোগ নেই। সপ্তাহখানেক আগেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্যান্টিনের ভেতর পর্যন্ত ঘুরে দেখে গেছে। ক্যান্টিনে নিয়মিত মনিটরিং ও অডিট হয়। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্যান্টিনের যাবতীয় কার্যক্রম মনিটরিং করে থাকে। সম্প্রতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্যান্টিনের খাবারের বিষয়ে আগের চেয়ে বেশি তৎপর।
×