ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোটর মেকানিক মিজান এখন আবিষ্কারক

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ১১ নভেম্বর ২০১৭

মোটর মেকানিক মিজান এখন আবিষ্কারক

শার্শা উপজেলার মোটর সাইকেল মেকানিক মিজান এখন দেশসেরা আবিষ্কারক ও উদ্ভাবক হতে যাচ্ছেন। মিজানের একাডেমিক কোন শিক্ষা না থাকলেও আজ তিনি নিজের আলোয় আলোকিত। নতুন চিন্তা আর নতুন গবেষণায় আজ তার আবিষ্কারের সংখ্যা ৮টি। তাঁর গবষেণা ও উদ্ভাবন নিয়ে দেশ এবং জাতি এখন গর্বিত। মিজানের ভবিষ্যত নিয়ে এখন স্বপ্ন দেখছে গোটা দেশ ও জাতি। শার্শা উপজলোর নাজিমপুর ইউনিয়নের আমতলা গাতপিড়ার অজপাড়া গাঁয়ে ১৯৭১ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণ করেন মিজান। তার ভাল নাম মিজানুর রহমান। পিতা আক্কাস আলী ও মাতা খোদেজা খাতুন। আজ আর তারা কেউ বেঁচে নেই। পিতা-মাতার ৬ সন্তানের মধ্যে মিজান ৫ম। বর্তমান শার্শা উপজেলা সদরের শ্যামলাগাছি গ্রামে তিনি বাস করেন। দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া শিখতে পারেননি মিজান। ৮/৯ বছর বয়সেই বেঁেচ থাকার তাগিদে নেমে পড়েন মজুরের কাজে। মাঠে শ্যালো মেশিন চালানো এবং মেরামতের কাজ করেন তিনি। পরবর্তীতে নাভারণ বাজারে একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজে কাজ পান তিনি। সেখান থেকেই তার মোটর মেকানিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। বর্তমানে শার্শা বাজারে ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ নামে একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজ আছে তার। ছোটবেলা থেকেই তার শখ ছিল নতুন কিছু করা, নতুন কিছু জানা। তবে মেকানিক হিসেবে তার ইঞ্জিন তৈরি করতে প্রবল আগ্রহ ছিল। মিজান প্রথমে উদ্ভাবন করনে হাফ ক্রানসেপ্ট দিয়ে একটি আলগা ইঞ্জিন। এই ইঞ্জিনের সকল যন্ত্রপাতি দেখা যেত বাইরে থেকে। ইঞ্জিনটি একবার জ্বালানি তেল দিয়ে চালু করলে পরবর্তীতে আর তেলে লাগত না। ইঞ্জিনের সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে জ্বালানি তৈরি করে নিজে নিজে চলত ইঞ্জিনটি। ঢাকার তাজরিন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির পর মিজান দ্বিতীয় গবষণা করে উদ্ভাবন করেন স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, যা বাসা বাড়ি, কলকারখানা, অফিস-আদালতে আগুন লাগলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি রোধে ৫ থেকে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে আগুন নেভাতে শুরু করে। এটি বিদ্যুৎ না থাকলেও চলবে। এই যন্ত্রটি অল্প জায়গায় রাখা যায়। কোন জায়গায় আগুন লাগলে যন্ত্রটি তার তাপমাত্রা নির্ণয়ক যন্ত্রের মাধ্যমে আগুনের অবস্থান নিশ্চিত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ্যালার্ম ও লাইট অন করে দেয়। তারপর একইসঙ্গে সংযুক্ত মোবাইল থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে ফোন করে দেয়, পাশাপাশি যন্ত্রটি পানির পাম্পকে সুইচ অন করে দেয়। যা আগুনের অবস্থান নিশ্চিতের ৫/৭ সেকেন্ডের মধ্যেই সম্ভব। অতঃপর পানির পাম্পের সঙ্গে সংযুক্ত পাইপের মাধ্যমে আগুনের অবস্থান পৌঁছে দেয় এবং অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত ফাঁপা বলয়ের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আগুন নিভে যায়। এটি উদ্ভাবনের পর ২০১৫ সালে যশোর জেলা স্কুলের একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় মিজান এটি প্রদর্শন করে প্রথমস্থান অধিকার করেন। পরবর্তীতে এটি বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় প্রথম ও দ্বিতীয়স্থান অধিকার করে। দেশে পেট্রোল বোমায় যখন মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছিল ঠিক সে সময়ে মিজান উদ্ভাবন করেন তার তৃতীয় উদ্ভাবন অগ্নিনিরোধক জ্যাকেট। এ জ্যাকেট পরে ড্রাইভার বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিরাপদে কাজ করতে পারবেন। এতে আগুনের মাঝে গিয়ে জানমাল রক্ষা করার সময় তার শরীরে আগুন স্পর্শ করবে না। তার চতুর্থ উদ্ভাবন অগ্নিনিরোধ হেলমেট। এটি ব্যবহার করলে দুর্ঘটনার আগুনে গলার শ্বাসনালি পুড়বে না। তার পঞ্চম উদ্ভাবন হলো প্রতিবন্ধীদের জীবন-মান উন্নয়নে মোটরকার। এটা বিদ্যুৎ বা পেট্রোল চালিত। কৃষকদরে জন্য স্বয়ংক্রিয় সেচ যন্ত্র উদ্ভাবন হলো তার ষষ্ঠ উদ্ভাবন। কৃষকরা দূর-দুরান্তের মাঠে জমিতে পানি দিতে আর ক্ষেতে যেতে হবে না। বাড়ি বসেই সেচযন্ত্রটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বন্ধ বা চালু করতে পারবেন। তাছাড়া এ যন্ত্রটি জমিতে পানির প্রয়োজন হলে নিজে নিজেই চালু হয় এবং পানির প্রয়োজন না থাকলে এটি একা একাই বন্ধ হয়ে যায়। দেশী প্রযুক্তিতে মিজান তার সপ্তম উদ্ভাবন করেছেন ফ্যামিলি মোটরযান। ব্যবহারযোগ্য এ কার এলাকার মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। মিজানের অষ্টম উদ্ভাবনে রয়েছে পরিবেশ সেফটি যন্ত্র। এটি পরিবেশ রক্ষার্থে বহুমুখী কাজ করে থাকে। যন্ত্রটি বাড়ি, অফিস বা কলকারখানায় ময়লা পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। হাতের স্পর্শ ছাড়াই এ যন্ত্রটি পরিষ্কর করার কাজে ব্যবহার করা হয়। এ যন্ত্র উদ্ভাবনের পর ২০১৬ সালের ৫ জুন জাতীয় পর্যায়ে মিজান পরিবেশ পদক লাভ করেন। জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে মিজান এ পর্যন্ত মোট ১৭টি সাফল্য সনদ ছাড়াও পেয়েছেন অসংখ্যা ক্রেস্ট ও সাফল্য পুরস্কার। এরই মধ্যে তার আবিষ্কৃত দেশীয় প্রযুক্তির মোটরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ টু আই প্রকল্পের আওতাভুক্ত হয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নে ছোট ছোট এ্যাম্বুলেন্স তৈরি করার পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। -সাজেদ রহমান, যশোর অফিস থেকে
×