মনোয়ার হোসেন ॥ বিকেল থেকেই উন্মুক্ত উৎসব আঙিনায় সারি বেঁধে শ্রোতাদের প্রবেশ। এর পরের আখ্যানটি সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাতের। মৃত্তিকাসংলগ্ন গানে গানে দেশ-বিদেশের লোকসঙ্গীত শিল্পীদের মন মাতানোর গল্প। অনবদ্য সব পরিবেশনায় সিক্ত হলো নিবন্ধনের মাধ্যমে অংশ নেয়া হাজারও গানপ্রেমীর অন্তর আত্মা। লোকজ বাংলার বাউল গান থেকে শোনা গেল সাম্বা ও ফ্ল্যামেঙ্কো নাচের ছন্দোময় ব্রাজিলিয়ান লোকগানের সুর। ভারতের অসমিয়া সুরের সঙ্গে মন রাঙালো তিব্বতের পাহাড় ও ঝরনার শব্দধ্বনিময় লোকসঙ্গীতের সুর। বৈশ্বিক লোকগীতির সম্মিলনে যান্ত্রিক শহরে বয়ে গেল স্বস্তির সুবাতাস। মাটি ও মানুষের কথা বলা লোকগানের সুরে রঙিন হলো কংক্রিটের শহর ঢাকা। শেকড়সন্ধানী সুরধারায় ঝলমল করে উঠলো নগর। এমনই মোহময় রূপে ধরা দিলো ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের প্রথম রাতটি। বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার থেকে থেকে শুরু হলো তিন দিনের এ উৎসব। সূচনা দিনে গান শুনিয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন বাংলাদেশ, ভারত, ব্রাজিল ও তিব্বতের শিল্পীরা। তৃতীয়বারের মতো মেরিল নিবেদিত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টের আয়োজক সান কমিউনিকেশন্স।
আপন আপন সংস্কৃতির শেকড়ের গান গান শোনানো এ আয়োজনে শামিল হয়েছেন দশ দেশের ১৪০ জন লোকগানের শিল্পী। ১৬টি পরিবেশনায় সাজানো হয়েছে তিন দিনের উৎসব। স্বাগতিক বাংলাদেশসহ বৈচিত্র্যময় পরবেশনায় অংশ নিচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, তিব্বত, মালি, ইরান ও ব্রাজিলের শিল্পী। এই আট দেশের শিল্পীদের সঙ্গে যন্ত্রসঙ্গীতের সহায়তায় থাকবে জাপান ও ফ্রান্সের বাদ্যযন্ত্র শিল্পীরা।
হেমন্ত সন্ধ্যায় দেশের শিল্পীদের গানের সুরে শুরু হয় উদ্বোধনী দিনের পরিবেশনা। মঞ্চে আসে টেলিভিশন রিয়েলিটি শো ম্যাজিক বাউলিয়ানার একঝাঁক নবীন লোকসঙ্গীত শিল্পী। সম্মেলক কণ্ঠে আশ্রিত হয় বাউলসাধক লালন ফকিরের মরমি বাণী। সুরের বাঁধনে সবাই মিলে গেয়ে ওঠে ‘ধন্য ধন্য বলি তারে/বেঁধেছি এমন ঘর/শূন্যের উপর...’। পরের গানে আরেক কিংবদন্তি লোকসঙ্গীতশিল্পীকে স্মরণ করে গীত হয় ‘বাউলা কে বানাইলো রে/হাসন রাজারে বাউলা কে বানাইলো রে...’।
বাউল ও সুফি গানের সহযোগে দ্বিতীয় পরিবেশনা উপস্থাপন করেন ফকির শাহাবুদ্দিন। প্রথমেই গেয়ে শোনান ‘ওগো দীন বন্ধু দয়া করো গো আমারে’। হৃদয়ের আকুলতা প্রকাশিত দ্বিতীয় গানের শিরোনাম ছিল ‘তুই যদি হইতি গলার মালা রে/ রঙ্গিলা আদরে গলে পরাইয়া ...’। শ্রোতাকে উচ্ছ্বসিত করা শিল্পী এরপর কণ্ঠে তুলে নেন সাধক বাউল শাহ আবদুল করিমের সহজিয়া বাণী। তৃতীয় গান ছিল ‘কি যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে ...’। সম্প্রীতির বার্তাবহ চতুর্থ গানের শিরোনাম ছিল ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...’।
ভাষার দূরত্বকে সুরেলা শব্দের মাধুর্যে মিলিয়ে দেয় ব্রাজিলিয়ান ফোকস্টার মোরিসিও টিযুমবা ও তার দল সেক্সটেট। গায়কীর সঙ্গে নাচের তালে উপস্থাপিত হয় ব্রাজিলের সমৃদ্ধ লোকসঙ্গীত। গিটারের সঙ্গে মাদকতাময় ঢোলের বাদনে নেচে ওঠে শ্রোতাদের একাংশ। টিযুমবার জটা চুলের মাথা দোলানো পরিবেশনা হয়ে ওঠে দারুণ উপভোগ্য।
এ পরিবেশনা শেষে ছিল আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত আসরের উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সান কমিউনিকেশনসের চেয়ারম্যান অঞ্জন চৌধুরী। অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, লোকসঙ্গীত শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশী ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
লোকসঙ্গীত উৎসবের তাৎপর্য তুলে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, তৃতীয়বারও আমি উদ্বোধন করছি, এই আসরটি তাই বিশেষ কিছু। বাংলার লোকগান যে আমাদের হাড়ে হাড়ে মিশে আছে। এখানে মানুষ উঠতে বসতে গান গায়, ধান ভানতে গান গায়। ভাটিয়ালি, জারি সারি কত রকমের লোকগান আমাদের দেশে। লোকসঙ্গীত প্রতিনিয়ত আমাদের সমৃদ্ধ করে। রুচি কেউ জন্ম থেকে পায় না। এটা অর্জন করতে হয়। আর এই উৎসব সেই রুচি বিকাশের মাধ্যম।
অঞ্জন চৌধুরী বলেন, গত দুই বছরের ধারাবাহিক সাফল্যে এ বছর তৃতীয় আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পুরো বিশে^র মানুষ এখন এই উৎসব উপভোগ করছে। এ উৎসব আমাদের, আপনাদের এবং পুরো দেশের গর্ব।
সাঈদ খোকন বলেন, অর্থনীতির চাকা যখন ঘুরছে, তখন সংস্কৃতির বিকাশ যতটুকু হওয়ার দরকার ছিল, ততটুকু কিন্তু হয়নি। সংস্কৃতির বিকাশে এ উৎসবটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ।
চতুর্থ পরিবেশনায় তিব্বতের শিল্পী তেনজিন চোয়েগাল ড্রানিয়েন নামের এক ধরনের গিটার এবং লিংবু বাঁশি বাজিয়ে গান পরিবেশন করেন। অচেনা ভাষার পাহাড়ী সুর আশ্রয়ী সেই গান শ্রোতার হৃদয়তন্ত্রীতে ছড়িয়েছে প্রশান্তির পরশ। তিব্বতীয় হলেও এই শিল্পীর গানের বিশেষত্ব হচ্ছে তবলার বোলে বোলে গান করা।
বৃহস্পতিবার রাতের শেষ পরিবেশনা উপস্থাপন করেন ভারতের লোকগানের তারকা শিল্পী পাপন। আসামের আঞ্চলিক গানের পাশাপাশি বাংলা ও হিন্দী ভাষার গান। শ্রোতার তুমুল করতালিকে সঙ্গী করে রাত ১১টার দিকে মঞ্চে আসেন এই শিল্পী। প্রথমেই গেয়েছেন তার তুমুল জনপ্রিয় গান ‘দিনে দিনে’। হিন্দি গানের শিরোনাম ছিল ‘তেরে বিন নেহি লাগতা’। গানের ফাঁকে ফাঁকে কথোপকথনে মাধ্যমে শ্রোতার সঙ্গে বাড়িয়ে নেন আত্মিক বন্ধন।
বৃহস্পতিবার শুরু হয়ে শনিবার পর্যন্ত চলমান উৎসব প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হয়ে চলবে রাত দেড়টা পর্যন্ত। মেরিল নিবেদিত এবারের উৎসবে পৃষ্ঠপোষকতা করছে ঢাকা ব্যাংক। অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হতে না পারলেও উৎসব উপভোগের সুযোগ রয়েছে শ্রোতাদের। ফেসবুকের ‘ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোকফেস্ট’ পেজ এবং নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে পুরো অনুষ্ঠানটি লাইভ দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ছুটির দিনের উৎসবসূচী ॥ আজ শুক্রবার উৎসবের দ্বিতীয় দিন। ছুটির দিনে বৈশ্বিক লোকগীতির এ আসরে পরিবেশনা উপস্থাপন করবে দেশের লোকসঙ্গীতের ব্যান্ডদল বাউলা। একক কণ্ঠে গান শোনাবেন দেশের দুই শিল্পী আরিফ দেওয়ান ও শাহজাহান মুন্সি। এদিনের পরিবেশনায় আরও অংশ নেবে নেপালের লোকগানের দল কুটুম্বা, পাকিস্তানের লোকসঙ্গীত দল মিকাল হাসান ব্যান্ড। এদিনের বিশেষ আকর্ষণ ভারতের পাঞ্জাবের দুই বোনের দল নুরান সিস্টার্স পরিবেশনা নিয়ে হাজির হবে সব শেষে।