নির্মলেন্দু গুণ বাংলাদেশের কবিতায় অনিবার্য কবিপুরুষ। দীর্ঘদিন তিনি লিখে চলেছেন কবিতা। গদ্যও লিখেছেন নেহাত কম নয়। কবি হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন সেই ষাটের দশকেই। এখনও তার কলম সমানভাবেই সচল। কথা হলো কবি হিসেবে তার সফলতা আসলো কীভাবে। কীভাবে একজন হয়ে ওঠেন যথার্থ কবিপুরুষ। প্রতিভা? শুধুই কি প্রতিভার জোরে! এগুলো আসলে অন্য কথা অন্য বিষয়। আপাতত এসব থাক। তবে কবি হতে হলে যে ভাঙাচোরা বিধ্বস্ত জীবন যাপন করতে হয় তা তিনি ষোলআনাই করেছেন। সঙ্গে ছিলেন প্রাণপ্রিয় বন্ধু অকাল প্রয়াত কবি আবুল হাসান। নির্মলেন্দু গুণ কবি কারণ তার হৃদয়ে আছে আগুন। সেই আগুন যা একজন মানুষকে পুড়িয়ে করে তোলে পুরোদস্তুর কবি :
আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি
কোমল বিদ্রোহী, প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে,
অথচ আমার সঙ্গে হৃদয়ের মতো মারাত্মক
একটি আগ্নেয়াস্ত্র, আমি জমা দিইনি।
[আগ্নেয়াস্ত্র/না প্রেমিক না বিপ্লবী]
নির্মলেন্দু গুণ কি একজন জনপ্রিয় কবি? উত্তরে বলতেই হবে- বটেই। কিন্তু ‘জনপ্রিয়’ তো একটি ঝুঁকিপূর্ণ অভিধা। ‘জনপ্রিয়’র মধ্যে আছে সাময়িকতার ছোঁয়া। তবে গুণ কিন্তু কোনো সাময়িক সময়ের জন্য কবি নন। জনপ্রিয়তা ছাপিয়ে তিনি তাঁর কাব্য প্রতিভা দিয়ে হয়ে উঠেছেন শিল্পোত্তীর্ণ কালোত্তীর্ণ। ‘হুলিয়া’, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’, ‘যুদ্ধ’র মতো কবিতাগুলো এ কথার প্রমাণ :
যুদ্ধ মানেই শত্রু শত্রু“ খেলা,
যুদ্ধ মানেই
আমার প্রতি তোমার অবহেলা।
[যুদ্ধ/ প্রেমাংশুর রক্ত চাই]
রাজনীতি, প্রেম, দ্রোহ, যৌনতা, সমাজসচেতনতা গুণের কবিতার প্রধান উপজীব্য। বাংলাদেশে রাজনীতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সফল কবিতা লিখেছেন এই কবি। এ প্রসঙ্গে গুণকে নিয়ে কবি আবুল হাসান লিখেছেন :
গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি!
মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি!
[অসভ্য দর্শন/ রাজা যায় রাজা আসে]
বাংলাদেশের কবিতায় শৈলীতে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ এবং পরবর্তীতে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ও আবিদ আজাদ। গুণের কবিতা থেকে আমরা শৈলীর চমৎকার উদাহরণ পেশ করতে পারি :
রমণীর ভালবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,
নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে, এর ঠিক ডানপাশে, অইখানে
হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাত রাখো, ওটাই হৃদয়।
[ওটা কিছু নয়/কবিতা, অমীমাংসিত রমণী]
গুণের কবিতায় সুর ও স্বরে রয়েছে এক ধরনের আত্মাভিমান যেমন আবুল হাসানের কবিতায় আত্মদহন ও আত্মহনন :
আমি বলছি না ভালবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক। কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক : ‘তোমার চোখ এত লাল কেন?’
[তোমার চোখ এত লাল কেন/যখন আমি বুকের পাঁজর খুলে দাঁড়াই]
বলার অপেক্ষা রাখে না যে গুণের কবিতায় ফৎধসধঃরপ য়ঁধষরঃু উল্লেখযোগ্য মাত্রা পেয়েছে :
আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
চতুর্দিকে চিক্চিক করছে রোদ্দুর;
আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন
একটি রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে।
[হুলিয়া/নির্মলেন্দু গুণ]
কবি বঙ্গবন্ধুর প্রতি আজন্ম অনুরক্ত :
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেসব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
[আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি/নির্মলেন্দু গুণ]
কিছু কিছু কবিতায় গুণ উপসংহারে এসে শিথিল হয়ে গেছেন অর্থাৎ উপসংহার অনেকটা জোলো হয়ে গেছে। এর পেছনে কি কাজ করেছে কবিতায় পেশাদারিত্বের গন্ধ! অবশ্য কবিতার কোন পঙ্ক্তি কেন দুর্বল বা কেন শক্তিশালী সে তো প্রমাণসাপেক্ষ কিছু নয়, তাই উদাহরণ টানা প্রাসঙ্গিক নয় বোলেই বোধ করি। তবে সংক্ষিপ্তভাবে এটুকু বোলতেই হবে নির্মলেন্দু গুণ বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি আমাদের স্বাধীনতার সফল ভাষ্যকার :
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
[স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো/চাষাভুষার কাব্য]
পরিশেষে পাঠকের অবগতির জন্য জানাতে চাই স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো প্রকাশ পেয়েছে চর্চা গ্রন্থ প্রকাশ থেকে। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ২৫০ টকা।
শীর্ষ সংবাদ: