ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অরূপ তালুকদার

গল্প ॥ পাপাগ্নি

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১০ নভেম্বর ২০১৭

গল্প ॥ পাপাগ্নি

সারাটা দিন মন খারাপ ছিল শুভর। সবকিছুই এলোমেলো মনে হচ্ছিল। কোন কাজ করতে ইচ্ছে হয়নি। সারাক্ষণই এটাসেটা চিন্তা ভাবনার মধ্য দিয়ে সময় কেটেছে। আসলে সেদিনের সেই রাত থেকেই এমনটা হয়েছে। যত সময় গেছে, শুভ ধীরে ধীরে বিষয়টা নিয়ে যত ভেবেছে তত গভীর এবং জটিল হয়ে উঠেছে সবকিছু। আর ভেতরের কষ্টটা! সেটাও তো ক্রমে ক্রমে আরো গভীরতর হয়ে দেখা দিচ্ছে শুভর সমস্ত চেতনায়। এই কষ্টটাকে তো সে অন্য আর কারোর সঙ্গেই শেয়ার করতে পারবেনা, কারণ এটাতো এ্যাবসোলিউটলি তার নিজের ব্যাপার। মানুষের জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন চারপাশের সব কিছুকেই অন্যরকম মনে হয়। চেনা পথগুলি অচেনা হয়ে যায়। চেনাজানা মানুষগুলি যেন নতুনরূপে আবির্ভূত হয় চোখের সামনে। শুভ কাকে কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। কাউকেই বিশ্বাস করতে মন চায় না। এমনকি শুভ গতরাতে যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল তখন নিজেকে নয়, সে অবাক হয়ে দেখেছে যেন অন্য এক মানুষকে। আসলে কি সে পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত হয়েছে অন্য মানুষে! অথচ এমন হবার তো কথা ছিল না। শুভ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে তার এই সাতাশ বছরের জীবনে হঠাৎ পাল্টে যেতে পারে তার এত দিনের জীবন যাপনের ধারা, ভালোলাগা, মন্দ লাগা, এমনকি চাওয়া পাওয়ার সব হিসাব নিকাশ পর্যন্ত। হঠাৎ এক সময় তার খুব হাসি পেয়ে যায়। একা একা এতসব চিন্তা সে তার নিজের মাথায় যেন ধরে রাখতে পারে না। নিজেকে কখনো কখনো এত অসহায় মনে হয় যে সে বোধহয় একসময় পাগল হয়ে যাবে। নিজের মনকে প্রবোধ দেয়ার মতো কিছুই খুঁজে পায়না শুভ। সবচাইতে খারাপ লাগে কারন এসব বিষয় নিয়ে কারোর সঙ্গে সে আলাপ আলোচনাও করতে পারছে না। পারলে হয়তো মনের ভার অনেকটা লাঘব হতো। তাই মনের ওপর পাথরের মতো চেপে বসে আছে সমস্ত বিষয়টা। এক সময় শুভ পরিস্কার বুঝতে পারে জীবনের যাত্রাপথে চোরাবালিতে ডুবতে বসেছে সে। আদিতির সঙ্গে দেখা হয়নি দু’তিন দিন। না, তিনদিন নয়, দু’দিন। কিন্তু এর মধ্যে তার ফোনের কামাই হয়নি। নাম সেভ করা ছিল বলে প্রতিবার দু’তিনটে রিং হবার পরেই লাইন কেটে দিয়েছে। কথা বলার ইচ্ছেই হয়নি। অথচ অদিতির সঙ্গে কথা বলা, মাঝে মাঝে একটু আধটু ঘুরে বেড়ানো ছিল দু’জনার বলা যায়, দৈনদিন কাজ। কোনদিন কোন কারনে দেখা না হলে কেমন পাগল পাগল লাগত। চারপাশে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। এমন কেন হতো, বলে বোঝাতে পারবেনা কেউ। অদিতি নামের বিশ বাইশ বছরের এই মেয়েটা শুভ’র কী হয়? তার কি প্রেমিক না কি বান্ধবী নাকি অন্য কিছু, কে জানে। অথচ তেমন করে দু’জনকে দু’জনার কেউ স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। তবু কেন জানি একজনের জন্য আরেকজনের কী যে টান- সেটা দু’জন ছাড়া আর কেউ কি তেমন করে বুঝতে পারবে। যেমন কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যায় টিএসসির সামনে রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে শুভ জানতে চেয়েছিল আচ্ছা, একটা কথা বলোত, এই যে তোমার সঙ্গে আমার বা আমার সঙ্গে তোমার সম্পকটা কী? মুখের কাছ থেকে চায়ের কাপটা একটু নামিয়ে অদিতি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে শুভর দিকে। তারপর বলে, প্রশ্নটা তো বেশ কঠিন হয়ে গেল। উত্তরটা কি এখনি চাই, নাকি পরে দিলেও চলবে। ব্যাপারটা খুব জরুরী নয়- শুভ বলে, তবে জানতে ইচ্ছে করছিল। এ প্রশ্নটা তো আমিও করতে পারি তোমাকে। পারি কিনা? অদিতি তাকায় শুভর দিকে। নিশ্চয়ই পারো। তা হলে উত্তরটা আগে কে দেবে? অদিতির মুখে কিছুটা হাসির ঝিলিক। তুমি না আমি? লেডিস ফার্স্ট- আর প্রশ্নটা আমিই করেছি আগে। কথার মাঝখানে চাঅলার পয়সা দিয়ে দেয় শুভ, বলে, একটু ওপাশে চলো। অদিতি বাঁ হাতে ধরা বইটা ডান হাতে নিয়ে দোকানের সামনে থেকে সরে আসে। চারিদিকে ছেলে মেয়েদের আনাগোনা বেড়েছে। পাশের রাস্তায় বেড়েছে নানা ধরনের যানবাহনের শব্দ। গাড়ির হর্ণ। এ সবের মধ্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আস্তে কথা বললে ঠিক শোনা যায় না। দু’জনে ঘোরানো উচু জায়গাটা থেকে নীচে রাস্তায় নেমে আসে। শুভর একটা হাত ধরে নেমে নীচে হাতটা ছেড়ে দেয় অদিতি। কী করবে এখন, শুভ তাকায় অদিতির দিকে। আর কিছুক্ষন পরে বাসায় চলে যাবো। অদিতি বলে, তার আগে এখান থেকে অন্য কোথাও চলোতো। শুভর হাত ধরে আস্তে টান দেয়, চলো- কী ব্যাপার! শুভ ফেরে অদিতির দিকে, এখান থেকে চলে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছো কেন? এখানে আমার ভালো লাগছেনা। কেমন যেন ভয় লাগে। কেন? জানি না। বাহ্ , ভালোই বললে, শুভ বলে, এখানে থাকতে চাইছোনা, অন্য কোথাও যেতে চাইছো। কিন্তু কেন? অদিতি এদিক সেদিক তাকিয়ে এবারে নীচের দিকে তাকায়। বলে, আজকে আমার যেন কেন ভালো লাগছেনা। কী হয়েছে? জানি না। তারপর- মনটা কেমন যেন লাগছে। কোন কিছু বুঝতে পারছিনা। বাসায় কোন ঝামেলা হয়েছে? না। স্কুলে? সেখানেও কিছু হয়নি। তাহলে? বলছিতো কোথাও কিছু হয়নি, তবু মনটা খারাপ লাগছে। এমন মন খারাপের কোন মানে নেই। শুধু শুধু মন খারাপ হয় পাগলের। তুমি জানো! অদিতি তাকায় শুভর দিকে । তুমি তো পাগলের ডাক্তার নও বলেই জানতাম। আমার সর্ম্পকে আর কি জানো? আরেকদিন বলব। এখন হাঁটোতো ওদিকে- অদিতি হাত তুলে শাহবাগের দিকটা দেখায়। আজিজে যেতে চাইছো? না। তাহলে? মোড় থেকে বাস ধরব। বলছি না মন ভালো নেই। বাসায় ফিরব। মন কেন ভালো নেই, তা কিন্তু বললেনা- বলছিতো, জানি না। বলতে বলতে সামনের দিকে পা বাড়ায় অদিতি। মেয়েদের নিয়ে এই এক সমস্যা , শুভও চলতে থাকে অদিতির সঙ্গে। সাবধানে দু’জনে মোড়টা পেড়িয়ে ওপাশের ফুটপাতে গিয়ে ওঠে। এই অদিতির সঙ্গে দু’দিন দেখা হয়নি। কথাবার্তাও হয়নি। শুভর মন ভালো ছিল না। মন ভালো খারাপের কথা বলতে গেলে সেদিনের কথাও মনে পড়ে যায় । সেদিন অদিতির মন ভালো ছিল না। সে কথা অদিতি বলার পর শুভ তেমন গুরুত্ব দেয়নি তার কথার । আজ কী হচ্ছে? শুভর মন খারাপ সেই কারনে সে অদিতির সঙ্গে কথা বলছেনা। দেখা করছেনা। নাহ্ এসব কথাও এখন আর যেন ভাবতে চাইছেনা শুভ। সমস্ত শরীর আর মন জুড়ে কেমন একটা অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু যত যা-ই হোক না কেন? অদিতির মতো এমন সাদাসিধে শান্ত স্বভাবের একটি মেয়েকে কড়া বা উল্টোপাল্টা কোন কথা বলতেও যেন মন চায়না। কোন কিছু লুকাতে ও মন চায় না। ওর স্বভাবটা এমন যে, যখন যেমন কথা মনে আসে অকপটে বলে দেয় কোন অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা ভাবনা না করেই। শুভর কোন কথা তার পছন্দ না হলে সেটা চেপে না গিয়ে বরং সরাসরি বলে দেয়। সাধারন ঘরের ছেলেমেয়েরা একটু চালাক চতুর হয় প্রথম থেকেই। সেটা যেমন পরিবেশের কারন তেমনি আবার পারিবারিক কারনেও। স্বভাবে একটু ভীত হলেও সেটা তারা কাটিয়ে দিতে চায় একটু আধটু চালাকির মধ্য দিয়ে। এসব ঘরের মেয়েরা বড় হতে হতেই শিখে ফেলে বাড়ির বা ঘরের সব কথা সবাইকে বিশেষ করে বাইরের কাউকে বলতে হয় না। শুভর এখনো মনে হয়না অদিতি তার বা তার পরিবারের কোন কথা প্রসঙ্গক্রমে এলেও চেপে গেছে বা গোপন করেছে। আর নিজের কথা, তেমন তো কিছু নেই-ই যে বলবে। তাহলে? শুভ এখন কী করবে? সে তার নিজের কোন কথাকে গোপন রাখবে অদিতির কাছে? এমন একটা প্রশ্নের মুখোমুখি কখনো দাঁড়াতে হবে সেটা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি শুভ। কিন্তু কীভাবে সে বলবে তার ফেলে আসা জীবনের সেই অজানা অধ্যায়ের নির্মম কাহিনী। আজ, এতদিন পরে সেটা কি সম্ভব! লম্বাটে ছিপছিপে ফর্সা চেহারার অদিতির সঙ্গে শুভর পরিচয় হয়েছে বছর খানেকও হয়নি। অদিতি তার মাস কয়েক আগে নতুন একটা ইংরেজী-বাংলা দু’ভার্সনেই পড়ানো হয় এমন একটা স্কুলে চাকরী নিয়েছে। এর আগে ছিল অন্য একটা স্কুলে। ইংরেজীতে অনার্স করে শেষ পর্যন্ত মাস্টার্স আর করা হয়নি। তার আগেই সংসারের চাপে চাকরী নিতে বাধ্য হয়েছিল আগের স্কুলেটিতে, তাও বছর তিনেক আগে। পরে দু’তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকার কারনে এই নতুন স্কুলে আসার পর পদমর্যাদাও কিছু বেড়েছে। বেতনও বেড়েছে। দু’দিকেই সুবিধা হয়েছিল অদিতির। শুভ এ স্কুলে এসেছিল নিজের ব্যক্তিগত কোন কাজে নয়। সে যে অফিসে কাজ করে সে অফিসের এক সিনিয়র কর্মকর্তার ছোট ছেলেটিকে নিয়ে। ভদ্রলোক তখন কী কাজে ভীষন ব্যস্ত ছিলেন। তারমধ্যেও টেলিফোন করে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে শুভর সঙ্গে তার ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্কুলে। সেদিনই স্কুলে পরিচয় হয়েছিল শুভর সঙ্গে অদিতির। সেদিনের সেই আলাপ পরিচয়ের মাধ্যমে আন্তরিকতা ছিল। তার ফলশ্রুতিতেই ধীরে ধীরে একজন আরেকজনের কাছে এসেছিল এক সময়। তবে দুজনার এই কাছাকাছি আসাটা বলা যায়, বন্ধুত্বের পর্যায়েই রয়ে গেছে এখনো, বেশি কিছু নয়। আসলে কি তাই? দু’জনার মনের মধ্যেই এই প্রশ্নটা এসে আবার চলে যায়। স্থায়ী হয় না। শুভ তবু মাঝে মাঝে এটা সেটা প্রশ্ন করে অদিতির মনের কথাটা বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু শুভর কিছু কিছু প্রশ্ন যে অদিতিকে কখনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়, সেটা যখন বুঝতে পারে শুভ তখন আর সামনে এগোয় না। আজকাল একটা অদ্ভুত মানসিকতা পেয়ে বসেছে শুভকে। মাঝে মাঝে এসে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। কোথাও কি কোন পরিবর্তন হয়েছে? সরাসরি সে কিছু অবশ্য দেখতে পায় না। শরীরের ভেতরে যদি কোন পরিবর্তন হয়ও সেটা তার অলক্ষ্যেই ঘটেছে। কিন্তু মনের দিক থেকে যা হচ্ছে সেটা এখন এরকম ঘৃনারই নামান্তর। কিন্তু তাতে তারকি কোন দোষ আছে? তেমনটা মনে হবার কোন কারন নেই। তবু মাঝে মাঝে কেন যে মনে হয় ভাগ্য বলতে যা বোঝায়, তা থেকে সে বঞ্চিত। প্রথম প্রথম এনিয়ে খুব কষ্ট বোধ করত মনে মনে। এখন করে না। কারন সে শুধু এটুকু মেনে নিয়েছে যে, যার ভাগ্যে যা লেখা আছে, সেটাকে পাল্টানোর ক্ষমতা অন্তত তার নেই। যদি থাকত তাহলে আজকের এই শুভ অন্য এক শুভতে রূপান্তরিত হতো। ভাগ্য তাকে নিয়ে অনেক খেলেছে। ঘুরিয়েছে নানা পথে। শুভ ভাবে, ভাগ্যের পরিহাসেই সাত বছর বয়সেই সে বলা যায়, পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মা’র সঙ্গে বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। কেন গিয়েছে একজন আরেকজনের কাছ থেকে দূরে সরে ঐ বয়সে সে ঠিক বুঝতে পারেনি। মা তাকে সবসময় বুকের মধ্যে আগলে রেখেছে। কেন তুমি বাবাকে ছেড়ে এলে আমাকে নিয়ে? এ প্রশ্নের উত্তরে মা তাকে শুধু বলেছে , শুভ এই প্রশ্নটা তুমি আমাকে আর কোনদিন ক’রোনা। কেন? সেটাও তোমার জানার দরকার নেই। কেন মা, বাবার কোন অন্যায় ছিল? আমি তো বলেছি, শুভ এসব প্রশ্ন তুমি আমাকে করবে না। তারপরও যদি কর তাহলে — মা হঠাৎ চুপ করে যান। একটু পরে বলেন, তাহলে তুমি আমাকেও হারাবে। আমি আত্মঘাতী হব। সেই শেষ। তারপর কত বছর গেছে শুভ মার সেই বলা যায়, রহস্যময় আচরনের জন্য কোনদিন কোন প্রশ্ন করেনি। একসময় এ বিষয়টা যেন মন থেকে মুছে গেছে। কিন্তু ভাগ্য তাকে নিয়ে এখন আবার কোন নিষ্ঠুরতায় মেতেছে, কে জানে। শুভ বুঝতে পারে, আবার কেন যেন মার কাছেই যেতে হবে সেদিনের সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে। কেন মা অমনভাবে বাবার জীবন থেকে চলে এলো?। বাবাও কেন এ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করল না। কেমন যেন নীরবে মার চলে যাওয়াকে সে মেনে নিল। না কি পালাতে চাইল মা’র কাছ থেকে । এসব তখন ভালো করে বুঝতেও পারেনি শুভ তার সেই বয়সে। কিন্তু এখন সেই প্রশ্নের উত্তরটা জানা জরুরী হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি একটা বড় বেসরকারি সংস্থার মুক্তিযুদ্ধ প্রকল্পে পার্ট টাইম কর্মী হিসেবে ঢুকেছে শুভ। এই কাজটা নেবার পেছনে ছিল শুভর প্রবল ইচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার ইচ্ছে মনে মনে সে পোষন করত অনেক আগে থেকে। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিল না। এবারে এই প্রকল্পের খবরটা পেয়েই সে তাই সময় নষ্ট না করে ঐ সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। কাজও পেয়েছে এই প্রকল্পে। জেলাওয়ারী মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার , কুখ্যাত হত্যাকারী এবং দালালদের নামধাম এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাদের কার্যাবলীর বিস্তারিত ডাটাবেজ তৈরী করা হচ্ছে। প্রকল্পাধীন কাজে যাদেরকে নেয়া হয়েছে তাদেরকে তাদের নিজ জেলাতেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা পরিচিত এলাকা ও মানুষদের মধ্যে কাজ করতে পারে। শুভ পার্টটাইমার বলে তাকে মূল কাজের দায়িত্বগ্রহন কারী নাসির চৌধুরীর সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন নয়, তিনদিন পর পর নাসিরের সাথে বসে সংগৃহীত সব তথ্য কম্পিউটারে তুলে নেয় শুভ। এক বছরের প্রকল্প। মাসখানেক হয় কাজ শুরু হয়েছে। নাসিরের সঙ্গেঁও কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছে কাজের সূত্রে। শুভ তার জেলা সর্ম্পকে খুব ভালো জানে না কারন ছোট বেলা থেকেই সে ঢাকায় মানুষ হয়েছে মায়ের কঠোর তত্বাবধানে। মা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন একটা স্কুলে। প্রথমে সেটা ছিল একটা প্রাইমারী স্কুল পরে আস্তে আস্তে উচ্চমাধ্যমিকে রূপান্তরিত হয়েছে। শুভর মা অর্থাৎ ফিরোজা বেগমের ধীরে ধীরে পদোন্নতি হয়েছে। এখন সে সহকারী প্রধান শিক্ষিকা। অনেক দায়িত্ব পালন আর পরিশ্রমের ফলে ফিরোজা বেগমের চেহারাটাই যেন পাল্টে গেছে। কথা বলেন খুব কম। প্রয়োজনের বাইরে কথা বলতেও তার যেন অনীহা ফুটে ওঠে। শুভ তার মাকে দেখে আর অবাক হয় মাঝে মাঝে, বাবাকে ছেড়ে আসার সময় যে মানুষটিকে দেখেছিল শুভ এখনকার এই মানুষটির সঙ্গে যেন তাকে কোনভাবেই মেলাতে পারেনা। মাথার চুল অর্ধেক সাদা হয়ে গেছে। মুখেচোখে একটা অকারন কাঠিন্য সমসময়ই যেন ফুটে থাকে। কথা বলতে শুভর ভয় হয় মাঝে মাঝে। আর সেজন্যই হয়তো কাজটা নেবার আগে মাকে কিছুই জানায়নি শুভ। যদি বারন করেন কোন কারনে। তাহলে তো আর মনের ইচ্ছে পূর্ণ হবে না, মুক্তিযুদ্ধ সর্ম্পকে তথ্যাদি জানা থেকেও বঞ্চিত হবে। এ রকম সুযোগ আর কোথায় পাবে সে? যে জেলায় কাজ করছে শুভ সে জেলা তার জেলা, এটা মার কাছ থেকেই কবে যেন শুনেছে সে। বাস্তবে এখন স্থায়ী ঠিকানা শুভদের ঢাকাই। কারন বাল্যকালের স্থায়ী ঠিকানা তাদের মুছে গেছে। শুধু থানা আর গ্রামের নামটা আবছা মনে আছে। জেলায় নামটা ওর সঙ্গেই আসে। বিস্তারিত কিছুই জানে না শুভ। ডাটা এন্ট্রির কাজ করতে গত সপ্তাহেই কেমন একটা বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছির শুভ। নাসির যখন জিজ্ঞেস করে, আপনি তো এই এলাকা অর্থাৎ আব্দুল্লাহপুর, মানিক নগর আর ধুলিয়াপাড়ার মানুষ। থাকতেন নাকি আবদুল্লাহপুরে। তাহলে এখানকার অবস্থা একাত্তরে কেমন ছিল বলতে পারছেন না কেন? শোনেননিও কিছু, আশ্চর্যতো। আশ্চর্যতো অবশ্যই, শুভ মেনে নেয় মনে মনে কেননা মা তাকে এখানকার কোন কিছুই বলেননি। যেন তাদের জীবন থেকে এ জায়গায় স্মৃতিও মুছে গেছে। নাসির বলে, আব্দুল্লাহ্পুর আর মানিকনগরে তো একাত্তরে বেশ বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ হয়েছে। দু’তিন দিন ধরে এই এলাকার চারপাঁচটা গ্রামে মিলিটারী আর রাজাকার মিলে নরক করে ফেলেছিল। প্রায় সব বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, লুটপাট হয়েছে ব্যাপক অজানা সংখ্যার নারী ধর্ষিতা হয়েছে। নিহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। স্থানীয় মানুষজন বলেছে জনৈক কাশেম ওরফে কাশু মোল্লার নেতৃত্বেই এই নারকীয় কান্ড ঘটেছে এই এলাকায়। দেশ স্বাধীন হবার কয়েকদিন পরে কাশু মোল্লা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন আর মুক্তি যোদ্ধারা তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু কাশুমোল্লা আর তার কয়েক সহযোগিদের মধ্যে শুধু বাছেতকে ধরতে পারা গেছিল। এদের হাতেই সে মারা যায়। মারা যাবার আগে সে বলেছিল, কাশু লুটপাটের টাকা পয়সা আর সোনাদানা নিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। যদিও পরবর্তী কালে তার আর হদিশ পায়নি কেউ। শোনা গেছিল কাশু মোল্লা ঢাকায় এসে ডেরা বেঁধেছিল তখনকার রামপুরার বিল এলাকার একপাশে। অনেকটা দুর্গম স্থানে। পরে আবার স্থানবদল করেছে। র্ধূত কাশেমের কাছে তখন অনেক টাকা-পয়সা থাকার জন্য নাম বদলে নতুন মানুষে রূপান্তরিত করেছে সে নিজেকে । মিশে গেছে ভদ্রসমাজে। তারপর উঠেছে আরো ওপরে। নামধাম ভোল পাল্টিয়ে সে তখন তো আর রাজাকার কমান্ডার কাশেম ওরফে কাশু মোল্লা ছিল না। সে তখন অন্য মানুষ। পরবর্তীকালে প্রধানত ঢাকাতেই এই ধরনের মানুষেল সংখ্যা কেবল বেড়েছেই, কমেনি। সেদিন ডাটা এন্ট্রির কাজ সেরে ঘরে ফিরতে ফিরতে শুভর কানে নাসিরের সেই কথাগুলি বারবার জেগে উঠেছিল। থাকতেন না কি আব্দুল্লাহ্পুরে। তাহলে এখানকার অবস্থা একাত্তরে কেমন ছিল, বলতে পারছেন না কেন? শোনেননিও কিছু? আশ্চর্য তো। আর্শ্চয হবার মতই বিষয় কারন এতদিনেও এখান শুভ থাকে বা না থাকে, এখানকার কথা কিছুই জানবেন না, সেটা তো নয়, এ সব কথা বললে কেউ কি বিশ্বাস করবে? তাই নাসিরের কোন প্রশ্নেরই কোন উত্তর দেয়নি শুভ। মনে মনে ভেবে রেখেছে মায়ের সঙ্গে এসব ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে হবে, তাতে মা যাই বলুক না কেন। জেনে নিতে হবে কাশেম ওরফে কাশু মোল্লার ব্যাপারটাও। মার তো এসব না জানার কথা নয়। এদিকে আরেকটা খটকা বেঁধেছে নিজের নামেও। শুভর ভালো নাম জসিমউদ্দিন মল্লিক শুভ। বাবার নাম আব্দুল কাদের মল্লিক। মায়ের নাম ফিরোজা বেগম। প্রথমে স্থায়ী ঠিকানা ছিল আব্দুল্লাহ্পুর , কুষ্ঠিয়া। পরে স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা দেয়া হয়েছে ঢাকায়। এর সবকিছুর মধ্যেই যেন গোলমাল দেখতে পায় শুভ। আগে এসব নিয়ে কোন ভাবনা চিন্তা হয়নি। এখন পড়ে গেছে সে এক বিভ্রান্তির মধ্যে। আসলে ডাটা এন্ট্রি করতে গিয়েই বিভ্রান্তি বেড়েছে। নাসিরের সঙ্গে কর্থাবার্তা বলে বোঝা গেল ঐ এলাকায় মল্লিক বাড়ির কোন হদিস নেই। নিহত আহত বা নির্যাতিত মানুষগুলোর মধ্যেও হিন্দু বা মুসলমান কারো নামের টাইটেলে মল্লিক নেই। তাহলে তার বাবার মল্লিক পরিবার তখন ছিল কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর সে নিজে জানে না। মা কি দিতে পারবে ? এই প্রশ্নটিকেই মাথায় নিয়ে সেদিন ঘরে ফিরে এসেছে শুভ। রাতে অনেকটা জেদের বশেই মার ঘরে ঢুকল শুভ। খাওয়া দাওয়া হয়ে গিয়েছে। মা টেবিলের সামনে বসে। সামনে কয়েকটা খাতাপত্তর । একটা খোলা খাতার সামনে মাথা ঝুকিয়ে সেটা দেখছিলেন মা। শুভর ডাক শুনে ফিরোজা বেগম হাতের কাজ থামিয়ে ডাকলেন ছেলেকে। চশমাটি চোখ থেকে নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। শুভ আয়, ভেতরে আয়- শুভ ভেতরে ঢোকে। দাঁড়ায় এসে মায়ের পাশে। রাত তো কম হয়নি, ভেবেছিলাম, শুয়ে পড়েছিস। তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলা দরকার মা। বল্না কি বলবি। কিছুদিন হয় আমি একটা কাজ শুরু করেছি, তোমাকে বলা হয়নি। তাতে কি হয়েছে ফিরোজা বেগম একটু হাসলেন বললেন তুই এখন অনেক বড় হয়ে গেছিস, এখন নিজের ইচ্ছেয় কিছু করার যোগ্যতা তোর অবশ্যই হয়েছে। সারাজীবন কী আমাকে জিজ্ঞেস করে সব করতে হবে। যাক্ বল্, কী বলতে এসেছিস্। মা, আমি একটি প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়েছি, সে প্রকল্পের কাজ হচ্ছে এলাকাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সব তথ্যাদি সংগ্রহ করা। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রকল্প! একটু যেন চমকে উঠলেন ফিরোজা বেগম। তাকালেন সরাসরি শুভর দিকে। হ্যা, মা- আমাকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে আমার এলাকার তথ্যাদি। তোমার এলাকার মানে? ঢাকার এই এলাকার? না। আমাদের সেই বাড়ির এলাকার অর্থাৎ কুষ্ঠিয়ার সেই আব্দুল্লাহপুর, মানিক নগর ইত্যাদি এলাকার। তুমিই তো কবে যেন ঐ এলাকার কথা বলেছিলে, মনে নেই? ফিরোজ বেগম বেশ কিছুটা সময় একেবারে চুপ করে রইলেন। মাথা নীচু করে তাকিয়ে রইলেন টেবিলের দিকে। শুভ ঠিক বুঝতে পারলনা, তার কথা শুনে মা এত কী ভাবছেন। প্রকল্পের অন্য যারা করছে শুভ বলে তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছিল তাদের অনেকের বাবা মা তাদের ছেলেমেয়েরা এমন কোন প্রকল্পে কাজ করছে বলে খুশী হয়েছেন, তারা নিজেরাও যতটা পারেন তথ্যাদি দিয়ে সাহায্য করছেন। ফিরোজা বেগম তখনো চুপ করে তাকিয়ে আছেন টেবিলের দিকেই। শুভ বলে, মা তুমি খুশী হওনি, আমি এমন প্রকল্পে কাজের সুযোগ পেয়েছি বলে? এ প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে ফিরোজা বেগম মুখ ফেরালেন শুভর দিকে। শুভ পরিস্কার দেখল, মার চোখ মুখ ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। শুভ! মার গলার স্বর শুনে একেবারে অবাক হয়ে যায় শুভ, মার চোখে জল সেইকবে দেখেছে এমন ভাবে, মনে করতে পারেনা। তার সব যেন এলোমেলো হয়ে যায়। মা! শুভর বুকের ভেতর থেকে যেন একটা কান্নার দমক উঠে আসতে চায়। প্রচন্ড আবেগে আর জেদের বশে আর ধরে রাখতে পারে না। মার দিকে সরাসরি তাকায় সে। বলে, আজ আমি সেই দুযুগ আগের প্রশ্নটির উত্তর চাই, মা। ফিরোজা বেগম কোন কথা বলেন না। জলভারাক্রান্ত চোখে তাকিয়ে থাকেন শুধু ছেলের মুখের দিকে। শুভ যেন কিছু ভাবতে পারছে না এখন । মার দিক থেকে চোখ ফেরায় না। বলে, মা আজ তোমাকে বলতে হবে, কি ছিল আমার বাবার পরিচয়, যা তুমি বছরের পর বছর গোপন করে গেছো। কেন তুমি তাকে ছেড়ে আমাকে নিয়ে সেদিন দূরে চলে গিয়েছিলে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমি চাই। ফিরোজা বেগম কী ভেবে উঠে দাঁড়ান। কিন্তু একটু পরেই আবার বসে পড়েন। মাথা নোয়ান টেবিলের ওপর। কাঁদতে থাকেন নীরবে। তার শব্দে শুভও কাঁদে। বসে পড়ে পাশের খাটের ওপর। বেশ কিছুক্ষণ পরে মাথা তোলেন ফিরোজা বেগম। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন একবার তারপর অস্ফুট স্বরে বলে ওঠেন, না শুভ আমি আর পারছি না। আপন ছেলের কাছে আমি আর কত অপরাধী হবো। অমি দায় মুক্ত হতে চাই চিরদিনের জন্য। মায়ের কান্নজড়িত এসব কথা শুনে ভেতরটা যেন ফেটে যেতে চায় শুভর। গলা বুঁজে আসে কান্নায় এ আজ কোন্ মাকে দেখছে সে। ভেতরে ভেতরে মার যে এত অপরাধ বোধ আর কান্না জমে ছিল এত বছর ধরে তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব আর কঠোরতার আড়ালে সেটা তো কখনো বুঝতে বা জানতে পারেনি শুভ। মার চরিত্রের এই রহস্যময়তা এতদিন ধরে নিগুঢ় রহস্যই রয়ে গেছে তার কাছে। কখনো মুক্ত হয়নি। আলোয় আসেনি। মার কাছে এগিয়ে যায় শুভ। গভীর মমতায় মার পিঠের ওপর হাত রেখে নিজের মুখটা নামিয়ে আনে মার কাধের ওপরে। চোখ দুটো জলে ভরে যায় নিজের অজান্তেই। এইভাবে চলে যায় বেশ কিছু সময়। একসময় অস্ফুটস্বরে ফিরোজা বেগম বলতে থাকেন ওইসব দিনের কথা। রহস্যের জাল ছিন্ন করে একে একে বেরিয়ে আসে অনেক অজানা কথা, যা শুভর কল্পনায়ও ছিল না কোনদিন। ফিরোজা বেগম জানিয়ে দেন কেমন করে পেছনের সব কথা গোপন করে কাদের মল্লিক নামের মানুষটি তাকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করে। জš§ দেন শুভকে। কিন্তু বছর দুই পরে যখন হঠাৎ করে একদিন ফিরোজা বেগম জানতে পারেন কাদের মল্লিকের আসল পরিচয়, তার দু’মাসের মধ্যেই তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, যত যাই হোক না কেন সম্পর্ক তিনি রাখবেন না। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ধূর্ত রাজাকার কাশেম মোল্লা ওরফে কাদের মল্লিক। সে তাকে আর সন্তানকে মেরে ফেলার হুমকি দেন। সেই হুমকির মুখে ফিরোজা বেগম চুপ করে থাকতে বাধ্য হন। সবকিছু আড়াল রাখেন শিশু শুভর কাছেও। কিন্তু যত দিন যায়, এক সময় কী কারনে যেন অস্থিরতা বাড়ে কাদের মল্লিকের। ফিরোজা বেগম লক্ষ্য করেন, মাঝে মাঝে দু’তিনজন মানুষ আসে। তাদের সন্দেহজনক ঘোরা ফেরা আর আসা যাওয়ার মধ্যে একদিন কাদের মল্লিক গভীর রাতে প্রচুর নগদ টাকা পয়সা নিয়ে সেই লোকদের সাথে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। যাবার সময় ফিরোজা বেগমকে ডেকে বলে, আজ তোমাকে মুক্তি দিলাম, ফিরোজা আজ থিকা, তুমি মুক্ত। কাগজপত্রের দরকার নাই। আমারে আর কোনদিন দেখবানা। তবে আমার বিষয়ে কোনদিন মুখ খুইল না। তুমি তোমার মতো জীবন চালাইও। বাবা এ ইতিহাস এখানেই শেষ। পরবর্তীকালে ফিরোজা বেগম নিজের এবং একমাত্র সন্তানের জীবন থেকে এই অশুভ শক্তির ছায়া মুছে ফেলতে কোনদিনই মুখ খোলেননি কোথাও বরং নতুন গল্প তৈরী করেছেন নতুন পরিচয়ে নতুন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য। কথা শেষ করে ফিরোজা বেগম তাকান শুভর দিকে আস্তে আস্তে করে বলেন এই অপরাধে আমি অপরাধী। এই পাপ আমার। এতে তোমার কোন দায় নেই। দু’হাতে মুখচেকে বসে থাকেন ফিরোজা বেগম। রাত প্রায় শেষ। কিছু আগে মার কাছ থেকে চলে এসেছে শুভ। চারিদিকে যেন শুন্যতায় ভরা। সমস্ত শরীর মন যেন জ্বলে যাচ্ছে। ধুর্ত খূনীরাজাকার কাশেম মোল্লার রক্ত বইছে তার শরীরে এই চিন্তাই তার অস্তিত্বকেই যেন প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এই জীবন দিয়ে কী করবে শুভ! প্রকৃতপক্ষে কদিন আগে যে রাতে সে মা’র মুখোমুখি হয়েছিল সেই রাতের পর থেকে আজ পর্যন্ত মার সঙ্গে আর তেমন কথাই হয়নি। একই ছাদের নীচে দু’জন যেন দুই পৃথিবীর মানুষ। কোন কাজে এখন আর মন নেই শুভর। সারাক্ষণই একটা ঘোরের মধ্যে কাটে। মনের মধ্যে তোলপাড় করে শুধু একটি প্রশ্নই বারবার জেগে ওঠে। নিজের শরীরের এই দূষিত বিষাক্তবীজ কেমন করে সে সারাজীবন ধরে বইবে? আর কেনইবা বইবে? অন্যদিকে, কেমন করে সে তার এমন একটা গোপন ক্লেদাক্ত জীবনের সাথে জড়াবে অদিতির মতো একটা নিস্পাপ মেয়েকে ? কোনদিন তো এসব কথা তাকে বলাও যাবে না। তবে? এসব প্রশ্নের উত্তর পায়না শুভ। দিনকাটে অন্তহীন দুশ্চিন্তায় সবার চোখের প্রায় আড়ালে। রাত কাটে নিদ্রাহীন। এভাবে হতাশা ও বিষাদগ্রস্ত কোন মানুষ কি বাঁচতে পারে? নাকি বাঁচা যায়? না এভাবে বেঁচে থাকার কোন অর্থ হয়না। মনের ভেতরের প্রচন্ড ঘৃনা আর ক্ষোভ থেকে মুক্তি পেতে শুভ যেন মরিয়া হয়ে ওঠে। অনেক রাত করে আজ ঘরে ফেরে শুভ। একবার মার ঘরের দিকে যায়। মা কেমন নিথর হয়ে শুয়ে আছে মৃত মানুষের মতো। চোখের জলের রেখা দেখা যায় যেন। আবছা আলোতে চিক চিক করে ওঠে। শুভ নিঃশব্দে ফিরে আসে নিজের ঘরে। ড্রয়ারের ভেতর থেকে পাতলা ধারালো ছুরিটা হাতে তুলে নেয়। বিছানায় শুয়ে পড়ার আগে একটু থমকে কী ভেবে আবার টেবিলের কাছে গিয়ে খাতার একটা পাতা ছিঁড়ে সুইসাইড নোট লেখে: “আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, সে দুঃখ রয়েই গেল। তবে এই স্বাধীন দেশে এক ঘৃন্য রাজাকারের ক্লে¬দাক্ত রক্তবীজ থেকে চিরদিনের জন্য মুক্ত হলাম।”
×